চাটের দোকানের বয় থেকে সার্কাসের জোকার, তুলসী চক্রবর্তীকে কি ভুলেই গেল বাঙালি
ক্ষয় তাঁকে ছুঁতে পারেনি, পারবেও না কোনও দিন। অন্তত যতদিন বাংলা সিনেমা নিয়ে চর্চা বেঁচে থাকবে।
বিশ শতকের গোড়ার দিক। চিৎপুরের একটা চাটের দোকানে ভিড় বেশ লেগেই থাকে। শুঁড়িখানা থেকে বোতল সমেত বাবুরা এসে ভিড় জমান। হৈ হুল্লোড় আমোদ আড্ডা আদিরসাত্মক রঙ্গরসিকতা। গোটা এলাকা খোশবুতে ভুরভুর করে। চাট বলতে ঠিক অধুনা পাপড়ি দিয়ে ঘুগনির চাট নয়, রাজকীয় সব ঝালঝোল খাবার। কষা মাংস, তায় পাঁঠার ভুড়ি-চচ্চড়ি, পাঁঠার ঘুগনি, বেশ ঝাল করে কাঁকড়া ভাজা ইত্যাদি নানারকম ব্যাপার স্যাপার। মদের সঙ্গে যা সব জমে আর কি! দুপুর থেকেই রান্না। বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধে নামে নামে তখন এক দুজন করে খদ্দের আসা শুরু হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে ভরে ওঠে দোকান। বাবুরা আসেন, বাবুরা হাসেন, বাবুরা খান। ফেলেন ছড়ান বিস্তর এঁটো। সেইসব এঁটো তুলে নিয়ে যায় একটি ছেলে। এঁটোকাঁটা একদিকে ফেলে বাসন মাজতে শুরু করে। কাজ প্রচুর। গুলতানির তেমন সময় নেই। এদিকে মাতালদের অত্যাচারও কম না। মদের পরিমাণ কিঞ্চিৎ বেশি হলে হড়হড় করে বেঞ্চে, থালার ওপর…বমি নয়, সে সাক্ষাৎ বমন। সে সব থালা বাসন তুলে আনা, খাটনি উপরি। অথচ তেমন মজুরি নেই। কী আর করা! বাপ মা মরা ছেলে, একটা কিছু করে তো নিজের পায়ে দাঁড়ানো দরকার। এমনই এক মাতাল সন্ধেয় ছেলেটি বাসন মাজছে, হঠাৎ তার নজরে পড়ল, হন্তদন্ত হয়ে একটি লোক এদিকেই আসছেন। এই রে! এ যে জ্যাঠামশাই। কেউ নিঘ্ঘাত ভাঙানি দিয়েছে। পালাবার খুব একটা সুযোগ পায় না সে। চুল ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে এলেন জ্যাঠামশাই। "ব্যাটা স্বাবলম্বী হতে চাইছ? আর কোনও কাজ পেলে না! বামুনের ছেলে হয়ে মোদো-মাতালের এঁটো ধোবার কাজ করতে এসেছ?" বলে মাথার ওপর এক রাম গাঁট্টা। এঁটো ধোওয়ার কাজে জ্যাঠামশাইয়ের বামনাইয়ে আঘাত লেগেছিল বটে, কিন্তু ছেলেটির 'বামনাই' তিনি খুব একটা জাগ্রত করতে পারেননি। কেন? তা পরে বলছি। আগে ছেলেটির পরিচয় দিই।
অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী। আজ্ঞে হ্যাঁ। অভিনয়ের পথে আসা তাঁর পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়সে। তার আগেই বহু ঘাটের জল তিনি খেয়ে ফেলেছেন। পুজো আচ্চা কোনোদিন করেননি। মুখ দিয়ে একবর্ণও সংস্কৃত বেরোত না। বরং 'ম্লেচ্ছ'দের সঙ্গে মিশে ম্লেচ্ছভাষা শিখেছিলেন খুব ভালো করে। এক পৈতেটি মাজতেন, তাও অভ্যেস বশে। এ ছাড়া জীবনে বামনাই খুব একটা শিখে উঠতে পারেননি। 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবি করার সময় পরিচালক নির্মলবাবু নাকি তুলসী চক্রবর্তীকে বলে দিয়েছিলেন, বাড়িতে যা যা করেন ঠিক তেমনটি করবেন। অর্থাৎ বাড়ি ফিরে যে যাবতীয় টুকটাক কাজকর্ম আমরা ছবিতে দেখি, তা তুলসী চক্রবর্তীর নিজস্ব ইম্প্রোভাইজেশন। এর কোনও নির্দেশনাই ছিল না। 'অজ্ঞনগড়' ছবিতে ট্রাক ড্রাইভারের পাশে বসে যাচ্ছেন। একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছে। ট্রাক থামতেই চমকে উঠলেন। এরও নির্দেশনা বিমল রায় দেননি। সম্পূর্ণ নিজের সংযোজন। কাজেই সৌমিত্র যখন বলেন, "সিনেমায় মোটামুটি তিরিশ বছর এবং তার আগে বারো বছর থিয়েটারে, অর্থাৎ বিয়াল্লিশ বছর তাঁর পেশাদার অভিনেতার জীবন। আমার তো মনে হয় না এই দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছরে তাঁর অভিনয়ে এমন একটিও নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যাবে যেখানে তিনি সুঅভিনয় করেননি। ক'জন এরকম অভিনেতা পাওয়া যাবে যাঁর সম্বন্ধে এমন কথা বলা যায়?" তিনি খুব একটা বাড়িয়ে বলেন না। এক ছবি বিশ্বাস বা কানু বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া তুলসী চক্রবর্তীর ধারেকাছে আর কেউ আসেন না। এমনকি ভানু-জহরও নয়। ভানু-জহর যথেষ্ট শিক্ষিত অভিনেতা। প্রচুর বিদেশি ছবি দেখেছেন, পড়াশোনাও যথেষ্ট। সেদিক তুলসী চক্রবর্তী চূড়ান্ত আনপ্রিভিলেজড। মানুষের দৌড় তার শুরুর বিন্দু থেকেই মাপাটা আবশ্যক। তারপরেও নিজেকে বাংলা ছবির জগতে 'ইরিপ্লেসেবল' জাতীয় জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন তিনি।
চুল ধরে টেনে আনার ঘটনা শুনে রবি বসু একটু অবিশ্বাসের চোখে তুলসী চক্রবর্তীর মাথার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। টাকে হাত বুলোতে বুলোতে তুলসী চক্রবর্তী হেসে বলেছিলেন, "কী, কথাটা বিশ্বাস হল না?"
—কোন কথাটা?
—ঐ যে জ্যাঠামশাই আমার মাথার চুল ধরে টেনে নিয়ে গেলেন! তা আজ বিরাট টাক দেখে সে কথা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু চিরকাল তো আর আমার মাথায় এমন ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী টাক ছিল না। আমার মাথায় এক সময় ঘন চুল ছিল গো! আর ঘন বলে চিরুনি চালানো যেত না। কত চিরুনি যে ভেঙেছে চুল আঁচড়াতে গিয়ে।
