হিমালয়কে বাঁচাতে হিমঠান্ডায় অভুক্ত জেগে হাজার হাজার সন্তান

Ladakh: খোলা আকাশের নীচে, তাপমান দিনের বেলা সাকুল্যে ৮° সেলসিয়াস আর রাতে তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে মাইনাস পনেরো ডিগ্রিlতে। সোনম একলা নন, ওঁর পাশে খোলা আকাশের নীচে খালি পেটে থাকছেন শয়ে শয়ে মানুষ।

২০২৩ সালের অক্টোবরের শুরুর দিকের কথা। সেই দিনই লেহ-তে নেমেছি। শরীরকে আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য অন্তত দেড় দিন বিছানায় শুয়ে অথচ না ঘুমিয়ে আয়েস করে থাকার কথা। সর্বসাধারণের জন্য বানানো এই নিয়ম আমার মানা হয় না সবসময়। কারণ জন্মসূত্রে কলকাতাবাসী হলেও কর্মসূত্রে হিমালয় পাহাড়ের যেসব উঁচু জায়গায় আমার সারা বছর অবাধ বিচরণ তার অন্যতম লাদাখ। তাই সকালটা বিছানায় না-শুয়ে বাগানে বসে স্থানীয়দের সাথে আড্ডা মেরে দিব্যি আলসেমিতে কাটিয়ে দিলাম। কাল সক্কাল সক্কাল এখান থেকে রওনা দেব সিয়াচেনের পথে ছোট্ট গ্রাম প্যানামিকের দিকে। 

বিকেলে মনে হল, কালকের সকালের জামাকাপড় একটু বের করে টুকটাক খাবার হাতের কাছে নিয়ে গোছগাছ সেরে ফেলি না কেন! যেই ভাবা সেই কাজ, রুকস্যাক আর হ্যান্ডব্যাগ থেকে টুক টুক করে মাল এধার-ওধার করতে গিয়ে দেখি 'যাহ ! রুকস্যাকের একটা চেন কেটে গেছে তো!' 

এই কান্ড অন্য কোথাও ঘটলে ওই কাটা চেন নিয়েই ঘুরতে হত। কিন্তু লেহ শহরের ব্যাপারই আলাদা। সমুদ্রতল থেকে সাড়ে এগারো হাজার ফুট উঁচুর লেহ মার্কেট যে কোনও বড় শহরের মার্কেটকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে ; হেন জিনিস নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। 

অগত্যা আমার লাদাখি মুশকিল আসানকে ফোন করলাম। 

" রিনচেন, একবার লেহ মার্কেট যাবো ভাবছি । গাড়িটা নিয়ে এসো তো...." 

" লেহ মার্কেট? এখন? আজ তো মার্কেট বন্ধ ..." 

লেহ মার্কেট বন্ধ শুনে কানে ভুল শুনলাম কিনা প্রবল সন্দেহ হল। আবার বললাম " আরে লেহ মার্কেট লেহ মার্কেট... বন্ধ কেন হবে!" 

" আজ সোনম ওয়াংচুকের ডাকে মিছিল-সভা আছে যে । সবাই সেখানেই যাবে। " 

আরও পড়ুন: মাইনাস ঠান্ডায় খোলা আকাশের নীচে টানা অনশন! যে দাবিতে লাদাখে সরব বাস্তবের ‘ব়্যাঞ্চো’

পদ্মপাতায় জল আর মানুষের স্মৃতি কখন টুকুস করে খসে পড়ে, তা কেউ বলতে পারে না। এই সোনম ওয়াংচুককে চিনতে পারলেন তো ! যাঁরা পারলেন না বা নামটা কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকছে অথচ কোথায় যে শুনেছেন, মনে পড়ছে না, তাঁদের জন্য বলি সেই যে একটা সিনেমা এসেছিল 'থ্রি ইডিয়টস ', তাতে আমির খান যে 'ফুংসুক ওয়াংড়ু' চরিত্রটি করেছিলেন, সেটা সোনমের জীবন থেকে আংশিক অনুপ্রাণিত। সোনম নিজে একাধারে ইঞ্জিনিয়ার , শিক্ষাবিদ, পরিবেশবিদ এবং আবিষ্কারক। ম্যাগসাইসাই পুরস্কারের মত অনেক বড় বড় পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে আছে। 

যাহ্ বাবা সোনম হঠাৎ মিটিং মিছিল সভা ডাকতে গেল কেন! 

