শাহরুখ নয়, 'ডিডিএলজে'-র রাজের চরিত্রে এই হলিউড হিরোকেই চেয়েছিলেন পরিচালক...

Shah Rukh Khan, DDLJ: যে ছবির হাত ধরে দর্শক খুঁজে পেয়েছিল প্রেমিকের সেই চিরন্তন সত্তাটিকে, সেই 'দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে' ছবিতে নাকি অভিনয় করার কথাই ছিল না শাহরুখের।

ট্রেন চলে যাচ্ছে দূরে। রাগী বাবার হাত ছাড়িয়ে, নিন্দুকদের মুখে ধুলো উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে মেয়েটি প্রাণপন। ট্রেন থেকে বাড়ানো হাত দূরে দূরে সরে যাচ্ছে আরও। রেলগাড়ির গতি বাড়ছে। এই প্ল্যাটফর্ম ছাড়ল বলে। ঠিক এমন সময়েই ঘটে যাবে সেই ম্যাজিক। যে ম্যাজিকের জন্যই যেন অপেক্ষা করে বসেছিলেন হলভর্তি দর্শক। হাতের সঙ্গে মিলে গেল হাত, ট্রেনে উঠে পড়লেন নায়িকা। দর্শক যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এই একটা ছুঁয়ে ফেলা আপামর মধ্যবিত্ত ভীরুপ্রেম একটা জাতিকে বাঁচিয়ে দিল যেন ট্রেনছুট হওয়ার আতঙ্ক থেকে। বড় বড় দেশে ছোট ছোট এমন কত রূপকথার জন্ম যে হয়, তা প্রথম জানল মানুষ। ভারতীয় সিনেমার জগতে গেঁথে গেল একটি মাইলফলক। যা আজও মানুষের হৃদয়ে বসে আছে অবিকল। যা পুরনো হয়নি তিন দশকেও।

আরও পড়ুন: নায়িকা আসে, নায়িকা যায়, বলিউডি সাম্রাজ্যে নিজের রাজত্ব আজও অটুট রাখেন শাহরুখ খান

বক্সঅফিসে চূড়ান্ত হিট এই ছবি অচিরেই ভারতের মাটি পেরিয়ে পৌঁছে গেছিল বিদেশেও। শাহাজাহান-মমতাজ, হীর-রাঞ্ঝা, সেলিম-আনারকলির ভিড়ে সিনেমাপ্রিয় জনতা পেল নয়া জুটি। সেই রাজ-সিমরানের প্রেমে আজও বুঁদ দর্শক। তবে জুটি তো কেবল একটা নয়, আরও একটা পছন্দসই জুটি একইসঙ্গে খুঁজে পেয়েছিল বলিউড। ঠিক ধরেছেন, সিনেমাপ্রিয় আম আদমির বরাবরের পছন্দের জুটি শাহরুখ-কাজল, যাঁরা একসঙ্গে পর্দায় এলে আজও ম্যাজিক হয়, এত বছর পরেও। আর এসবের মধ্যে আদ্যপান্ত রোমান্সের দেবতা হিসেবে যদি কেউ দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়ে থাকেন, তা বোধহয় শাহরুখ খান।

তবে যে ছবি দিয়ে সেই হিট জুটির সূত্রপাত, যে ছবির হাত ধরে দর্শক খুঁজে পেয়েছিল প্রেমিকের সেই চিরন্তন সত্তাটিকে, সেই 'দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে' ছবিতে নাকি অভিনয় করার কথাই ছিল না শাহরুখের। রাজ মলহোত্রের ভূমিকায় পরিচালকের প্রথম পছন্দ ছিল এক 'ব্লু আয়েড বয়'। বিদেশের মাটিতে বড় হওয়া রাজ মালহোত্র। তার চালচলন থেকে আচার ব্যবহার, সবেতেই পরদেশের ছাপ। আর এমন চরিত্রের সঙ্গে এদেশের কোনও অভিনেতা সুবিচার করতে পারবেনই বা কেন! এমন ভাবনা থেকেই সম্ভবত মার্কিন অভিনেতা টম ক্রুজকে রাজ মলহোত্রকে রাজের চরিত্রে চেয়েছিলেন পরিচালক আদিত্য চোপড়া। স্বাভাবিক ভাবেই প্রত্যাখ্যাত হন পরিচালক। টম ক্রুজ সটান সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তখন হলিউডের জনপ্রিয়তম হিরো টম। আর সেসময় বলিউড-হলিউডের মধ্যে যাতায়াতও এতটা সহজ ছিলনা। তবে এ কথা ঠিক, শশী কাপুর বা ভিক্টর ব্যানার্জির মতো অনেক অভিনেতাই ততদিনে হলিউডে অভিনয় করে ফেলেছেন। তবে তাই বলে টম ক্রুজ ভারতে এসে সর্ষে ক্ষেতে ম্যান্ডোলিন বাজিয়ে প্রেম নিবেদন করবেন, এ স্বপ্ন বোধহয় একটু বাড়াবাড়িই ছিল না। তাছাড়া ছেলের এই পরিকল্পনায় সম্মতি ছিল না প্রযোজক যশ চোপড়া। সম্ভবত তা বাজেটের কথা ভেবেই। সে যাই হোক, টমের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্ল্যান বি-র দিকে এগোলেন আদিত্য। না, তাঁর পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয় নম্বরেও ছিল না শাহরুখের নাম। এর পরে তিনি দ্বারস্থ হন নবাবপুত্র সইফ আলি খানের। কিন্তু তিনিও হ্যাঁ বললেন না। অগত্যা যাওয়া হল শাহরুখের দরবারে।

