কলকাতার এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল রানি এলিজাবেথের নামে! যে তথ্য অজানা ছিল
Queen Elizabeth II: কলকাতাতেই রয়েছে স্বয়ং রানির নামে রাস্তা?
ব্রিটেনের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে। প্রয়াত হয়েছেন রানি এলিজাবেথ দ্বিতীয়। ৯৬ বছর বয়সে অনন্তলোকের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন রানি। স্কটল্যান্ডের বালমেরাল প্রাসাদে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ৯ সেপ্টেম্বর তাঁর মরদেহ ফিরিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে লন্ডনে। গত ৭০ বছর ধরে ব্রিটেনের সিংহাসনে বসে ছিলেন রানি এলিজাবেথ। তিনিই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সময় ধরে সামলেছেন ব্রিটেনের রাজপাট। বলাই বাহুল্য, তাঁর মৃত্যুতে ব্রিটেনের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজা ষষ্ঠ জর্জ প্রয়াত হওয়ার পর ব্রিটেনের রানি হন এলিজাবেথ। এই প্রসঙ্গে জিম করবেটের বিখ্যাত উক্তি, “The princess who went up a tree and came down a queen." কিন্তু অনেকেই জানেন না, রানির 'ক্যালকাটা' কানেকশন।
কুইন এলিজাবেথ দ্বিতীয়, ভারতে তিনবার আসেন। প্রথমবার ১৯৬১ সালে, দ্বিতীয়বার ১৯৮৩ সালে এবং তৃতীয়বার ১৯৯৭ সালে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পনেরো বছর পর যখন তিনি প্রথমবার ভারতে আসেন, সেটা সবচেয়ে দর্শনীয় যাত্রা ছিল। ভারতে এটাই কুইন এলিজাবেথের প্রথম রয়্যাল ভিজিট ছিল। তাঁকে এয়ারপোর্টে নিতে যান তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং উপরাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। গান্ধিজির মৃত্যুর ১৩ বছর পর কুইন এলিজাবেথ যখন ভারতে আসেন, তখন তিনি মহাত্মা গান্ধির স্মৃতিসৌধর সামনে দাঁড়ান এবং নিজের জুতো খুলে ফেলেন। তাঁর স্বামী ডিউক অফ এডিনবরা প্রিন্স ফিলিপও ছিলেন। তিনিও তাঁর পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনিও একই কাজ করেন। এরপর দু'জনে গিয়ে গান্ধিজির স্মৃতিসৌধর সামনে মাথা ঠেকান। স্তম্ভিত হয়ে যান আশেপাশে উপস্থিত সকলে। এলিজাবেথ ভারতে ভ্রমণকারী প্রথম ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন, যিনি স্বাধীন ভারতে পা রেখেছিলেন। এলিজাবেথের প্রথম ভারত ভ্রমণের ৫০ বছর আগে তাঁর বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ এবং রানি মেরি ১৯১১ সালে ভারতে এসেছিলেন। তারপর তিনিই প্রথম ভারতে পা রাখেন। ভারত-ভ্রমণের মধ্যে তিনি প্রথমে যান আগ্রার তাজমহল দেখতে। এরপর তিনি দিল্লি ঘুরে দুর্গাপুরের উদ্দেশ্যে যান। সেখান থেকে আসেন কলকাতায়।
১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শহর কলকাতায় পা রাখেন রানি। সেবার তাকে দেখতে গোটা শহর নেমে এসেছিল পথে। ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ শহর কলকাতায় এসেছিলেন ২৩ ফেব্রুয়ারি। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর ছিলেন সরোজিনী নাইডু। তিনি ছিলেন রানি এলিজাবেথের সঙ্গী। ভারত তখন স্বাধীন। সেই প্রথম ব্রিটেনের কোনও রানির পা স্বাধীন ভারতে পড়েছিল। তাঁকে স্বাগত জানাতে শহরের রাজপথে বসেছিল তোরণ। হুডখোলা গাড়িতে চেপে রাজপথ ধরে রাজভবনে গিয়েছিল রানির গাড়ি। যা দেখতে পথের দু’ধারে ভিড় করেছিলেন অসংখ্য মানুষ। যাঁরা পারেননি, তাঁরা বাড়ির ছাদে, বাড়ির কার্নিসে ভিড় করেছিলেন। সেখানও ব্যাপক ঠেলাঠেলি। সকলেই রানিকে দেখতে চায়।
আরও পড়ুন: রাজপরিবারে প্রথম রানি এলিজাবেথের অভিষেকই দেখা গিয়েছিল টেলিভিশনে