আমি ঠোঁট উল্টে কিছুক্ষণ ভেবে ' আমার কি দরকার ' বলে চেনা ব্যাগের দোকানের মালিক নোরবুকে ফোন করলাম। 

" নোরবু, আজ দোকান খোলা ?"

" না ম্যাম... সোনম ওয়াংচুক সভা ডেকেছে যে, সেখানে যাবো.." 

" নোরবু, আমার ব্যাগের চেন কেটে গেছে। কালই আমি প্যানামিক চলে যাবো। আজ তুমি ঠিক না করে দিলে কী হবে! " 

" কাল সকালে বেরিয়ে যাবে তার মানে!" বলে খানিকক্ষণ চুপ করে কী ভেবে বলল , " ঠিক আছে খুব তাড়াতাড়ি চলে এসো । মিছিল আসার আগেই এসো । সভা শুনতে যাবো কিন্তু...." 

To save enviornment and Himalaya of Ladakh, Sonam Wangchuk and thousand people of the land are protesting by hunger strike হোটেলের বাগানে নামতেই দেখি রিনচেন এসে গেছে। 

" চলো গাড়িতে উঠি.." 

" কোনও গাড়ি চলবে না। হেঁটে যেতে হবে।" 

" কেন! তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে নোরবু , গাড়ি ছাড়া অত তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারব নাকি!" 

" রাস্তায় বেরিয়ে অবস্থাটা দেখবে চলো ..." 

রাস্তায় বেরিয়ে দেখি, ও মা! কাতারে কাতারে স্ত্রী-পুরুষ হাতে 'We want 6th schedule' প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিছিল করে চলেছেন। আমরাও তখন সেই মিছিলেই পা মিলিয়ে চলতে শুরু করলাম। শুধু উদ্দেশ্য আলাদা। স্বার্থপরের মত আমি আমার ব্যাগের চেন সারানোর জন্য মিছিলের মধ্যে একে তাঁকে টপকে এগিয়ে চলেছি, ঘড়ির দিকে চোখ রাখতে রাখতে। সোনমের সভার আগে নোরবুর কাছে পৌঁছতেই হবে যে। 

এগোতে এগোতে যে মিছিলের মাথায় এসে গেছি, তা খেয়ালও করিনি। একজন ভদ্রলোকের সাথে ধাক্কা লাগতে লাগতে বেঁচে মুখ তুলে তাকাতেই দেখি ভদ্রলোক মিষ্টি হেসে বললেন 'জুলে'। 

জুলে হল লাদাখি সম্বোধন, হাই হ্যালো, এমনকী ধন্যবাদ বোঝাতেও 'জুলে' বলা রেওয়াজ। আমিও হেসে 'জুলে' বলে ভাবছি লোকটাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে যেন! 

"খুব ভালো লাগল, আপনি স্থানীয় না হয়েও আমাদের সমর্থনে হাঁটছেন। কোথা থেকে এসেছেন?" 

"কলকাতা" — বলেই আমি ব্যাগ সারানোর কথা বলতে যাচ্ছি, রিনচেন আমার হাতটা চেপে বলল " ইনিই সোনম ওয়াংচুক, তুমি চিনতে পারলে না!" 

এইবার বুঝলাম কেন এত চেনা মনে হচ্ছিল। 

"আপনি আসছেন সভায়? যদি আসেন আমাদের ভালো লাগবে। আমরা চাই, লাদাখের বাইরের মানুষরা জানুক লাদাখের লড়াই কী নিয়ে?"