চুলের শোক সামলাতে গিয়ে রবি বলে বসলেন, "মানুষ তো আর টাক নিয়ে মায়ের পেট থেকে জন্মায় না। ওটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পড়ে।" তুলসী চক্রবর্তী সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি করে বললেন, "কে বলে জন্মায় না। কত বাচ্চার মাথায় দেখবে জন্মের সময় একগাছি চুলও নেই। পরে অবশ্য চুল গজায়।" বেগতিক দেখে প্রসঙ্গ পাল্টে একরকম পালিয়েই বেঁচেছিলেন রবি। তুলসী চক্রবর্তীর উপস্থিত বুদ্ধি ছিল সাংঘাতিক। তা বোঝা যেত তাঁর রসবোধে।
যাই হোক, সেই এককালীন চুলই জ্যাঠামশাইকে ভাইপোকে হিড়হিড় করে ঘরে টেনে আনতে সুবিধা করে দিয়েছিল। কিন্তু ঘর কী? কেবল চারটে দেওয়াল? যে ঘরে ঘরের মানুষ থাকে না, পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সুবিধেও তেমন নেই পরিচয়ের অভাবে, সে ঘরে লোকের মন টিকবে কেন? তুলসী চক্রবর্তীর জন্ম ১৮৯৯ সালে। বাবা ছিলেন রেলের চাকুরে। আজ এখানে বদলি, কাল ওখানে। অল্পবয়সে পিতৃবিয়োগের পর জ্যাঠামশাইয়ের আশ্রয়ে। তুলসী চক্কোত্তির জ্যাঠামশাই যে সে লোক ছিলেন না। প্রসাদ চক্রবর্তীর সে আমলে বেশ নামডাক ছিল। গান, নাচ, অভিনয় এমন কোনো বিদ্যে ছিল না, যা প্রসাদ চক্কোত্তি জানতেন না। কিন্তু মানুষটা ঐ নিয়েই পড়ে থাকতেন। অর্কেস্ট্রা পার্টি আর 'কেলাব', মানে অ্যামেচার ক্লাব। এই ছিল জ্যাঠামশাইয়ের ধ্যান জ্ঞান লক্ষ্য।
কলকাতার বড়লোক বাড়ির পুজো-আচ্চায় ঐ দল গান করতে যেত, মোটা টাকার বায়না পেলে দূর-দূরান্তেও যেত অনুষ্ঠান করতে। ফলে ঘরটা ঠিক ঘর হয়ে ওঠেনি কখনও কিশোর তুলসীর কাছে। যৌবনের দোরগোড়ায় এসে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা তাগিদ এল। কেউ বলে দেয়নি। তবু বসে বসে কদ্দিন জ্যাঠামশাইয়ের আয়ে খাবেন! আত্মসম্মানে বাধছে তখন। তাই চাটের দোকানের বয়। সেখান থেকে তাড়া খেয়ে ঘরে ফিরলেন বটে। কিন্তু ঘর তাঁকে বাঁধতে পারল না। এবার ঘর ছেড়ে পালালেন বার্মা মুলুকে। ব্রিটিশ আমলে বার্মায় যেতে পাসপোর্ট ভিসা—কিছুই লাগত না। এক দঙ্গল লোক, তায় হাতী, ঘোড়া, বাঘ, সিংহের সঙ্গে জাহাজে চেপে বসলেন। বোসেস সার্কাস। বাঙালি মালিক, কিন্তু বেশিরভাগই 'আপ-কান্ট্রির' লোক। জাতপাতের বালাই ছিল না। হিন্দু-মুসলমান সাবর্ণ-দলিত সব একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া, থাকা, আর দিনরাত খাটুনি। সেই সার্কাসের দলে ছিলেন বেশ কিছু দিন। জোকার সাজতেন। ট্রাপিজ আর রিং মাস্টারের খেলা ছাড়া প্রায় সব খেলাই শিখে নিয়েছিলেন। সেই সার্কাসেই হিন্দি আর চোস্ত উর্দু বলতে শিখেছিলেন, পরবর্তীতে নিউ থিয়েটার্সের ছবি করার সময় এ বিদ্যে খুব কাজে লেগেছিল। তারপর তুলসী চক্রবর্তীর নিজের ভাষায়, "একদিন দেখলাম আমার নিজের শরীর থেকে জন্ত-জানোয়ারের গন্ধ বেরোচ্ছে, সেদিন কাউকে কিছু না বলে চম্পট দিলাম।"