কলকাতায় থাকাকালীনই রানি এলিজাবেথ এবং ডিউক ফিলিপ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল ঘুরে দেখেন। কুইন এবং তাঁর স্বামী দু'জনেই রানি ভিক্টোরিয়ার নাতি-নাতনি ছিলেন। তাই দু'জনেরই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখার বিশেষ আগ্রহ ছিল। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখি, এর আগে সবচেয়ে বেশি সময় পর্যন্ত ব্রিটেনের মসনদে বসে থাকার রেকর্ড ছিল রানি ভিক্টোরিয়ার। ২০১৫ সালে সেই রেকর্ড ভেঙে দেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ১৮৪৭ সালে স্থাপিত হয় হর্স রেসিং অর্গানাইজেশন। সেবার রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব রানিকে অভ্যর্থনা জানাতে বিশেষ রেস অর্গানাইজ করে। সেই সময়ে প্রাইজ মানি ছিল ৩০ হাজার টাকা। তিনি নিজেই বিজয়ীর হাতে ট্রফি তুলে দেন।
সেবার রাজভবনে রানি ও প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বাছাই অতিথিদের মধ্যে ছিলেন কলকাতার তিন জন কালজয়ী ক্রীড়া-নক্ষত্র- চুনী গোস্বামী, পঙ্কজ রায় এবং লেসলি ক্লডিয়াস। নিজের আত্মজীবনীতে রানির কলকাতা ভ্রমণ নিয়ে একটি চমৎকার ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন চুনী গোস্বামী। চুনী গোস্বামীর প্রিয় বন্ধু সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ভাটুদা তখনকার আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিলিয়ার্ডস খেলোয়াড়। এই ভাটুদা-র গাড়িতে চেপেই রাজভবনে রানির সম্মানে আয়োজিত সান্ধ্য আসরে গিয়েছিলেন চুনী। মোহনবাগান তথা ভারতের ফুটবল অধিনায়ক কী পোশাক পরে যাবেন, গরদের ধুতি, পাঞ্জাবিতে বাঙালিবাবু না স্যুট পরা সাহেব সাজবেন, তা নিয়ে চিন্তায়ও ছিলেন। শেষে ভাটুদাই পরামর্শ দেন, তুই বরং পাগড়ি চাপকান চাপিয়ে ভারতীয় মহারাজা সেজে যা! শেষমেশ অত দূরও অবশ্য এগোননি ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবল নক্ষত্র। তবে ভাটুদা-র থেকে প্রিন্সকোট ধার করে সেজেগুজে রানির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। চুনী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেওছেন, কুইনের সঙ্গে ফুটবলার বলে নিজের পরিচয় দিয়ে করমর্দন করতে হয়েছিল। আর তখনই রানির সামনে এদেশের এক জনপ্রিয় ফিল্মস্টার একটি কাণ্ড করে বসেন। ওই কাণ্ড দেখে হাসি চেপে রাখা কষ্টকর ছিল। চুনী গোস্বামী লিখেছিলেন, ওই ফিল্মস্টার থেমে থেমে ‘আমি অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক’ ইত্যাদি বলে নিজের গুণগান করছিলেন। তখন নাকি প্রিন্স ফিলিপ সকৌতুক তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘What else are you (আর কী কী করেন আপনি)?’
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সফর সেরে সেবার কলকাতায় আসেন রানি এলিজাবেথ। সেই যাত্রায় ব্রিটেনের সহযোগিতায় দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার কর্মকাণ্ড-ও এ দেশের এগিয়ে চলার স্মারক হিসেবে রানিকে দেখানো হয়েছিল। পরে দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের কলকাতার অতিথিশালার নামই হয়ে যায় রানিকুঠি। আজ্ঞে হ্যাঁ, আজকে দক্ষিণ কলকাতায় যে রানিকুঠি এলাকা আপনারা দেখেন, সেই এলাকার নাম রানি এলিজাবেথের নামে। অবশ্য ভুলেও ভাববেন না যে, রানি সেই অতিথিশালায় থেকেছিলেন। কলকাতা সফরের পুরো সময়টাই রানি কাটিয়েছিলেন রাজভবনে। আজও হয়তো রানি এলিজাবেথের সেই হাত নাড়ার দৃশ্য প্রবীণ কলকাতার মানসপটে তরতাজা।