বলেই ভদ্রলোক তেমনই একগাল হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন। এমন আমন্ত্রণ এড়ানো যায় না। সভাস্থলে পৌঁছে দেখি কী সাংঘাতিক ভিড়, যেন পুরো লেহ শহর ভেঙে পড়েছে সভায়। সবার হাতেই '6th schedule'-এর দাবি লেখা প্ল্যাকার্ড। ভারতীয় সংবিধানের 6 th schedule অর্থাৎ ষষ্ঠ তফসিলে আছেটা কী? —এটা মনে করার চেষ্টা করছি, ততক্ষণে সোনম বলতে শুরু করেছেন । 

সোজা কথায় মূল বিষয়বস্তু যা বুঝলাম, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহারে ছাপার অক্ষরে বড় বড় করে বলা হয়েছিল লাদাখকে ভারতীয় সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় আনা হবে। একইভাবে ২০২০ সালের পার্বত্য পরিষদ নির্বাচনের আগেও বিজেপির ইস্তাহারে ছাপানো হয়েছিল— 'Political empowerment for Ladakh : Constitutional safeguard for Ladakh under 6th schedule of Indian constitution as discussed by Apex body with Home Ministry to protect the land job and environment focussing the Ladakh's unique linguistic and ethnic culture'

কিন্তু, তারপর ভোট বৈতরণী পেরোতেই নেতারা সবার আগে এই প্রতিশ্রুতিকে সিন্ধু নদের জলে ভাসিয়ে দেন। ২০২১ সাল থেকে এই নিয়ে জনমানসে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। একে একে দিন যায় মাস যায় বছর ঘোরে কিন্তু কেউ কথা রাখে না। 

এবার সভার দাবি হল :

  • লাদাখকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দিতে হবে।
  •  লাদাখকে ভারতীয় সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তিকরণ।
  •  লাদাখের তরফ থেকে লোকসভায় দু'জন সাংসদ দেওয়া হোক।
  •  লাদাখ পাবলিক সার্ভিস কমিশন তৈরি করে শিক্ষিত বেকারদের চাকরির ব্যবস্থা ও সুযোগ করে দেওয়া। 

এই ভারতীয় সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তির মাহাত্ম্য হল, আর্টিকেল ২৪৪ এর অন্তর্গত ভারতীয় সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী অসম-মেঘালয়-ত্রিপুরা-মিজোরামের জনজাতি অধ্যুষিত এলাকাকে বিশেষ সংরক্ষণ দেওয়া হয়। এই চার রাজ্যের রাজ্যপালেরা জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় নতুন করে সীমানা নির্ধারণ করতে পারেন। এই তালিকাভুক্ত হতে পারলে লাদাখের জমি-বন-জনজাতি নিয়ে বিশেষ সংরক্ষণ নীতি থাকবে। 

কিন্তু লাদাখ কি সত্যিই জনজাতি অধ্যুষিত তকমা পাওয়ার যোগ্য? National Commission for Schedule Tribes (NCST)-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, লেহ শহরে ৬৬.৮% , নুব্রাতে ৭৩.৩৫% , খালস্তি তে ৯৭.০৫% , কার্গিলে ৮৩. ৪৯% , সানকুতে ৮৯.৯৬% , এবং  জন্সকারে ৯৯.১৬% জনজাতির বাস। এই তথ্য অনুযায়ী শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানেরা এই গণনার অন্তর্ভুক্ত নয়। তাঁরা অন্তর্ভুক্ত হলে গড় জনজাতির বাস গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৯৭%। তাই লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় এনে এখানকার পরিবেশ -জমি-প্রাণী-সংস্কৃতিকে বিশেষ সুরক্ষা দেওয়া উচিত। 

