নজরে পঞ্চায়েত নির্বাচন, নরম হিন্দুত্বে সায় তৃণমূলেরও! বুঝিয়ে দিল কালী বিতর্ক

গ্রামে-গঞ্জে গেরুয়া শিবির যেভাবে শিকড় বিস্তার করছে, তাতে বেকায়দায় পড়েছে দল। তাই এই সময় বিজেপি-র কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট হাতছাড়া হতে দেওয়া কাম্য নয় বলেই হয়তো মহুয়ার থেকে দূরত্ব বাড়িয়েছেন দলীয় নেতৃত্ব।

 

বাঙালির কালী আছেন, শিব আছেন। বাইরের কারও চাপিয়ে দেওয়া দেবতা না হলেও চলবে। তিন বছর আগে একুশের মঞ্চ থেকে এমনই মন্তব্য করতে শোনা গিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। হিন্দুত্ববাদী শক্তির সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাঙালি সত্তাকেই এগিয়ে রেখেছিলেন। বঙ্গ রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন বহিরাগত তত্ত্বকে। কিন্তু ‘কালী সংকট’ নেমে আসতেই বাঙালি সত্তা থেকে দূরত্ব বাড়াল তৃণমূল। বাঙালিয়ানা নয়, গুরুত্ব পেল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের অঙ্ক। তাই দেশের ২৮টি রাজ্য, আটটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হয়েও, স্রোতে ভেসে যাওয়া থেকে গা বাঁচাতে পারলেন না মমতা নিজেও। স্বাধীন মতামত জানিয়ে তাঁর চোখের সামনেই দলের অন্দরে কোণঠাসা হয়ে পড়লেন মহুয়া মৈত্র।

উচ্চশিক্ষিত, চোখধাঁধানো কেরিয়ার পিছনে ফেলেই রাজনীতিতে পদার্পণ মহুয়ার। যুব কংগ্রেস থেকে ২০১২ সালে তৃণমূলে যোগদান। রাহুল গান্ধীর বিশ্বস্ত অনুচর থেকে তৃণমূল নেত্রী মমতার ছত্রছায়ায় জায়গা করে নিতেও তেমন কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। বরং মমতার ছত্রছায়ায় থেকেও নিজস্ব স্বতন্ত্র পরিচিতি তৈরি করেন মহুয়া। ২০১৬ সালে করিমপুর থেকে প্রথমবার বিধায়ক হন। তারপর ২০১৯ সালে কৃষ্ণনগর থেকে সরাসরি লোকসভায় প্রবেশ। সংসদের হই-হট্টগোলের মধ্যেও বরাবর নিজের বক্তব্য, দলের অবস্থান তুলে ধরতে সফল হয়েছেন মহুয়া। বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে সংসদে দাঁড়িয়ে পাঠ করেছেন রাহত ইন্দৌরির শায়েরি। হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের সামনে, যাবতীয় তর্জন-গর্জনের সামনে দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়েছেন, প্রত্যেকের রক্ত মিশে রয়েছে ভারতের মাটিতে, এই দেশ কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয়।

২০১৪-র পর থেকে বিরোধীদের অস্তিত্বই যখন লাগাতার প্রশ্নের মুখে পড়েছে, ইডি-সিবিআই তদন্তের মুখে যখন পড়েছেন তাবড় রাজনৈতিক নেতা-ব্যক্তি, সেই সময়ও নিজের মাথা উঁচু রাখতে পেরেছেন। তবে বিদেশের চাকরি, সংসদের বিচরণের বাইরেও বরাবর বাঙালি সত্তাকে এগিয়ে রেখেছেন মহুয়া। নিজের সাফল্যের চেয়ে বাঙালি জাত্যাভিমানকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই কেউ প্রশংসা করতে এলেও অবলীলায় বলতে পেরেছেন, এই কৃতিত্ব তাঁর নয়, বাঙালিয়ানার। দু’বেলা পেট ভরে খেতে না পারলেও, মেয়েকে কলেজ পাশ করানোর স্বপ্ন দেখেন বাংলার গৃহস্থরা। বাঙালি জাতির সেই মানসিকতাই তাঁকে এতদূর আসতে সাহয্য করেছে। লুটিয়েন্স দিল্লির স্বঘোষিত চৌকিদারের সামনে তাই দলনেত্রীকে বাংলার বাঘিনী হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছেন।

আরও পড়ুন: তারাপীঠে দেবীকে উৎসর্গ করা হয়…, মহুয়া-বিতর্কে ফিরে দেখা কালীসাধনার উপাচার