বছর কয়েক হল তখন বিনোদনের দুনিয়ায় পা রেখেছেন শাহরুখ। ততদিনে অবশ্য গোটা পনেরো ছবি করে ফেলেছেন তিনি। তার মধ্যে ''বাজিগর', 'ডর'-এরর মতো সুপারডুপার হিট ছবি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে 'চমৎকার', 'দিল আসনা হ্যায়'-এর মতো চূড়ান্ত ফ্লপ ছবিও। একেক বছর সেসময় তিনটে-চারটে করে ছবি করছেন শাহরুখ। ছোট পর্দার একটি ধারাবাহিক থেকে শুরু করে বড় পর্দার এই রাস্তাটা সহজ ছিল না মোটেই। ফলে মুড়ি-মিছড়িতে আলাদা করার সুযোগ তখন তাঁর হাতে ছিল না। ঠিক এমন সময়ে যশরাজ ব্যানারের ছবির অফার তো ফেরনোর কোনও প্রশ্নই ছিল না। রাজ চরিত্রের জন্য় রাজি হলেন শাহরুখ এবং করলেনও। শুধু করলেনই না, এতটাই বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন তিনি চরিত্রটিকে, যে দর্শকদের মনের মণিকোঠায় সারাজীবনের জন্য জায়গা করে নিল রাজ।

সে সময় এক হাজার সপ্তাহ টানা প্রেক্ষাগৃহ দখলে রেখেছিল এই 'দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে'। বলিউডের ইতিহাসে সেসময় যা ছিল রেকর্ড। এমনকী আজও সেই ছবির জনপ্রিয়তা কমেনি এতটুকু। আজও মুম্বইয়ের মরাঠা মন্দির নামে একটি প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হয় এই ছবি। গত ২৮ বছর ধরে চলে আসছে এই রেওয়াজ। করোনাকালীন সময়ে তা কিছুদিন বন্ধ হয়ে গেলেও পরম্পরা টলেনি। এখনও সেখানে দেখা যায় ছবিটি। আজও সর্বকালের সেরা এবং জনপ্রিয়তম ছবিগুলির একটি 'দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে'।

আরও পড়ুন: সবাই জানেন ‘আজগুবি’ সিনেমা! তাও কেন ভারতবর্ষে চিরকাল জিতে যান শাহরুখ খান?

রোমান্সের সর্বময় সম্রাট যে শাহরুখ খান, তার হয়ে ওঠার পিছনে সম্ভবত বড় ভূমিকা ছিল এই ছবিটির। সেটা ভাইরালের যুগ ছিল না বটে, তবে তখনও ভালো সিনেমা, ভালো ছবি কিংবা ভালো গানের কদরল করার মানুষ কম ছিলেন না। সেসব নিয়ে হইচইও কম হত না। ঠিক এখন যেমন ভাইরাল হওয়া গান, ছবির দৃশ্য বা সিনেমা নিয়ে হয়। বলা যেতে পারে, তেমনই একটি 'ভাইরাল' হওয়া ছবি সম্ভবত 'ডিডিএলজে', যা সেসময় দাঁড়িয়ে ভেঙে ফেলেছিল এতদিন ধরে চলে আসা সব প্রেম-সম্পর্কের ধারণাই। শাহরুখ যদিও পরবর্তীকালে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, প্রেমিকের বাইরে গিয়ে অন্যান্য চরিত্র, বিশেষত 'বাজিগর' বা 'ডর'-এর মতো নেগেটিভ চরিত্র করতে চেয়েছেন তিনি গোড়া থেকেই। পরবর্তীকালে সেই দক্ষতা একাধিক বার প্রমাণ করেছেন বলিউড বাদশা। তা সত্ত্বেও রাজ মালহোত্র হয়ে শাহরুখ যা তাঁর ভক্তদের দিয়ে গিয়েছেন, তা বোধহয় প্রেমের কিংবদন্তি হয়েই থেকে যাবে আজীবন।

More Articles