তৃতীয় দাবি অনুযায়ী, ৩৭০ ধারা বিলোপের আগে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় লাদাখের চারজন বিধায়ক থাকতেন, নুব্রা - লেহ - কার্গিল - জন্সকার থেকে। বর্তমানে ইউনিয়ন টেরিটরি হওয়ার পর রাজ্যস্তরে কোনও নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই, লাদাখের ভালো-মন্দ স্থির হয় দিল্লি থেকে। এনাদের বক্তব্য, যেহেতু দিল্লির প্রতিনিধিরা লাদাখের নন, তাই তাঁরা চেষ্টা করেও লাদাখের কীসে ভালো বা কীসে মন্দ, তা সঠিক ভাবে নিরূপণ করতে পারেন না। লাদাখের পরিবেশ ও জনজাতির জন্য কোন কোন জিনিস উপযোগী সেটা বুঝতে বুঝতেই নতুন নির্বাচনের সময় এসে যায়। তাই রাজ্যস্তরে একটি বিধানসভা প্রয়োজন বৈকি। 

To save enviornment and Himalaya of Ladakh, Sonam Wangchuk and thousand people of the land are protesting by hunger strike

সোনম আরো বিশদে বুঝিয়ে বললেন , "ধরা যাক বাইরে থেকে যিনি আসছেন, তিনি দেখছেন বিস্তৃত ধূ ধূ জমি পড়ে আছে দিকে দিকে। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, এই আপাত ধূ ধূ ঊষর জমির তলায় লুকিয়ে আছে ইউরেনিয়াম, প্লাটিনাম, রোডিয়াম, প্যালাডিয়াম , রুথেনিয়াম, ইরিডিয়াম, অসমিয়াম , আর্সেনিক ওর, সোনা, বোরাক্স , গ্রানাইট, লাইমস্টোন, মার্বেল, সালফার, কোয়ার্টজ, ফেল্ডসপার, জারকন, রুটাইল, মোনাজাইট ইত্যাদির অগাধ ভান্ডার। দ্রাস, সুরু ও সিন্ধু উপত্যকায় সোনার সন্ধান মেলে। পুগা উপত্যকায় পাওয়া যায় বোরাক্স ; লেহ - কার্গিলে পাওয়া যায় উৎকৃষ্ট মানের মার্বেল । জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, পুগা উপত্যকায় রয়েছে প্রায় ছয় হাজার টনের সুবিশাল সালফার ভান্ডার। এবার যাঁরা কেন্দ্রে বসে নীতি নির্ধারণ করছেন, তাঁরা যদি এখানে খনি শিল্প গড়ে তোলেন, তাহলে লাদাখের উন্নতির বদলে দ্রুত বিনাশ নেমে আসবে। কারণ বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে হিমবাহ গলে যাচ্ছে খুব দ্রুত। আর লাদাখ বহু অংশই এই হিমবাহের জলের উপরে নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে শিল্প হলে আরও জল প্রয়োজন, আর জলের জোগান দিতে গিয়ে হিমবাহ ধ্বংস হবে আরও দ্রুত। তৈরি হবে খরা, হড়পা বানের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা যোশীমঠ বা উত্তরকাশীর মত বিপুল ভূমিধ্বস। 

