১৩ ঘণ্টা ধরে ক্রাইম সিন খোলা! আরজি করে পুলিশের কর্তব্যে গাফিলতি, নাকি অভিসন্ধি?
RG Kar Rape Kolkata Police: রাজ্য আদালতে জানায় ক্রাইম সিন সিল করা, প্রাথমিক তদন্ত, অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের সবই হয়েছে ১১টার আগে।
কোনও অপরাধ ঘটা থেকে শুরু করে পুলিশের সেই অপরাধের স্থলে যাওয়ার সময়টুকু চরম গুরুত্বপূর্ণ। এটুকু আজকাল ওয়েব সিরিজ আর ক্রাইম থ্রিলারের সৌজন্যে শিশুরও জানা যে, অপরাধ যেখানে ঘটেছে, অর্থাৎ পুলিশের পরিভাষায় ক্রাইম সিন 'লক' করতে হয়। সেখানে অন্য কোনও মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যায় কারণ ওই স্থানটিতেই অপরাধের তদন্তের যাবতীয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রমাণ লুকিয়ে থাকে। পুলিশ বা ফরেনসিক দলের সদস্য ব্যাতীত অন্য কেউ সেই এলাকায় ঢুকলেই তথ্যপ্রমাণ নষ্ট হতে পারে। অথচ, আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে এমন মর্মান্তিক খুন ও ধর্ষণ ঘটে যাওয়ার পরেও ১৩ ঘণ্টা ক্রাইম সিন মুক্ত! পুলিশের পাঠের খুব গোড়ার দিকের ক্লাসের শিক্ষা এই ক্রাইম সিন সিল করার বিষয়টি। অথচ ১৩ ঘণ্টা প্রায় সেই সামান্য পাঠটুকু কাজে লাগাতেই ভুলে গেল পুলিশ? ভুলে গেল নাকি, এটি ইচ্ছাকৃতভাবেই?
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আদালতে খুব মূলগত একটা প্রশ্ন তুলেছেন। ডিওয়াই চন্দ্রচূড় বলছেন, “সকাল ১০টা ১০ মিনিট নাগাদ টালা থানা অভিযোগ দায়ের করল। রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ ঘটনাস্থল সিল করল পুলিশ? এতক্ষণ সেখানে কী হয়েছিল?” সকাল থেকে রাত, এত বড় অপরাধের স্থান খালি পড়ে রইল? যে কারও অবাধ যাতায়াত সেখানে, যে কেউ চাইলেই হাতের ছাপ মুছে ফেলতে পারে, টুকরো টাকরা প্রমাণ সরিয়ে ফেলতে পারে, জুতোর দাগ ঘষে দিতে পারে... কত কীই তো সম্ভব! পুলিশ কি অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরেও এই ঘটনার অভিঘাত বুঝতে না পেরেই এই ভুল করল নাকি বিশেষ কোনও নির্দেশে পুলিশকে এই ভুল করতে হলো?
আরও পড়ুন- স্বর্ণপদক জয়, সেরা হাসপাতালের তালিকা, আরজি করের মৃতার ডায়রিতে যা যা লেখা…
আরজি কর কাণ্ডে গোড়া থেকেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তড়িঘড়ি অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতার করেও পুলিশের মুখরক্ষা হয়নি। গাফিলতির প্রশ্ন উঠেছে বারবার। রাজ্য অবশ্য বলছে, ক্রাইম সিন সিল না করার বিষয়টি যেমন ভাবা হচ্ছে তেমন নয়। সব কিছুরই ভিডিওগ্রাফি রয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে, এমন অপরাধের ক্ষেত্রে প্রতিটি সেকেন্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে প্রায় ১৩ ঘণ্টা ক্রাইম সিন খোলাই পড়েছিল, পুলিশের কাছে কি সেই ১৩ ঘণ্টারই ভিডিওগ্রাফি আছে? এখানেই শেষ নয়। ময়নাতদন্ত নিয়েও একাধিক প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যাচ্ছে। বুধবার আদালতে বিচারপতি পারদিওয়ালা ময়নাতদন্তের সময়পর্ব জানতে চেয়েছিলেন। রাজ্য সেই উত্তরে জানায়, সন্ধ্যা ৬টা ১০ থেকে ৭টা ১০-এর মধ্যে মৃতার ময়নাতদন্ত হয়। তখন বিচারপতি পারদিওয়ালা আবারও প্রশ্ন করেন, অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা কখন দায়ের করা হয়? রাজ্য জানায়, দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের হয়। প্রশ্ন জাগে, ময়নাতদন্ত হওয়ার আগেই পুলিশ কী করে বুঝে গেল অস্বাভাবিক মৃত্যু? আর যখন ময়নাতদন্ত হয়েই গেল, তখন তো মৃত্যুর কারণ পুলিশের জানা। তাহলে পুলিশ কী করে অস্বাভাবিক মৃত্যু বলে এই মৃত্যুকে? শুধু তাই নয়, যে হাসপাতালে ঘটনাটি ঘটেছে, সেই হাসপাতালেই ময়নাতদন্ত করা হলে তা যে স্বচ্ছ হবে এমন নিশ্চয়তা কি ছিল?