কিন্তু দলনেত্রীর প্রশংসা করলেও, তৃণমূলে তল্পিবাহকের ভূমিকায় নিজেকে কখনও আটকে রাখেননি মহুয়া। উজ্জ্বল বিশ্বাস থেকে নদিয়ায় তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে বারবার তাঁর ঠান্ডা লড়াইয়ের কথা উঠে এলেও, নিজের জায়গায় অটল থেকেছেন মহুয়া। আবার প্রকাশ্য সভায় মমতার কাছে ধমক খেয়েও রাজনীতির প্রোটোকল মেনেই দলনেত্রীকে মুখের ওপর সাফাই দিতে যাননি তিনি। আবার নদিয়ায় নাবালিকা ধর্ষণের ঘটনায় যখন মমতার মুখে মেয়েটির ‘প্রেমের সম্পর্ক’ উঠে এসেছে, প্রকাশ্যে সেই মন্তব্যের সমালোচনাও করতে শোনা গিয়েছে মহুয়াকে। নাবালিকার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক অপরাধই, তার সামনে সম্মতি, অসম্মতির প্রশ্ন গৌণ বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি।

তাই একটি তথ্যচিত্রের পোস্টারে কালীরূপী বহুরূপীর সুখটানের ছবি, তাঁর পিছনে লিঙ্গসাম্যের প্রতীক রামধনু প্রতীকও মানবাধিকারের খাতিরেই দৃষ্টিকটু মনে হয়নি মহুয়ার। ধর্মকে ঢাল করে শিল্পী এবং শিল্পীসত্তাকে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছেন যাঁরা, তাঁদের সামনে বাঙালির সেই চিরাচরিত উদারপন্থী ধর্মাচরণের ইতিহাসকেই তুলে ধরেন তিনি। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ শুধুমাত্র উপমায় পর্যবসিত হয়েছে জেনেও, বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা না করে সর্বসমক্ষে জানিয়ে দেন, কালী বলতে মাংস খাওয়া, সুরা-গ্রহণকারী দেবীকেই বোঝেন তিনি। বিগত আট বছরে দেশে ধর্মীয় সংবেদনশীলতার তীব্রতা, ভাবাবেগের মাত্রা রিখটার স্কেলের সূচক ছাড়িয়ে গিয়েছে জেনেও, বারুদের স্তূপের ওপর সজ্জিত ধর্মের নামে বিধ্বংসী রাজনীতির অংশ হয়েও সোজাসাপটা নিজের স্বাধীন মতামত প্রকাশ করেন মহুয়া।

তাঁর মন্তব্য যে ক্রমশ পশ্চাদগামী সমাজের মগজে বিস্ফোরণ ঘটাবে, তার আঁচে পুড়তে হবে তাঁকে, সেকথা বিলক্ষণ জানতেন মহুয়া। কসাইখানায় গরুর আর্তনাদকে ভূমিকম্পের নেপথ্য কারণ হিসেবে মেনে নেয় যে সমাজ, ধর্মাচরণ, খাদ্যাভ্যাস, বেঁচে থাকার অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে দেখেও রা কাড়ে না যে সমাজ, ধর্মের নামে মানুষকে কচুকাটা হতে দেখেও না দেখার ভান করে থাকে যে সমাজ, তার কাছ থেকে কোনও প্রত্যাশা রাখেননি তিনি। কিন্তু বাংলার পিতৃতান্ত্রিক রাজনীতিকে ভেঙে খান খান করে নারীশক্তির প্রতীক হিসেবে উঠে আসা নেত্রীর হাতও যে মাথার ওপর থাকবে না, তা কি আঁচ করতে পেরেছিলেন মহুয়া? হয়তো পেরেছিলেন। তাই কোণঠাসা হয়েও নিজের অবস্থান থেকে একচুল সরেননি তিনি। বরং জানিয়েছেন, যত এফআইআর-ই দায়ের হোক, দেশের যে আদালতেই যেতে হোক না কেন তাঁকে, আমৃত্যুও যদিও লড়তে হয়, ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত তিনি।

দলের অন্দরেই সেই লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে মহুয়ার। কার্যত একঘরে হয়ে গিয়েছেন তিনি। তৃণমূল জানিয়ে দিয়েছে, তাঁকে রক্ষা করার কোনও দায় নেই তাদের। দলের কাছেও তাঁর মন্তব্য অত্যন্ত নিন্দাজনক। তিনি যা বলেছেন, তার দায় একা তাঁকেই নিতে হবে। দল কোনও সাতেপাঁচে নেই। তাতেই প্রশ্ন ওঠে, দলের কর্মীকে রক্ষা করার দায় কেন থাকবে না তৃণমূলের? হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন থেকে রাজ্যকে বাঁচাতে যদি বাংলার নিজের মেয়েকে বেছে নেওয়ার দায় থাকে, তাহলে তৃণমূলের নিজের কর্মীকে রক্ষা করার দায় থাকবে না কেন, বিশেষ করে যেখানে বাঙালিয়ানা, বাঙালি সত্তার প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে।

