কেউ রইল না আর, যার সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যায়

Tigmanshu Dhulia on Irrfan Khan : ইরফানের জীবনধারাটাই বড্ড ভালো লাগত আমার। জীবনকে বাঁচার ধরনটাই ছিল অদ্ভুত!

ইরফান চলে গেল। ইরফান সত্যিই চলে গেল। আর তো কেউ রইল না আমার যার সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যায়। মুম্বই তো চরম একটা প্রতিযোগিতার জায়গা। সবসময় ঢাল নিয়ে নিজেকে আড়াল করতে হয়। পার্টিতে গেলে পর্যন্ত সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। একমাত্র ইরফান ভাই থাকলে আমি নিশ্চিন্তে থাকতাম। আমার সব প্রশ্নের, সব দ্বন্দ্বের উত্তর ছিল ইরফান ভাই। ইরফান আমার একমাত্র বন্ধু ছিল এই ইন্ডাস্ট্রিতে। একমাত্র ইরফানের কথাই আমি শুনতাম, মানতাম। যদি ইরফানভাই কখনও বলত, 'তু গলত কর রাহা হ্যায়', আমি শুনতাম। অন্যদের কথা শুনি না। একে অন্যের উপরে একটা অন্যই অধিকারবোধ ছিল। আসলে ঠিক অধিকারবোধও না। আমি ইরফানভাইয়ের যুক্তিকে সম্মান, শ্রদ্ধা করতাম। জীবনকে, শিল্পকে ইরফানভাই যেভাবে দেখত আমি সেই দেখার চোখকে, বোধকে আশ্চর্য রকমের শ্রদ্ধা করতাম। বিশ্বের একজন সেরা শিল্পী ছিল ইরফান। আর পাঁচজনের মতো নয় তো। বন্ধু তো কতজনই হয়! কত ছোটবেলার বন্ধু থাকে, কোন ছোটবেলা থেকে হয়তো দেখছে। তার মানে তো এই নয় যে আমি তার সব কথাই শুনছি, মেনে নিচ্ছি। ইরফান জীবনকে জানত। ইরফানের কথার গভীরতা আমাকে টানত।

হলিউডে তো হামেশাই হয়, বলিউডেও অনেকসময় অনেক পরিচালক নির্দিষ্ট অভিনেতার সঙ্গে কাজ করতে করতে একটা কমফোর্ট জোনে চলে যান। এটা হয়। আমার সঙ্গেও কি তবে ইরফান ভাইয়ের কোনও গভীর অধিকার বোধের জায়গা তৈরি হয়েছিল? যা তৈরি হয়েছিল তাকে ঠিক অধিকারবোধ বলা যায় কিনা আমি জানি না। আমি জানি যে আমি পরিচালক এবং আমি লিখিও। আমি চিরাচরিত খাঁচার বাইরে গিয়ে অন্যরকমভাবে ভাবতে পারি। এখানেই ইরফান আর আমার একটা ম্যাজিক কাজ করত। ইরফান অত্যন্ত ভালো অভিনেতা ছিল। আমি আমার লেখায় অদ্ভুত সব পরিস্থিতি, অদ্ভুত সব সঙ্কট তৈরি করতাম। আর আমি জানতাম ইরফান বিষয়টাকে সামলে নেবে। অভিনেতা তো একজন লেখক-পরিচালকের যোগাযোগের মাধ্যম। অভিনেতাই দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। ইরফান আছে মানেই আমি নিশ্চিন্ত থাকতাম। মনে হতো সব ঠিক আছে। অদ্ভুত শক্তি পেতাম।

আরও পড়ুন- ‘দরকার হলে সারাজীবনে চারটে সিনেমা করব, কিন্তু সৎভাবে করব’: অনির্বাণ ভট্টাচার্য

অনেকেই একজন অভিনেতাকে মাথায় রেখেই চরিত্র লেখেন। এখন যখন কোনও কিছু লিখতে বসি, মাঝে মাঝে বড্ড মিস করি ইরফান ভাইকে। আমার মাথায়, আমার চোখের সামনে ইরফান যেন আনাগোনা করতে থাকে, অথচ অধরা। কিন্তু মজার ব্যাপারটা এখানেই। ইরফানকে ভেবে চরিত্র লিখতে হতোই না। যা চরিত্রই লেখা হোক না কেন ইরফান তা করতে পারত। আমাকে অভিনেতার কথা ভেবে চরিত্র লিখতে হচ্ছে মানে সেই অভিনেতার একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে। তার বাইরে তাঁকে দিয়ে অভিনয় করাতে গেলে ভাবতে হবে। ইরফান ভাই তো অসীম! ওকে দিয়ে ১৬ বছরের বাচ্চার চরিত্র হয়তো করাতাম না, গিটার বাজানো কোনও চরিত্রও করাতাম না অবশ্যই কারণ ইরফান সেই মানুষ নয়। কিন্তু নির্দিষ্ট চরিত্রের ছকে ইরফানভাইকে বাঁধা যায় না কখনই।