চম্পট আর দেবেন কোথায়! ফিরলেন দেশেই। জ্যাঠামশাইয়ের সাধের দলটি তখন ছত্রাখান। স্টার থিয়েটারে যোগ দিয়েছেন প্রসাদ চক্কোত্তি। ভাইপোর উড়ু উড়ু স্বভাব তাঁর খুব একটা সুবিধের ঠেকছিল না। তাই ঘরে ফিরতে তাঁকে একরকম বগলদাবা করেই নিয়ে গেলেন চিৎপুরের একটি ছাপাখানায়। ভর্তি করে দিয়ে এলেন। বার্মা মুলুকের সার্কাসের জোকার কম্পোজিটরি করার জন্য টাইপের ঘর শিখতে শুরু করলেন। ছোটবেলা থেকেই জ্যাঠামশাইয়ের কাছে গান শিখেছেন। নাচ, অভিনয় সবটাই পারতেন। তবে অভিনয়ে নামার কথা কখনও মাথায় আসেনি। কিন্তু প্রেসের কাজ করতে গিয়ে যেটা হল, রোজ থিয়েটারপাড়ার বড়ো বড়ো পোস্টার, রোজ হ্যান্ডবিল—"আসুন। দেখুন! উন্মুক্ত মঞ্চের উপর শিবের জটাজাল হইতে গঙ্গার আগমন!" অথবা "মঞ্চের উপর জীবন্ত অশ্বপৃষ্ঠে নায়কের প্রবেশ!", "শূন্যমার্গে দানবের যুদ্ধ"; এইসব দেখতে দেখতে ক্রমে তুলসী চক্রবর্তীর অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছেটা চাগিয়ে উঠল। প্রাথমিক আকর্ষণ ছিল সেই পোস্টারে ছাপা নাম, ছবি। নিজের নাম থাকবে ছাপার অক্ষরে —এই ছিল সাধ। কিন্তু হতভাগ্য অভিনেতা এ পেশা বেছে নেওয়ার সময় জানতে পারেননি, এক 'পরশপাথর' ছাড়া তাঁর এই শখ সারা জীবনে পূরণ হবে না। 'পরশপাথর' বেরোনোর পর তাই খানিকটা হতবুদ্ধির মতো হয়ে গিয়েছিলেন। একটা ঘোর। চারিদিকে নিজের নাম! নিজের ছবি! এ কি বিশ্বাসযোগ্য! যোগ্যতার কী করুন পরিণতি! রবি বসুকে ডেকে প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করতেন, "ব্যাপারটা কী হল বল দিকি! আমাকে নায়ক বানিয়ে ছবি হচ্ছে, এ তো আমি ভাবতেই পারছি না! তাও সত্যজিৎ রায়ের মতন মানুষের ছবিতে। তবে হ্যাঁ, ওই মানুষটা নাটককে বড় ভালোবাসে গো। কবে কোন কোন নাটকে আমি কী কী মজার পার্ট করেছি, সব স্পষ্ট মনে আছে।" পাগলপ্রায় অবস্থা। এত বড় হোর্ডিংয়ে জীবনে নিজের মুখ দেখেননি। ছাপাখানায় দেখা সেই স্বপ্ন কোনো দিন পূরণ হবে, তাই ভাবেননি। বলতেন, "এ আমি কী হনু রে!" আবার সত্যজিৎ রায়ের উদ্দেশ্যে কপালে নমস্কার করে বলতেন, "মানুষটা কী রকম রসিক দেখেছ! আমার টাক ফাটিয়ে আধখানা করে তার মধ্যে থেকে রস বের করেছেন! আবার লিখেছেন 'আহ্লাদে আটখানা'।" লজ্জা করে না বাঙালি হিসেবে? বাংলা নাটক, ছবির দর্শক হিসেবে?
পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়েসি সেই যুবক ছাপাখানার কাজের মাঝে জ্যাঠামশাইয়ের জন্য খাবার নিয়ে যেতেন। উইংসের পিছনে দাঁড়িয়ে অভিনয় দেখার সুযোগ জুটত। দানীবাবুর অভিনয় তাঁর এ পেশা বেছে নেওয়ার ঝোঁক আরো পোক্ত করেছিল। গিরিশপুত্র দানীবাবুর সুকণ্ঠ ছিল সর্বজনবিদিত। শিশির ভাদুড়ী একবার সৌমিত্রকে বলেছিলেন, দানীবাবুর গলা আগে কর্কশ ছিল, গাঁজা টাঁজা খেতেন তো। কিন্তু চর্চার মধ্যে দিয়ে নিজের গলা উনি ঐ জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই দানীবাবুর অভিনয় দেখে যুবক তুলসী চক্রবর্তী মুগ্ধ। জ্যাঠামশাইকে বললেন, অভিনয়ে নামতে চান। এই কথায় জ্যাঠামশাই একবারেই রাজি হয়ে গেলেন। ভাইপোর অভিনয়টা ভালোই আসে। তাছাড়া চোখের সামনে থাকবে সারাক্ষণ। অপরেশচন্দ্রের কাছে কাকুতিমিনতি করে স্টার থিয়েটারে ঢুকিয়ে দিলেন তুলসী চক্কোত্তিকে। ১৯২০ নাগাদ সেই 'দুর্গেশনন্দিনী'-তে মুখ দেখাবার সুযোগ। বারো বছর পর প্রথম রূপোলি পর্দায়, 'পুনর্জন্ম' মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩২-এ। এরপরের ঘটনা বহুচর্চিত। অনেকেই জানেন। কাজেই সে দিকে যাব না। আরো এক দুটো মজার ঘটনা বলে আড্ডা শেষ করব।
জহর গাঙ্গুলীকে স্টারে এনেছিলেন তুলসী চক্কোত্তিই। একরকম অপরেশের হাতে পায়ে ধরে। সেই ঋণ জীবনে ভুলতে পারেননি জহর। কালের ফেরে জহর হয়ে উঠলেন নায়ক, কিন্তু চক্কোত্তি সেই নায়ক অথবা নায়িকার চকারের অভিনয় করেই কাটালেন মঞ্চে। এর জন্য জহর দুঃখ করতেন খুব। অবশ্য সিনেমাতে বেশ কয়েকটি ভালো চরিত্র পেয়েছিলেন মানুষটা, কিন্তু সে আর কতটুকু। বলতেন, "আমি যে সব রোল পেতাম সেগুলোকে ক্যারেক্টার বললে তো ক্যারেক্টারেরই অপমান করা হয়…সিনেমায় বেশ কিছু ভালো রোল পেয়েছি। কিন্তু তার সংখ্যা কত সে হিসেবটা করেছ কখনও? এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচশোর ওপর ছবিতে কাজ করেছি, কিন্তু তার মধ্যে কটা ছবিতে কাজ করে আনন্দ পেয়েছি, সেটা তো হাতে গুনেই বলে যায়।" রূঢ় বাস্তব। যে মর্যাদা পাওয়া উচিত ছিল বাংলা তাঁকে সে মর্যাদা দিতে পারেনি কোনো দিন। তবে তা বাঙালির অক্ষমতা। তুলসী চক্রবর্তী নিজের সেরাটাই দিয়েছেন যে কোনও চরিত্রে। যে কথা হচ্ছিল, জহর আর চক্কোত্তির বন্ধুত্ব ছিল বেশ মজার। 'মনোময়ী গার্লস স্কুল' নাটক চলছে। হাস্যরসের নাটক। চক্কোত্তি দামোদরের চরিত্রে, এক 'স্ত্রৈণ' জমিদার। জমিয়ে দিয়েছেন। জহর নায়ক হয়েও পাত্তা পাচ্ছেন না। একদিন চক্কোত্তিকে কিঞ্চিৎ বিপাকে ফেলার জন্য জহর খানিক এক্সটেম্পো দিলেন। এক্সটেম্পো অর্থে নাটকের নির্দেশনা বা স্ক্রিপ্ট যথাযথ অনুসরণ না করে খানিক নিজস্ব মোচড় দেওয়া। খুব দক্ষ অভিনেতা না হলে এ জিনিস সামাল দিতে পারতেন না।
