ভোটজয়ের বছর ঘুরতেই ছন্নছাড়া তৃণমূল! কেন দল ছাড়তে চাইছেন একদল নেতা
TMC Inner Conflict: কেন 'চলে যাব' বলছেন তৃণমূল নেতারা?
২০১৪ সাল। তৃণমূলের গুছিয়ে নেওয়া সংসারে যেন তাসের ঘরের ছোঁয়া। একদা বন্ধু মুকুলের রায় বদলের হাত ধরে ভাঙতে থাকল তৃণমূল। একে একে নেতারা হাজির হলেন গেরুয়াগৃহে। আর এই দলবদলের রেশ ধরেই ২০১৪ এবং পরে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ভাল ফল করে বিজেপি। যে ফল বিড়ম্বনা বাড়ায় তৃণমূলের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কৌশলে প্রথম ধরতে হয় ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের হাত। এদিকে শুভেন্দু অধিকারীর আচমকা দলবদল চিন্তা বাড়ায় সবুজ-শিবিরে। একপ্রকার ক্ষমতা চলে যাওয়ার চিন্তা নিয়েই ফের মসনদে ফেরে তৃণমূল কংগ্রেস। ফের ঘর গুছিয়ে নেন নেত্রী মমতা। সেই সময়ে দল ছাড়া 'গদ্দার'-রা ফেরেন পুরনো দলে। ঘুরে দাঁড়ায় তৃণমূল।
কিন্তু রাজনীতিতে স্থায়ী বলে কিছু হয় না, প্রতিমুহূর্তেই বদলে যায় পরিস্থিতি। এই প্রবাদবাক্য সত্য করে ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যেই আবার মমতার তৃণমূলে শুরু হয় বিধ্বস্ত আবহ! জল্পনা, এই আবহেই আর শুধু বিরোধীরা নন, ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছেন তৃণমূল নেতারাই! একটা সময়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অনুব্রত মন্ডলদের দাপটে খেই-হারানো অনেকেই নাকি 'থাকব না আর তোমার কাছে, চলে যাব অনেক আছে'- দলের অন্দরে এইরকম এক মনোভাব পোষণ করছেন। যার ফলে দলের ভাবমূর্তি এবং একাধিক বিরোধী-বিড়ম্বনার মধ্যেই নতুন চ্যালেঞ্জ নেমে এসেছে তৃণমূলের অন্দরে! কারণ, এক সময়ে তৃণমূলের সলতে পাকানোয় যাঁদের অবদান ছিল, সেই তাঁরাই ব্রাত্য থেকেছেন। আর সেই ব্রাত্য অংশের অনেকেই এবার তৃণমূলের চরম রাজনৈতিক দুর্দিনে সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে দাবি সূত্রের। যদিও অনেকেই বলছেন, সুবিধে নয়, এই সমস্ত পুরনো তৃণমূল কংগ্রেসের সৈনিক, যাঁরা বাম আমলে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছেন। তাঁরা এই সুযোগে নিজেদের ন্যায্য পাওনা বুঝতে চাইছেন, যা এতদিন ওই অংশের নেতারা পাননি। যেখানে পার্থ-র মতো নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে অচিরেই 'সাইড' হয়ে যেতে হয়েছে অনেককেই। কুণাল ঘোষের 'কামব্যাক' যে ফেরার ক্ষেত্রে এক সার্থক উদাহরণ হতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে।
আরও পড়ুন: মমতাও চাইছেন কংগ্রেস-মুক্ত ভারত? ২০২৪-এর অঙ্ক যেভাবে কষছেন তৃণমূল নেত্রী
এই জল্পনার মধ্যেই উঠে এসেছে বরানগরের তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক তথা রাজ্য বিধানসভার মুখ্য সচেতক তাপস রায়ের একটি তাৎপর্যপূর্ণ বয়ানে। যেখানে তিনি বলছেন, "রাজনীতিতে বয়স একটা ফ্যাক্ট, শরীর একটা ফ্যাক্ট। শরীর সঙ্গ না দিলে পড়ে থাকার কোনও মানে হয় না। সব দলেরই উচিত বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া। নিজেকেও রেহাই দেওয়া উচিত। দল বলার আগেই আমাদেরও রেহাই দেওয়া উচিত। আমি কারও নাম করছি না। আমি সাধারণ কথাই বলছি। এতে দলেরই ভালো।" এই প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাপস আরও বলেন, "আমি যে কথা বলেছি, সেটা আমার ব্যক্তিগত মত। মনে করি, রাজনীতিতে আপার এজ লিমিট থাকা উচিত। কারণ আমরা যদি জায়গা ধরে রাখি, তাহলে নতুন জেনারেশন সামনে আসবে কীভাবে?" এই মন্তব্যের পরেই প্রশ্ন ওঠে দলের অস্বস্তি কি বাড়াচ্ছেন তৃণমূলের এই প্রবীণ নেতা? তাপস রায় নিজেই এই জল্পনা প্রসঙ্গে বলেন, "আমি দলের অস্বস্তির কারণ নয়। জলন্ত প্রাণ ছিলাম, আছি, থাকব।" এই প্রসঙ্গে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক এবং তৃণমূলে বর্তমানে 'শেষ কথা' অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও সুকৌশলে তুলে ধরেন এই তৃণমূল বিধায়ক। তাঁর মন্তব্য, "অভিষেক-সহ অনেকেই রাজনীতিতে বয়সের কথা বলছেন। তবে আমি দেড় বছর ধরে একথা বলে আসছি, এটা নতুন নয়।"
প্রশ্ন ওঠে, রাজনীতিতে বয়স প্রসঙ্গে সরব হয়ে আসলে কি দলেরই একটা বড় অংশের আজীবন কাল পদ পাওয়ার বিরুদ্ধে সরব হলেন তাপস রায়। যেখানে পরোক্ষে কটাক্ষ ছুড়লেন সৌগত রায়ের মতো একাধিক নেতার দিকে! প্রসঙ্গত, রাজনীতিতে বয়সের ঊর্ধ্বসীমাকে হাতিয়ার করেছে বিজেপি। মোদি-রাজত্বে বয়সের দায়ে দলেই নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে লালকৃষ্ণ আদবানি, যশবন্ত সিনহার মতো নেতাদের। যদিও এই পন্থা খুব কম ক্ষেত্রেই ব্যবহার করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উপরন্তু সিএম জাটুয়া, চন্দ্রনাথ সিনহার মতো প্রবীণদের নির্বাচনে টিকিট দিয়েছেন তিনি। ঠিক এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে অচিরেই দিনের পর দিন খেটে চলা তৃণমূল নেতা-কর্মীরা থেকেছেন ব্রাত্য। দলের তরফে বড় বা গুরুত্বপূর্ণ পদ পাননি অনেকেই! তাপস রায়ের তৃণমূলের সঙ্গে থাকার সময়কাল এবং কাজ হিসেব করলে তিনি ঠিক কতটা গুরুত্বের পদ পেলেন, তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। আর এই প্রেক্ষাপটেই তৃণমূলের একটা বড় অংশের ব্রাত্য নেতারা ফাঁকা জায়গা পূরণের চেষ্টা করতে পারেন, এমন দাবিও করা হচ্ছে। যেখানে জেলায় জেলায় দুর্নীতিকে হাতিয়ার করে, বিরোধীদের বিরোধিতার মধ্যেই নিজের দলে দিনের দিনের পর পদ আগলে থাকা নেতাদের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন কেউ কেউ। এর মধ্যেই একের পর জায়গায় ঘটছে উলটপুরাণ।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগেপরে তৃণমূল ছাড়ার ঝোঁক পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেও দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি, মেটেলি ব্লকের পূর্ব বাতাবাড়ি স্কুলপাড়া এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে সিপিএম-এ যোগ দিয়েছে ২৩টি পরিবার। আবার এগরা ২ ব্লকের বাথুয়াড়ীতে একটি সভায় তৃণমূল ছেড়ে কয়েকশো মানুষ সিপিএম-এ যোগদান করেন। লালগোলার নসিপুর এলাকায় সিপিএম-এর জনসভায় যোগ দেয় প্রায় ১৫০টি স্থানীয় পরিবার। যা তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বকে দুর্নীতি, নিয়োগ সংক্রান্ত অভিযোগের পাল্টা কৌশলের সঙ্গেই ভাবিয়ে তুলছে। আর এই অবস্থায় কি ঘোলাজলে মাছ ধরতে চাইছেন কেউ কেউ? রাজনৈতিক মহলের একাংশ বলছেন, এই ক্ষেত্রে তাপস রায়কে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়। তিনি অন্য কিছু ভেবেও এমন মন্তব্য করতে পারেন। কিন্তু এটাও ঠিক যে-কোনও রাজনৈতিক দল শুধু নয়, সমস্ত জায়গায় হাতি কাদায় পড়লে অথবা খানিকটা বিড়ম্বনার আঁচ কেউ পেলেই কাদা থেকে শোল ধরতে উদ্যত হন কেউ কেউ!