ট্রামই বাঁচিয়ে রেখেছে কলকাতার রাস্তাকে, কীভাবে বাঁচবে এই ঐতিহ্য

যে ৫ নং ট্রাম উত্তর কলকাতার বুক চিরে রাজার মতো বিধান সরণীর পথ দিয়ে এগিয়ে যেত, আজ সেই বিধান সরণী বড্ড শূন‍্য মনে হয় ট্রাম ছাড়া।

কলকাতা শহরকে যে যে কারণে আমরা মহানগরী বলি, তার মধ্যে একটা কারণ অবশ্যই ট্রাম। কিন্তু এই ট্রাম আজ ব্রাত্য। মেরেকেটে দুটো লাইন কেবল বরাদ্দ রয়েছে ট্রামের জন্য। এই দুটোই বা কতদিন টিকে থাকবে, তাও বলা যাচ্ছে না। যে ৫ নং ট্রাম উত্তর কলকাতার বুক চিরে রাজার মতো বিধান সরণীর পথ দিয়ে এগিয়ে যেত, আজ সেই বিধান সরণী বড্ড শূন‍্য মনে হয় ট্রাম ছাড়া। এই মুহূর্তে রুট বলতে দু'টি, এক হলো ২৫ নং, যার চলাচল এসপ্ল্যানেড থেকে গড়িয়াহাট ডিপো পর্যন্ত, আরেকটি হলো ২৪/২৯, যার যাওয়া আসা বালিগঞ্জ থেকে টালিগঞ্জ ডিপো অবধি। এই দুই রুট আমাদের ট্রামলাইনগুলোর শেষ প্রদীপে সলতে দিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন।

কলকাতার গ্রেডের হেরিটেজের তালিকায় যেভাবে পুরনো বাড়িগুলোর সংযোজন হচ্ছে একটা একটা করে, তেমনভাবেই ট্রামডিপোর ভেতর পুরনো ট্রামগুলোও গ্যারাজ হয়ে যাচ্ছে একে একে। বহু পুরনো কাঠের ট্রাম, ব্রিটিশ আমলের উন্নতমানের ট্রামের পার্টস ডিপোর মধ্যে থাকতে থাকতে কোথায় এদের অস্তিত্ব উধাও হয়ে যাচ্ছে, টের পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু কোনওরকমে জোড়াতালি দিয়ে কয়েকটা ট্রাম চালানো হচ্ছে নামরক্ষার্থে। ফলে, ট্রাম দুর্ঘটনাও হয় বেশি। কলকাতার পুরনো বাড়িগুলোর মতোই ট্রামকেও আমরা আজ 'হেরিটেজ' বলি।

কিন্তু এমনটা তো আগে ছিল না। ইতিহাস বলছে, কলকাতায় প্রথম ট্রাম পরিষেবা শুরু হয় ঘোড়ায় টানা ট্রামের মাধ্যমে, ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। যাত্রাপথ ছিল শিয়ালদহ আর আর্মেনিয়ান স্ট্রিটের মাঝে। তবে এক বছরের মাথাতেই এই পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়। সেসময় লর্ড কার্জন কলকাতার ট্রামকে ব্যায়সুলভ করে তুলতে চেয়েছিলেন জনসাধারণের সুবিধার্থে, এই উদ্দেশ্যেই পুনরায় ট্রামের যাত্রাপথ উদ্ভোধন করেন ১৮৮০ সালের ১ নভেম্বর। এই সময় ট্রাম কোম্পানি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায় ট্রামের ওপর। এমনকী, ঘোড়ায় টানা ট্রামের পাশাপাশি মানুষে টানা ট্রামের পরীক্ষাও চালিয়েছিল ট্রাম কোম্পানি! তবে ব্রিটিশরাজের অধীনে থাকা সেকালের কলকাতায় বিলিতি বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের সাফল্য দেখেই ১৮৮২ সালের শেষের দিকে ট্রাম কোম্পানি ১৯ মাইল ট্রাম লাইন দাঁড় করানোর কাজ শুরু করে।

আরও পড়ুন: কলকাতার গর্ব ট্রাম এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে? মুছে যাচ্ছে যে স্মৃতিগুলো

এরপর ১৯০২ সালে আসে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যখন বৈদ্যুতিক ট্রাম চালানোর সূত্র ধরে বিদ্যুতায়ন ঘটে কলকাতার। ট্রাম হয়ে ওঠে মহানগরীর আলোকমাধ্যম। এই ঘোড়ায় টানা ট্রাম আর বৈদ্যুতিক ট্রামের মাঝে খুব অল্প সময়ের জন্য কলকাতায় কলের ট্রামও চালু হয়েছিল বলে শোনা যায়। এই সময় থেকেই নগরের পথে নিত্যযাপনের অঙ্গ হয়ে ওঠে ট্রাম। অফিসযাত্রী থেকে স্কুলপড়ুয়া- প্রত্যেকের গন্তব্যেরই সময়সূচির হিসেব বাঁধা থাকত ট্রামের কাছে। যে কারণে এর পরবর্তীকালে ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ মালিকানাধীন কলকাতায় ট্রাম কোম্পানি মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের ভাড়া এক পয়সা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-সহ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির অসংখ্য মানুষ পথে নামেন আন্দোলনে। যদিও সেসময় ট্রামের ভাড়া বিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় অনেকটাই কম ছিল, কিন্তু কলকাতার নগরবাসীদের কাছে ট্রাম এতটাই অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল যে, ট্রামের এক পয়সা ভাড়া বাড়ানোর এই পরিকল্পনা ক্রমে এক বিস্তর ট্রাম আন্দোলনে পরিণত হয়, যার ফলশ্রুতিতে বিংশ শতাব্দীর শেষের পর্যায়ে ট্রাম চলাচল এত বহুল বিস্তৃতি লাভ করে বিভিন্ন রুটে।

তবে কলকাতা ক্রমশ সরকারি তরফে উন্নয়নের কবজায় যত পড়তে লাগল, ট্রামের অবনতি তত দ্রুত ঘটল শহরে। আজ অনেকেই বলেন, মেট্রো সিটিতে ট্রামের গুরুত্ব কীসের? সকলেই চান তাড়াতাড়ি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে, সেখানে ট্রামের ভূমিকা কী? ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, ছয়ের দশকের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সময় থেকেই সরকারি তরফে ট্রামকে তুলে নেওয়ার কাজ শুরু হয়। যেহেতু স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ভারতের যে যে শহরে ট্রাম চলত, তার সবক'টি জায়গাতেই ট্রাম চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাই কলকাতাতেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ট্রাম চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার।

প্রথমেই প্রফুল্লচন্দ্র সেন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এসে হাওড়া থেকে ট্রামের পরিষেবা তুলে দেন। যদিও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন আবার ট্রাম পরিষেবা বৃদ্ধি পায় বিপুলভাবে, এমনকী, কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে জোকা পর্যন্ত ট্রামের লাইন বিস্তৃত হয়। কিন্তু তৎকালীন সরকারের আমলেই একাধিকবার নানা ট্রাম রুট তুলে দেওয়ার প্রস্তাব আসতে থাকে। এরপর কলকাতায় মেট্রো চলাচল শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে ট্রামের গুরুত্ব আরও কমতে থাকে।

কলকাতা এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর হিসেবে পরিগণিত হয়েছে সরকারি সমীক্ষাতেই। সেদিক থেকে দেখতে গেলে কলকাতায় ট্রাম ছাড়া পরিবেশবান্ধব জনপরিবহণ আর কিছুই নেই। পাশাপাশি ট্রাম চলে তার রুটে, ট্রামের সঙ্গে অন্য কোনো যানবাহনের কোনও সমস্যা থাকে না। আমরা ভাবি, ট্রামের জন্যই যানজট সৃষ্টি হয় কলকাতায়, কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে বহু নিজস্ব গাড়ি, বাস, অটো সব একই রাস্তায় একসঙ্গে আগে এগিয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে প্রত্যেকেই ট্রাফিকের মুখে পড়ে দাঁড়িয়ে থাকে যখন, তখন ট্রাম তার মতো করে, তার নিজের লাইন বরাবর এগোতে থাকে গন্তব্যের দিকে। আজও বহু প্রবীণ ব্যক্তি এবং স্কুলপড়ুয়ারা ট্রামে যাতায়াত করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। শুধু তাই নয়, এই প্রজন্মের বহু ছেলে-মেয়েদের কাছে ট্রাম আজও বিস্ময়। এই সমস্ত কারণকে মাথায় রেখেই বহু মানুষের স্বার্থে ক্যালকাটা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশন Calcutta Tram Users Association (CTUA) নামক একটি বেসরকারি দল সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে এবং প্রচেষ্টায় কলকাতার রাজপথে ট্রামকে স্বমহিমায় পুণপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বিবিধ কর্মশালার আয়োজন করে চলেছে সারা বছর ধরে। আগামী বছর কলকাতার ট্রাম সার্ধশতবর্ষ পূর্ণ করবে। সেই দিনকে মাথায় রেখে চলতি বছরে নানান কর্মকাণ্ডের আয়োজন করবেন এই দলের উদ্যোক্তারা। আর এই সমস্ত মহড়ার লক্ষ্য একটাই, বন্ধ ট্রাম রুটগুলো আবার চালু করা।

যে শহর স্মৃতি নিয়ে বাঁচে প্রতিদিন, তারও মৃত্যু হয় কোনও এক গভীর রাতে আবছা ট্রামলাইনের মাঝে, কবি লিখে যান,

অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম-বাস সব ঠিক চলে;

তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হ’য়ে চ’লে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে।

 

More Articles