তবে দর্শক হাততালিতে ফেটে পড়ত। খানিকটা অভিনেতাদের ডুয়েল বলা যায় ব্যাপারটাকে। তবে নাট্যমঞ্চে। দেখার বিষয় কে কত ভালো সামাল দিতে পারছেন। নাটকে মানস আর নীহারিকা চাকরির খাতিরে স্বামী-স্ত্রী সেজে থাকে। কিন্তু তাদের মধ্যে তেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নেই। বরং তর্ক বিতর্কই বেশি। সেদিনও তেমন মারমারকাটকাট চলছে। হঠাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে জমিদারের প্রবেশ। নীহারিকা সপ্তম থেকে সোজা গদগদ, সুখী দম্পতি ব্যাপারটা ঠিকঠাক দেখানো দরকার। কাজেই সে মানসকে প্রশ্ন করবে, "হ্যাঁ গা, আজ বেগুন কত করে সের নিয়েছে গো?" উত্তরে মানস বলবে, "বেগুন সের চার পয়সা।" আদতে সে বাজারেই যায় না। বেগুনের দাম সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই। কাজেই যা মাথায় আসে, তাই বলে। কিন্তু বলতে গিয়ে পড়ে বিপদে। জমিদার বলেন, "সে কী! যে বেগুনের দাম এক পয়সা সের, সেটা তোমার কাছ থেকে চার পয়সা নিয়েছে। আমারই বসানো বাজারে এতবড় জোচ্চুরি। চলো তো সেই বেগুনওয়ালার কাছে।" তখন কলকাতার বাজারে বেগুন চোদ্দ আনা দর যাচ্ছে। কাগজে তাই নিয়ে লেখালেখিও চলছে। নাটকে জহর ডায়লগ বলতে গিয়ে ফট করে এক্সটেম্পো দিয়ে বললেন, "বেগুন সের চোদ্দ আনা!" দর্শক হাসিতে হাততালিতে ফেটে পড়ল। চক্কোত্তি এতটুকু না ঘাবড়ে বললেন, "সে কী! যে বেগুনের দাম চোদ্দ পয়সা সের, সেটা তোমার কাছ থেকে চোদ্দ আনা নিয়েছে। আমারই বসানো বাজারে এতবড় জোচ্চুরি। চলো তো সেই বেগুনওয়ালার কাছে।" বলে জহরের হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে স্টেজের বাইরে। স্ক্রিপ্টে আরও ডায়লগ ছিল। এই টেনে নিয়ে যাওয়া ছিল না। কিন্তু চক্কোত্তি জহরের এক্সটেম্পোর উপরে আরেক কাঠি এক্সটেম্পো দিয়ে সামাল দিলেন। দর্শক আবারও হাততালিতে ফেটে পড়ল। সেইদিন নাক-কান মুলেছিলেন জহর, "চক্কোত্তি, আর কোনওদিন তোর সঙ্গে টক্কর দিতে যাব না।"
'ভাবীকাল' সে বছর শ্রেষ্ঠ ছবির মর্যাদা পেয়েছে। বি এফ জে এ পুরস্কার। এদিকে তুলসী চক্রবর্তী সব জায়গায় বলে বেড়ান,
"ওরে বাবা, আমি আবার অভিনেতা হলাম কবে! নিজের যা বিদ্যেবুদ্ধি তাতে তো অন্যকিছু করে অন্ন জুটবে না। তাই পেটের দায়ে থিয়েটার বাইশকোপে পেছন নাচাই। একে কি অভিনয় বলে নাকি!…আমি হলাম গিয়ে হেঁসেলবাড়ির হলুদের মতো। ঝালে-ঝোলে-অম্বলে সবেতেই আছি। হাসতে বলো হাসব, কাঁদতে বলো কাঁদব, নাচতে বলো নাচব, দু'কলি গান গেয়ে দিতে বলো, তাও পারব। হলুদ যেমন সব ব্যঞ্জনেই থাকে তেমনি আর কি! কিন্তু হলুদের কি নিজের কোনো সোয়াদ আছে? তাই এগুলোক আমি অভিনয় বলি না ভাই। হ্যাঁ, অভিনেতা ছিলেন বটে আমার গুরু অপরেশ মুখুজ্যে।"
এইসব শুনে রবি বসু রাগ করতেন। 'ভাবীকাল'-এর সেই জটিল চরিত্র ফুটিয়ে তোলা কি ছেলেখেলা? আর বাজারে নিজের নামে এইসব বলে বেড়াচ্ছেন তুলসীবাবু। উত্তরে তুলসী চক্কোত্তি যা বলেছিলেন তা ইতিহাস হয়ে রয়েছে। সৌমিত্র অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফীর দর্শনের সঙ্গে সেই দর্শনের মিল পেয়েছেন। বহু অভিনেতা সেই কথাটি থেকে শিখেছেন বিস্তর। তুলসী চক্রবর্তী বলেছিলেন, "ওই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করবার