ইরফানের সঙ্গে আলাপ তো সেই দিল্লিতে। আমিও এনএসডির ছাত্র ছিলাম। ইরফান আমার চেয়ে ২ বছরের সিনিয়র। ন্যাশনাল ড্রামা স্কুলে খুব বেশি পড়ুয়া তো থাকত না। প্রথমে হয়তো ওই র‍্যাগিং পর্বেই আলাপ। এইটা করে দেখাও, ওইটা করে দেখাও... এসব করে 'ইন্ট্রো' দিতে গিয়েই হয়তো প্রথম একে অন্যকে চেনা। লোকজন তো কম। সবাই সবাইকে চেনে। আলাপ তো হয়েই যায়। ধীরে ধীরে আমি ইরফানের কাজ দেখতে থাকি। আমার কিন্তু ইরফানের প্রতি আকর্ষণ জন্মে ওর কাজ দেখেই। বন্ধুত্ব আগে হয়নি, সেসব অনেক পরে। আগে আমি ওর কাজের প্রেমেই পড়ি। একসঙ্গে কখনও থিয়েটার করিনি অবশ্য। কিন্তু ওর থিয়েটার আমি দেখতাম। আমার আগেই ইরফান বম্বে চলে আসে। আমি আসি ১৯৯৩ সালে। তারপর তো দেখাসাক্ষাৎ চলতেই থাকে।

ব্যন্ডিট কুইন সিনেমাটা যখন হচ্ছে, আমি সেই সিনেমায় অ্যাসিস্ট্যন্ট ডিরেক্টর। সেই সময়েই আমি ঠিক করি পান সিং তোমর সিনেমাটা আমি করবই, পরিচালক হয়েই করব। কাউকেই তখন বলিনি। সত্যি বলতে কী, তখন ইরফানের কথা আমি ভাবিওনি। গল্পটা ভেবেছি কেবল। পান সিং তোমরই তখন আমার কাছে সবচেয়ে বড়, তাতে কে অভিনয় করবেন, কাকে কাকে নেব, এসব মাথাতেও নেই। চরিত্র তো অভিনেতার চেয়েও বড়, সবসময়ই। ইরফানকে প্রথম এই চিন্তাটা বলি অনেক পরে, গল্পের ছলেই। পয়সাপাতিও নেই তখন। সিনেমা করার আগে খুঁটিয়ে রিসার্চ করার ধারণাটাও তখন সেভাবে ইন্ডাস্ট্রিতে জনপ্রিয় হয়নি। কয়েকজন প্রোডিউসারের কাছে যাই। 'ডাকু পিকচার' বলে কয়েকজন আগ্রহও দেখায়। কিন্তু এটুকুতে তো হবে না। একজন সত্যিকারের চরিত্র। তাঁকে নিয়ে তো পড়াশোনা করতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে কত ছোটখাট ঘটনা, কত ব্যাখ্যা! কত বিশ্লেষণ বাকি তখনও। স্ক্রিপ্ট প্রথম খসড়া করার পরে ইরফানকে শোনাই। বাকিটা ইতিহাস! হাসিল সিনেমার কথাও যখন প্রথম ভাবা হয়, ইরফানভাইকে ভাবা হয়নি। মনোজ বাজপেয়ীকে ভেবেছিলাম। মনোজও আমার বন্ধুই ছিল। ততদিনে 'সত্য' সিনেমা হয়ে গেছে। মনোজ 'হ্যাঁ' বললে কাজটা শুরু হয়েই যেত। কিন্তু ভিলেনের চরিত্র করতে রাজি হলো না মনোজ। ইরফানকে বললাম, ওর ভালো লাগল। ওর কাছেও কাজ ছিল না তেমন। ব্যাস, হাসিলে ইরফানকে নিয়েই শুরু হলো কাজ। ইরফান চরিত্র আর সিনেমার কেমিস্ট্রিটা বুঝে যেতেন সহজেই। এমন বহু বহুবার হয়েছে, কোনও একটা সিনেমার তো কিছু বিশেষ জায়গা থাকে। আমরা সেই মোড় ঘোরানো কিছু দৃশ্য নিয়ে কথা বলতে বলতে ডায়লগ লিখতাম। ইরফান আর আমি, দুই বন্ধু।