হিন্দি বা মারাঠা বলয়ে বৈধতা পাওয়া ধর্মাচরণের তথাকথিত সংজ্ঞা কোনওকালেই অনুসরণ করেনি বাংলা। তাই গোড়া থেকেই স্বঘোষিত হিন্দুধর্মের রক্ষকদের চোখে শূল হয়ে বিঁধেছে বাঙালি। বাঙালির ধর্মাচরণ বরাবর তাদের কাছে নেহাত ছুটির উদযাপন হয়ে থেকেছে। অষ্টমীতে লুচি-শিমুই, নবমীতে খাসির মাংস, বাঙালির পুজো তাদের কাছে তাই পেটপুজোর উপলক্ষ বলেই মনে হয়েছে তাদের। রক্ষাকালী পুজোয় বলি দেওয়া পাঁঠায় রসনাতৃপ্তি, সরস্বতী পুজোর এলাহি খাওয়াদাওয়া, তাদের কাছে মোচ্ছব হয়েই থেকেছে। স্বাভাবিকভাবেই কালীর আরাধনায় মাছ-মাংস-মদ (কারণবারি) নিবেদনে তাদের আঁতকে ওঠাই স্বাভাবিক।

কিন্তু তৃণমূল গোরখপুর বা নাগপুরে জন্ম নেওয়া কোনও দল নয়। গাঁজার ঘোর লাগা, মায়াবী চোখের চোখের শিব কেন বাঙালি মেয়ের আদর্শ প্রেমিকের সংজ্ঞা হয়ে দাঁড়ায়, কালো মেয়ের পুজোয় কেন বাঙালি ছেলে কালো হরিণ চোখের মেয়ে খোঁজে, পুজো-উৎসবে কোন মন্ত্রে খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে মন দেওয়ানেওয়া হয়ে যায়, এসবের খবর রাখার দায় তাদের রয়েছে বইকি। বাঙালির ভোট নেবে শুধু, বাঙালির ধর্মাচরণের অধিকার রক্ষার দায় নেবে না, কালীপুজোয় মদ-মাংস নিবেদনের সত্যতাকে নিন্দাজনক মন্তব্যের আখ্যা দেবে, তা হতে পারে না।

তৃণমূল অনুগামীরা যদিও যুক্তি সাজাতেই পারেন যে, সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। তার আগে ভূরি ভূরি দুর্নীতি, অনিয়মের অভিযোগে জেরবার দল। গ্রামে-গঞ্জে গেরুয়া শিবির যেভাবে শিকড় বিস্তার করছে, তাতে বেকায়দায় পড়েছে দল। তাই এই সময় বিজেপি-র কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট হাতছাড়া হতে দেওয়া কাম্য নয় বলেই হয়তো মহুয়ার থেকে দূরত্ব বাড়িয়েছেন দলীয় নেতৃত্ব। দলে একঘরে হয়ে মহুয়া কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তা সময়ই বলবে। কিন্তু হিন্দু ভোট ধরে রাখতে গিয়ে, বাঙালিয়ানা, বাঙালি সত্তাকে অস্বীকার করার তাদের এই বদবুদ্ধি, ভোট ধরে রাখতে নরম হিন্দুত্বের স্রোতে গা ভাসানোর এই প্রবণতা, দীর্ঘমেয়াদি রাজনীতিতে তাদের আদৌ লাভবান করবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

কারণ মনে রাখতে হবে, বিজেপি তিন থেকে ৭৭ হলেও, স্বাধীনতা-সচেতন বাঙালির দৌলতেই ২১৫টি আসন জুটেছিল তাদের, যাতে এতটা আশা করেননি বলে ফলাফল বেরনোর পর মানতে হয়েছিল স্বয়ং মমতাকেও। তার পরেও মহুয়াকে সমর্থন না করলেও, ঘটনার সত্যতাকে নিন্দাজনক বলা বাঙালি সত্তাকেই অস্বীকার করার সমান। নাগপুর এবং গোরখপুরের থেকে বাংলার ধর্মীয় সংস্কৃতি ঠিক কোনখানে আলাদা, ক্ষমতাসীন দল হিসেবে তা তুলে ধরার দায়িত্ব তৃণমূলেরই। সত্যতা তুলে ধরায় মহুয়াকে কোণঠাসা করার মধ্যে লাভ নয়, তাদের ক্ষতিই বেশি।

 

More Articles