ঘটনার পরম্পরা আর সময়কালের মধ্যে কোথাও গরমিল থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিচারপতিরা। বৃহস্পতিবার বিচারপতি মনোজ মিশ্র প্রশ্ন করেন, ৯ অগস্ট সন্ধ্যায় ময়নাতদন্ত হয়। সাড়ে ১১টায় জেনারেল ডায়েরিতে লেখা হয়েছে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা। এর মধ্যে কোনও যুক্তিই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ময়নাতদন্তের কথা কেন পুলিশ উল্লেখ করছে না ডায়েরিতে? বিচারপতি পারদিওয়ালা স্পষ্ট জানিয়েছেন, পুলিশের ভূমিকাতে তিনি অবাক! বলেছেন, "পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার কে? তদন্তে তাঁর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ রয়েছ। কীভাবে এমন তদন্ত হলো?”
বিচারপতি পারদিওয়ালা বলছেন, "আমি আমার ৩০ বছরের আইনের কেরিয়ারে এমনভাবে তদন্ত হতে দেখিনি। আপনি যদি ময়নাতদন্তের আগেই অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের করেন, তবে কিসের ভিত্তিতে করলেন। যদি ময়নাতদন্তের পরে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা করে থাকেন, তবে তখন অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা কেন দায়ের করলেন, তখন তো মৃত্যুর কারণ জেনেই গিয়েছেন!” প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ও পুলিশের দেওয়ার সময়সারণী নিয়ে 'খটকা'য়। তিনি বলছেন, "আপনারা বলছেন অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের হয়েছিল ৯ অগাস্ট দুপুর ১ টা ৪৫ মিনিটে। অথচ কেস ডায়েরিতে স্পষ্ট বলা আছে, রাত ১১টা ৩০ মিনিটে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের হয়েছিল। কোনটি ঠিক?”
রাজ্য আদালতে জানায় ক্রাইম সিন সিল করা, প্রাথমিক তদন্ত, অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের সবই হয়েছে ১১টার আগে। অথচ কেস ডায়রিতে লেখা আছে, অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা এবং ময়নাতদন্তের রিপোর্ট— সবই নথিভুক্ত হয়েছে সাড়ে ১১টার সময়। পরে ১১টা ৪৫ মিনিটে এফআইআর হয়। এখানে আবার পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সকাল সাড়ে ৯টায় আরজি করে ওই মৃতা তরুণীর দেহ উদ্ধার হয়। প্রায় ১৪ ঘণ্টা পরে সেদিন রাত সাড়ে ১১টায় এফআইআর দায়ের হয়। এই দেরি করার যুক্তি খুঁজে পাননি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ও। শুরু থেকেই এত কেন ঘেঁটে ফেলেছে কলকাতা পুলিশ? মৃতার বাবা-মাও অভিযোগ করেছিলেন, খবর পেয়ে হাসপাতালে পৌঁছনোর পর প্রায় ৩ ঘণ্টা তাঁদের আটকানো হয়। মেয়ের দেহও দেখতে দেওয়া হয় না। কেন? ক্রাইম সিনও সিল হয়নি, বাবা-মাকে দেহ দেখতে দেওয়া হয়নি, মৃত্যুর কারণ বলা হয়নি, তাহলে এই গোটা সময়টায় পুলিশের ভূমিকা কী ছিল?
আরও পড়ুন- ভারতে পর্নোগ্রাফি দেখা, শেয়ার করা কি অপরাধ? কী বলছে দেশের আইন?
ঘটনার দিনের পর, ১৪ অগাস্ট যেদিন মেয়েদের রাত দখলের কর্মসূচি ছিল, সেদিন আরজি কর হাসপাতালে চরম ভাঙচুর চালায় বহিরাগত দুষ্কৃতীরা। সেদিন সারা রাজ্যে এই কর্মসূচি ছিল। সর্বত্র পুলিশ মোতায়েন ছিল। আরজি করের সামনেও পুলিশ ছিল। পাশাপাশি, আরজি কর ক্রাইম স্পট হওয়াতে সেখানে অতিরিক্ত নিরাপত্তা থাকার কথা ছিল। অথচ বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায় বহিরাহত দুষ্কৃতীরা লাঠিসোটা নিয়ে আরজি করে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর করছে। জরুরি বিভাগ তছনছ করে দিচ্ছে, হাসপাতালের ভিতরে আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের ধরনা মঞ্চ তোলপাড় করে দিচ্ছে। অথচ ধারেকাছে কোথাও পুলিশ নেই। আধঘণ্টা প্রায় এই তাণ্ডব চলে। তারপর পুলিশ মাঠে নামে। এই আধঘণ্টা পুলিশ কী করছিল? কোন অনুমতির অপেক্ষা করছিল? পুলিশ কি দুষ্কৃতীদের সময় দিচ্ছিল?
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কারণ পুলিশ নিজেই প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করছে। এত বড় একটি অপরাধের 'টাইমলাইন' কীভাবে গুলিয়ে যেতে পারে পুলিশের? কীভাবেই বা ভাঙচুর করতে দেখেও আধঘণ্টা চুপচাপ হাত গুটিয়ে রইল পুলিশ? পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে কি কোনও বিশেষ নির্দেশ পেয়েছিল কলকাতা পুলিশ? নাহলে যে পুলিশের গোয়েন্দাদের সঙ্গে এককালে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের তুলনা করা হতো, তারা সামান্য ক্রাইম সিন সিল করতে ১৩ ঘণ্টা লাগিয়ে দেয় কোন যুক্তিতে?