জন্যে তো ভালো অভিনেতা হওয়ার দরকার হয় না। তুমি যে সমাজে বসবাস কর, একটু চোখকান খোলা রেখে যদি সেই সমাজের মানুষগুলোকে দেখ, তাহলে তুমিও ওইরকম অভিনয় করতে পারবে। চোখের সামনেই তো দেখলাম কত মানুষের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেল। যত ছিল বেনাবুনে, সব হয়ে গেল কীত্তুনে। এককালে বড় বড় আদর্শের কথা বলত, পরে ক্ষমতা পেয়ে তারা আর মানুষকে মানুষ জ্ঞান করছে না। এ তো অহরহ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ভাই। তাদেরই একজনের ধাঁচে 'ভাবীকাল' ছবির ওই চরিত্রটা করেছিলাম। ওতে আমার কোনো ক্রেডিট নেই।"
কী আর কথা বলা চলে এই কথার উপরে। সারাজীবনে যিনি কখনও বাজে অভিনয় করেননি, যাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন সত্যজিৎ থেকে তরুণ মজুমদার, উত্তম থেকে সৌমিত্র, ভানু, জহর—তিনি নিজের সেই অতি স্বাভাবিক অনবদ্য অভিনয়ের বাহবা বিন্দুমাত্র নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। দুঃখ ছিল খুব বেশি পছন্দসই চরিত্রে অভিনয় করতে পারলেন না। এটুকুই। খালি উর্দ্ধাঙ্গ, খাটো ধুতি পরে দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে তামাক খাচ্ছেন, একটা জীর্ণ ফতুয়া পরে বাজার করতে যাচ্ছেন, মাছওয়ালা, সবজিওয়ালার সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা—কে বলবে তিনি রঙিন জগতের মানুষ। অর্থকষ্ট তাঁর ছিল, ছিল না উপযুক্ত সম্মান, কাজের সুযোগ, পূরণ না হওয়া হাজারো স্বপ্নের ঢের—নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালির যেমনটা থাকে আর কি! বুকে হয়তো চাপা কষ্ট বা আক্ষেপ থাকতে পারে তাই নিয়ে। কাউকে বলেননি কোনো দিনই। তবে যে গ্ল্যামারের ফাঁদে পড়ে সাধারণ জীবনযাপন না করতে পারার যন্ত্রণায় উত্তম ছটফট করেছেন, রূপোলি পর্দার পিছনে পরিচিতির যে ভার অভিনেতাদের ব্যক্তিগত জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছে, সেইখানে জিতে গিয়েছেন তুলসী চক্রবর্তী। রাজার মতো ঢিলেঢোলা জীবন কাটিয়েছেন। অনাদরের তোয়াক্কা করেননি, গ্ল্যামার তাঁকে ছুঁতে পারেনি, রাজার মতো এসেছিলেন রঙ্গমঞ্চে। মাথা উঁচু করে রাজার মতোই চলে গিয়েছেন। চাটের দোকানের বয় থেকে সার্কাস, সার্কাস থেকে ছাপাখানা হয়ে অভিনয়ের পথে যাঁর আসা, তিনি বিয়াল্লিশ বছরে বাংলা অভিনয়ের জগতে এতখানি পাকাপোক্ত শিকড় ছড়িয়ে গিয়েছিলেন, যে মূল গাছ উপড়ে যাওয়ার পরেও সেই শূন্যস্থান মাটি, নতুন গাছ, আগাছা—কিছু দিয়েই আর পূরণ করা যায়নি। বরং সেই অভিনয়ের ছাপ প্রজন্মের পর প্রজন্ম অভিনেতাদের অভিনয়ে রয়ে গিয়েছে। একটিও খারাপ অভিনয় না করে, বাঙালির অনাদরকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে, নিজের অভিনয়ের আভিজাত্য নিয়ে চলে গিয়েছেন তুলসী চক্রবর্তী। রাজার মতোই। ক্ষয় তাঁকে ছুঁতে পারেনি, পারবেও না কোনও দিন। অন্তত যতদিন বাংলা সিনেমা নিয়ে চর্চা বেঁচে থাকবে।