এছাড়া লাদাখের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নানা পশু-পাখির চারণভূমি, এই ধরনের শিল্প উদ্যোগ হলে এই পশু পাখিরাও বিপন্নবোধ করবে। লাদাখের পূর্ব অংশে হেমিস ন্যাশনাল পার্কে প্রায় ছ'শো বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে প্রায় তিনশোরও বেশি স্নো লেপার্ড; ব্লু শিপ বা ভারাল, যার স্থানীয় নাম নাপো, যা আসলে ভেড়া আর ছাগলের মাঝামাঝি এক প্রাণী; চাংথাং এলাকায় পাওয়া যায় গোল্ডেন ঈগল বা স্থানীয় লাদাখী ভাষায় যার নাম লকনাক; টাংসে-ডুরবুক অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায় হিমালয়ান মার্মট বা ফিয়া নামের প্রাণীটির, বিড়ালের মত সাইজ - কাঠবিড়ালি গোত্রীয় একটি ভারি মিষ্টি প্রাণী ; ইঁদুর-খরগোশ মেশানো এক প্রাণী দেখতে পাওয়া যায় যার নাম লাদাখ পিকা বা জাব্রা ; মাউন্টেন উইসেল বা লাকিমো, এদের সংখ্যা ক্রমশ এমনিই কমে আসছে। তিব্বতী খরগোশ বা রিবং দেখতে পাওয়া যায় চাংথাং, মারখা উপত্যকা, রুম্বক উপত্যকায়; টিবেটিয়ান উলফ বা শানকু দেখতে পাওয়া যায় চাংথাং, মারখা উপত্যকা, জন্সকার অঞ্চলে; করজক অঞ্চলে এবং সো মোরিরি থেকে সো করের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় ব্ল্যাক নেকেড ক্রেন যা স্থানীয় ভাষায় চা থুং থুং নামে পরিচিত ; টিবেটিয়ান অ্যান্টিলোপ বা সোস এদের গায়ের লোম থেকে পাওয়া যায় শাহতুষ নামের বিখ্যাত এবং ভয়ঙ্কর দামী পশম। ফলে যত বেশি মানুষ এখানে আসবেন, তত বেশি এই পশম পাওয়ার জন্য চোরাশিকারিদের উৎপাত বাড়বে। 

লাদাখে মূলত চার রকম ভাষা প্রচলিত, তিব্বত চিন সীমান্ত অঞ্চলে তিব্বতী , পাকিস্তান সীমান্তে উর্দু আর বালটি, আর বাকি অংশে লাদাখি। প্রচুর শিল্পায়ন ও শহরায়ন হলে বিভিন্ন ভাষাভাষী  মানুষ এখানে আসবেন, বসতি তৈরি করবেন। তাতে এই স্থানীয় ভাষাগুলোর মৌলিকত্ব কতদূর বজায় থাকে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান সোনম।

কথা শুনতে শুনতে কখন ঘণ্টা কাবার হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। সোনম সভা শেষে একটা ভারি চমৎকার কথা বললেন , " A politician thinks of the next election but a statesman thinks of the next generation. তাই আমরা এখনও ভরসা করব, যে যাঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাঁরা শুধুই রাজনীতিক নন।" 

এরপর কেটে গেছে কয়েকটা মাস। তার মধ্যে আমরা বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে ডিসেম্বর মাসে বরফহীন শুকনো জোজিলা দেখে ফেলেছি। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে দ্রাস অঞ্চলে আইস হকি টুর্নামেন্টের বরফ জমানোর জন্য সার দিয়ে টেবিল ফ্যান চালাতে দেখে ফেলেছি। এমনকী, কাশ্মীরের বিখ্যাত চিলাই কালানে যখন নাকি বছরের সবচেয়ে বেশি শীত পড়ার কথা, তখন শুকনো খটখটে কাশ্মীর দেখে ফেলেছি আমরা। অসময়ে বসন্তের টিউলিপ গজাতে দেখে ভয় পেয়েছি। এরপর মার্চের শুরুতে খবরে জানতে পারি, প্রশাসন লাদাখকে ষষ্ঠ তফসিলের বিশেষ সংরক্ষণের আওতায় আনতে চান না। 

৬ ই মার্চ সোনম ওয়াংচুক ঘোষণা করলেন, এবার অহিংস আন্দোলন শুরু হবে। গান্ধীজি স্বাধীনতার সময় সর্বোচ্চ একুশ দিনের অনশন করেছিলেন। উনিও তাই করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে একটানা একুশ দিন শুধু নুন আর জল দিয়ে অনশন করবেন সোনম। তারপর একুশ দিন করবেন মেয়েরা, তারপর ছাত্রছাত্রীরা, তারপর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা, তারপর বয়স্ক মানুষেরা, তারপর আবার সোনম ওয়াংচুক ফিরে আসবেন অনশন মঞ্চে। 

আরও পড়ুন: অল ইজ নট ওয়েল ইন লাদাখ! ১৮০০০ ফুট উচ্চতায়, -৪০ ডিগ্রিতে কেন অনশনে বসছেন ওয়াংচুক?