ইরফানের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা ঠিক কেমন ছিল শব্দে বলা যায় কি? কখনই কি বলা যাবে? আসলে ইরফানের জীবনধারাটাই বড্ড ভালো লাগত আমার। জীবনকে বাঁচার ধরনটাই ছিল অদ্ভুত! কোনও জিনিসে সামান্যতম আগ্রহ পেলেই একদম তার শেষ দেখে ছাড়ার পাত্র ছিল ইরফানভাই। নিজের শর্তে বাঁচত। ক্রিকেট ছিল আমাদের দু'জনের মধ্যেকার এক বন্ধনহীন গ্রন্থি। রান্না করাটাও। কোথাও বেরিয়ে যাওয়া হুট করে, কোনও গ্রামে থেকে যাওয়া, ঘুড়ি ওড়ানো ছিল আমাদের মধ্যেকার সেই অদৃশ্য সুতো। আর ছিল রাজনীতির চর্চা। গুরুগ্রামে থাকতে একটা দোকানে যেতাম আমরা, হামেশাই। হিন্দি বইয়ের দোকানে। পুরনো পুরনো সাহিত্যের চমৎকার বই পাওয়া যেত। আমি আর ইরফান ভাই সেই বইপত্র খুঁজতে যেতাম একসঙ্গে। আবার কিছু ক্ষেত্রে খুটখাট ঝামেলাও হতো। মনে আছে, সাহেব বিবি গ্যাংস্টার পার্ট ২ নিয়ে একদম খুশি হয়নি ইরফান। এমন একটা সিনেমা, তাও আবার নানা পাটেকারের সঙ্গে কেন আমি করছি এই নিয়ে খুবই মনক্ষুণ্ণ হয়েছিল ইরফান ভাই। আমারও তো হামেশাই মনে হতো, ইরফান এমন সিনেমা কেন করছে। হ্যাঁ, অনেক সময়েই পয়সার দরকারে আমাদের অনেক কিছুই করতে হয়। তাও মনে হতো কেন যে করছে...

আরও পড়ুন- বলিউডের নতুনরা খারাপ ছাত্র, সকলে শুধু বিখ্যাত হতে চায়: তিগমাংশু ধুলিয়া

অভিনেতা ইরফান খান ছিল একেবারে অন্য স্তরের মানুষ। অভিনেতার আসল রেওয়াজ সে কীভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখছে। কম দিন তো হলো না, কত কী দেখলাম। কত কত মানুষকে দেখলাম সামান্য সাফল্যে মাটি ছেড়ে একেবারে আকাশে! আর ইরফান ভাই তো জীবনকে বুঝতেন, জীবনকে দেখতেন। অবজার্ভ করাটাই অভিনেতার শ্রেষ্ঠ রেওয়াজ। হাসিলের ইরফান থেকে পিকুর ইরফান, চোখের সামনে একজন অভিনেতাকে দেখে বারবার মনে হতো অভিনেতাই তো একা নয়। গল্প, পরিচালনা সবটা মিলে একটা প্যাকেজ। শুধু অভিনেতাই পুরোটা উৎরে দিলেন, এমন না। হাসিলের আগে তো আমরা অনেক কাজই করেছিলাম টেলিভিশনে। ইরফান তাতেও অনবদ্য ছিল। 'নেমসেক' সিনেমায় ইরফানকে ব্রিলিয়ান্ট বললেও কম বলা হয়। আসলে অনেকসময় অভিনেতার কাজ ক্রিপ্টের উপর নির্ভর করে। আর ইরফান এমনই মানুষ, ও স্ক্রিপ্টে যা লেখা আছে তার মধ্যে নতুন দিক খুঁজে বের করত!। ম্যাজিক করত ইরফান। মনে হতো এই তো, এইটাই তো চেয়েছিলাম!

ইরফান এর আগে হয়নি, ইরফান খান এর পরে হবেও না। অনেকেই ধারেকাছে আসবেন কিন্তু দ্বিতীয় ইরফান হবেন না। ইরফান নিজের সময়কে বোঝা একজন অভিনেতা। সময় তো সতত পরিবর্তনশীল। এর পরে কী হবে জানা নেই। আরও কী কী ভাবে সমাজ বদলে যাবে জানা নেই। সেই পাল্টে যাওয়া সময়ে তেমনই দক্ষ কোনও অভিনেতা আসবেন কিনা তাও জানা নেই। যদি আসেন, তিনি তাঁর সময়কেই তুলে ধরবেন। ইরফান নিজের সময়কালকে, নিজের চারপাশকে লিখে রেখেছে নিজের অভিনয়ে, নিজের সেই চোখে, নিজের বেঁচে থাকায়। ঘটমান সমস্ত কিছুর মধ্যে থেকে উঠে এসেছে ইরফান, সময়েরই গল্পকে ঝুলিতে ভরে। তাঁর মতো করে তাঁর সময়কে কেই বা আর বলতে পারবে?

(কথোপকথনভিত্তিক অনুলিখন। সৌজন্যে:সিরাজ মুখোপাধ্যায়)

More Articles