কলকাতার গর্ব ট্রাম এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে? মুছে যাচ্ছে যে স্মৃতিগুলো
কোথাও মেট্রোর কাজ চলার জন্য ট্রাম ডিপো বন্ধ করা হয়েছে, আবার কোথাও ঝড়ে উপড়ে পড়া তার ঠিক করা হয় নি বলে ট্রাম চলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
"ট্রাম গাড়ি চলেছে ঘটাং ঘটাং"- 'ভূতের ভবিষ্যৎ' সিনেমার বিপ্লবী গায়ক ভূত পাবলো পত্রনবীশের গাওয়া গান এখনও নেটমাধ্যমে পাওয়া গেলেও গত দু'-তিন বছর বাড়ির সামনের বড় রাস্তায় ট্রামের ঘটাং ঘটাং আওয়াজ শুনতে পাই না। কলিকাতা চলিতেছে নড়িতে নড়িতে- রবীন্দ্রনাথের সেই পংক্তি যেন মূর্ত হয়ে ওঠে ট্রামে। কলকাতার ঐতিহ্যর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ট্রাম। জীবনানন্দের মৃত্যুর মতো মর্মান্তিক ঘটনাও যেমন জড়িয়ে ট্রামের সঙ্গে, তেমনই জড়িয়ে অনেক নস্টালজিয়াও।
ছোটবেলায় আমার সবচেয়ে পছন্দের পরিবহণের মাধ্যম ছিল ট্রাম। তখনও শহরজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে ছিল অসংখ্য ট্রামলাইন । ছোটবেলায় প্রায় প্রত্যেক রবিবার বিকেলে বাবা ট্রামে করে ধর্মতলা অথবা ডালহৌসি নিয়ে যেত, মনে পড়ে। আমরা ট্রাম স্টপেজে দাঁড়িয়ে ১ অথবা ২ নম্বর ট্রামের জন্য অপেক্ষা করতাম। তখনও ট্রামের আলাদা স্টপেজ ছিল, যদিও বাসের জন্যে নির্ধারিত স্টপেজেও ট্রাম দাঁড়াত। ভিক্টোরিয়া আর ময়দানে যে ট্রাম রুট আমরা অসংখ্য সিনেমা এবং বিজ্ঞাপনে দেখি, সেই সবুজ ঘাসে ঢাকা ধর্মতলা-খিদিরপুর রুটের ট্রামে কিন্তু সেই সময়ে আমরা অনেকেই চড়েছি।
ট্রামের চেহারা ছিল মার্কামারা। কাঠের জানলা, হলুদ আলোর বেশি ওয়াটের ধুলোপড়া পুরনো বাল্ব, বড় বড় পাখা আর ড্রাইভারের কেবিনের আলগা হয়ে যাওয়া পাল্লা। একটা সময় কোনও ট্রামেই সেকেন্ড ক্লাসে পাখা ছিল না। ফার্স্ট আর সেকেন্ড ক্লাসের সিট আলাদা ধরনের। অনেকেরই সবচেয়ে পছন্দের সিট ছিল ফার্স্ট ক্লাসের একদম প্রথম একজনের বসার সিট। ওই সিটটা দুটো কারণে পছন্দ ছিল মানুষের। সেই সিটে বসলে ড্রাইভারের কেবিনের ভেতর দেখা যেত, কারণ বেশিরভাগ ট্রামের ড্রাইভার কেবিনের দরজা আটকাতে যে ইট ব্যবহার করত, সেটা ট্রাম চলতে শুরু করার একটু পরেই ঝাঁকুনিতে সরে যেত। ড্রাইভার কীভাবে ট্রাম চালায়, সেটা জানার কৌতূহল অনেকেরই থাকে। আর তাই ওই সিটটাই সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য আদর্শ। আমি প্রথমবার ট্রামে চড়ার বহু বছর পরেও এটা জানতাম না যে, ড্রাইভারের পাশে স্টিয়ারিংয়ের মতো জিনিস কী কাজে লাগে? দ্বিতীয় কারণটা হল, এটা একা বসার সিট, জানলার ধারে, এখানে বসে শহরের দৃশ্য উপভোগ করার আনন্দই ছিল আলাদা।
আরও পড়ুন: বাঙালি ভুলেছে ঢাকাই পরোটার স্বাদ, রইল তার সেরা ঠিকানাগুলো
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ট্রাম অনেকটা বদলাতে শুরু করেছিল। যদিও ট্রামের এই বদল নতুন নয়, কারণ, কলকাতার প্রথম ট্রাম যাত্রী পরিবহণ না, বরং পণ্য পরিবহণ করার জন্য নিজের যাত্রা শুরু করে। ট্রাম সব সময় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়েছে। তাই পুরনো কাঠের জানলা, হলুদ আলো এবং কাঠের চেয়ারের বদলে কাঁচের জানলা, সাদা আলো, আর গদি দেওয়া সিট নিয়ে সে সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে চেয়েছিল। হয়তো রাস্তায় বেড়ে চলা গাড়িকে জায়গা করে দিতেই সে দুই কামরা থেকে এক কামরা নিয়ে চলতে শুরু করেছিল।
আমাদের আশপাশে চলা ট্রামগুলোর বয়স হয়েছে, শহর আর তাদের কথা ভাবছে না। চারপাশে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা ট্রামলাইন উধাও হয়ে গিয়েছে। আমার বাড়ির কাছের দুটো ট্রাম ডিপো বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও মেট্রোর কাজ চলার জন্য ট্রাম ডিপো বন্ধ করা হয়েছে, আবার কোথাও ঝড়ে উপড়ে পড়া তার ঠিক করা হয় নি বলে ট্রাম চলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন পুরো শহরে হাতে গোনা রুটে ট্রাম চলে। অনেক ক্ষেত্রেই অব্যবহৃত অথবা ব্যবহৃত ট্রাম লাইন গাড়ি পার্ক করার জায়গায় পরিণত হয়েছে। ছোটবেলায় প্রায় প্রত্যেক বড় ক্রসিংয়ে যে অসংখ্য পয়েন্টম্যান দেখতাম, আজ তাদের কোনও দরকার নেই।
পরিবেশ বিদ্যার বইতে, "ট্রাম পরিবেশ-বান্ধব পরিবহণ" পড়ে পরীক্ষার খাতায় উত্তর লেখার থেকে বেশি কিছু করি না। হাতে গোনা কিছু মানুষ কলকাতায় ট্রাম নিয়ে লড়ছেন, চেষ্টা করছেন এই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার। তাঁদের লড়াই কত দূর সফল হবে জানা নেই, কিন্তু এই চেষ্টাটুকু দেখলে অন্তত মনে হয়, শহর এখনও জীবিত।