খবরটা শুনে চমকে উঠেছিলাম। বলে কী লোকটা ! এই ঠাণ্ডায় খোলা আকাশের নীচে অনশন ! 

সত্যি সত্যি অনশন শুরু করলেন সোনম ওয়াংচুক। খোলা আকাশের নীচে, তাপমান দিনের বেলা সাকুল্যে ৮° সেলসিয়াস আর রাতে তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে মাইনাস পনেরো ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সোনম একলা নন, ওঁর পাশে খোলা আকাশের নীচে খালি পেটে থাকতে লাগলেন শয়ে শয়ে মানুষ, কেউ একদিন - আবার কেউ বা দু'দিন একটানা অনশন চালিয়ে গেলেন। মাথার উপরে অবিশ্রান্ত বরফ পড়ে চলেছে। তবু যেন মানুষগুলোর কোনও বিকার নেই। হিমালয়ের সন্তান ওঁরা, তাই হিমালয়ের প্রাণ বাঁচাতে শেষ রক্তবিন্দু পণ করে বসেছেন। সোনম ওয়াংচুকের সমর্থনে একদিনের জন্য অনশন সভায় বসলেন মুম্বাই , নাগপুর, পুনে, বেঙ্গালুরু, তাওয়াং, উত্তরাখণ্ড, নতুন দিল্লি, জম্মু, লুধিয়ানা, লখনৌ, জয়পুর, যোধপুর, গুজরাটের প্রচুর মানুষ। কলকাতার নামটা এই তালিকায় যখন খুব মিস করছি, হঠাৎ একদিন দেখলাম সোনমের অনশন শয্যার বালিশের পাশে রবীন্দ্রনাথের একটা ছবি— 'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য' বলে সাহস জুগিয়ে দিচ্ছিলেন বুঝি । অনশনের বিশতম দিনে সোনমের সাথে ওই জায়গায় আড়াই হাজার মানুষ একসাথে বসেছেন অনশনে, আর সারা লাদাখে সেইদিন অনশনরতের সংখ্যা সাত হাজার ছাড়িয়েছে, যেখানে লাদাখের পুরো জনসংখ্যাই তিন লাখ। 

একুশতম দিন, মাইনাস দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা, বরফঝড়া দিনে অনশন ভাঙলেন সোনম ওয়াংচুক। এই একুশটা দিনে সরকারের তরফে সামান্য একটা বার্তাও পাঠানো হল না। 

সোনম অনশন ভাঙলেও সভাস্থলে সাথে সাথে অনশনে বসে গেলেন অগুনতি অজস্র মহিলা। যতক্ষণ না সরকার ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছেন ততক্ষণ অনশন চলতেই থাকবে। বরফে-বৃষ্টিতে-কড়া রোদ্দুরে একদল মানুষ বসে থাকবেন হিমালয়ের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে। এই প্রতিজ্ঞা তাঁরা করেছেন হিমালয়ের কাছে, তাঁদের আগামীর জন্য। এই প্রতিজ্ঞা তাঁরা ভাঙবেন না, কারণ রামের সবচেয়ে বড় অনুগামীরা 'রামচরিতমানস' ভুলে গেলেও এঁরা সেই একটা লাইন অক্ষরে অক্ষরে মনে রেখেছেন " রঘুকুল রীত সদা চলি আই, প্রাণ যায়ে পর বচন না যায়ে "।

More Articles