কাকে বলে টু ফিঙ্গার টেস্ট? ধর্ষণের প্রমাণে কতটা যুক্তিসম্মত এই পরীক্ষা
Two Finger Test: টু ফিঙ্গার টেস্টে কোনও মহিলার যোনিতে দু'টি আঙুল ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয়, মহিলা ধর্ষিতা হয়েছেন কি না।
২০১৩ সালের মে মাসেই নিষিদ্ধ হয়েছিল টু ফিঙ্গার টেস্ট। কিন্তু তারপরেও ধর্ষিতার শরীরে ধর্ষণের প্রমাণ খুঁজতে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে জারি ছিল এই পরীক্ষা। গত ৩১ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট আবারও মুখ খুলল 'টু ফিঙ্গার' টেস্ট নিয়ে। জানানো হলো, টু ফিঙ্গার টেস্ট কেবল পিতৃতান্ত্রিক একটি পদ্ধতিমাত্র নয়, এটি একেবারেই বিজ্ঞানসম্মতও নয়। শুধু তাই নয়, এটি একজন মহিলার জন্য অবমাননার, অসম্মানের। এই পরীক্ষার মাধ্যমে ধর্ষণের মতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের স্মৃতি যেন আবার উসকে দেওয়া হয়। শারীরিক তো বটেই, এই পরীক্ষা একপ্রকার চূড়ান্ত মানসিক নির্যাতনের নিদর্শন।
টু ফিঙ্গার টেস্টে কোনও মহিলার যোনিতে দু'টি আঙুল ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয়, মহিলা ধর্ষিতা হয়েছেন কি না। দুই আঙুল যদি প্রবেশ করতে পারে, তাহলে ধরে নেওয়া হয়, মহিলা ধর্ষিত হয়েছেন, যদি না প্রবেশ করে আঙুলদু'টি, সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয় ঠিক উল্টোটা।অর্থাৎ, মহিলা ধর্ষিতা হননি। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের মতে, যদি ধরেই নেওয়া হয় যোনিতে দু'টি আঙুল প্রবেশের মানে, কখনও না কখনও বা কোনও না কোনও ভাবে সেই মহিলার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে, তাহলে বিবাহিতা মহিলাদের ক্ষেত্রে কী হবে? তাহলে কি বলতে চাওয়া হচ্ছে, বিবাহিতা মহিলাদের ধর্ষণ হয় না?
মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট টু ফিঙ্গার টেস্ট-কে অবৈজ্ঞানিক আখ্যা কেন দিল? টু ফিঙ্গার টেস্টে কি আদৌ ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়? আসা যাক সেই প্রসঙ্গে।
আরও পড়ুন: “জি-স্পটটা কোন দিকে?” সঙ্গিনীকে যৌনসুখ দিতে যা খুঁজছেন, তা কি আদৌ আছে?
'ইন্ডিয়া টুডে'-র সূত্রে জানা যাচ্ছে (২০১৩ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে), মহারাষ্ট্রের মহাত্মা গান্ধী ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস-এর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ এবং আইনজীবি ড. ইন্দ্রজিৎ খান্ডেকর জানাচ্ছেন, "এই পরীক্ষার পিছনে কোনও বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই।"
টু ফিঙ্গার টেস্টে দেখা হয় যোনির চারপাশে থাকা হাইমেন আদৌ অক্ষত আছে কি না এবং ভ্যাজাইনাল প্যাসেজ নমনীয় হয়েছে কি-না। "ভ্যাজাইনাল প্যাসেজের নমনীয়তা পরীক্ষার জন্যও কোনও নির্ধারিত পরীক্ষা বা নির্ণায়ক নেই", জানাচ্ছেন ড. খান্ডেকর।
অথচ, ভারতে ডাক্তারির প্রায় সমস্ত বই অন্ধের মতো টু ফিঙ্গার টেস্ট-কে মান্যতা দেয়, জানা যাচ্ছে 'ইন্ডিয়া টুডে'-র ২০১৩ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে।
হাইমেন চামড়ার একটি পাতলা পর্দা। যা যোনির চারপাশ আবৃত করে থাকে। তবে প্রাচীরের মতো যোনির মুখ বন্ধ করে রাখে না। আমাদের একটি গুরুতর ভুল ধারণা হলো, সব মহিলার হাইমেন রয়েছে। নাহ্, সব মহিলা হাইমেন নিয়ে জন্মান না বা জন্মের পরও তাঁদের হাইমেন তৈরি হয় না। এবং এই অবস্থা হাইমেন থাকার মতোই একটি স্বাভাবিক বিষয়। হাইমেনের এমনিতেও কোনও শারীরবৃত্তীয় ভূমিকা নেই। তাই তার থাকা না-থাকায় কোনও সমস্যা হয় না।
বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা রয়েছে যে, একমাত্র যৌন সম্পর্ক হলেই হাইমেন ছিঁড়ে যায় আর যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হননি যে নারী, তাঁর হাইমেন অক্ষত থাকে।
কিন্তু সাইকেল চালানো, জিমন্যাস্টিক করা, সাঁতার কাটা, ঘোড়ায় চড়া, ক্যারাটে ইত্যাদি থেকেও হাইমেন ছিঁড়তে পারে। শুধু তাই নয়, হাইমেন ছিঁড়লেই যে কোনও মহিলার রক্তপাত হবে বা ব্যথা অনুভূত হবে, তা কিন্তু নয়। হাইমেন ছিঁড়তে পারে অজান্তেই। এবং অনেক মহিলাই প্রথমবার যৌন সঙ্গমের সময় বিশেষ ব্যথা অনুভব করেন না বা তাঁর যোনি থেকে রক্তপাত হয় না। এখানেও মানুষের ভুল ধারণা আছে, প্রথমবার যোনিপথে যৌন সম্পর্ক হলেই রক্তপাত হবে।
নরওয়েইয়ান ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি-র স্ত্রীরোগ-বিষয়ক গবেষক ড. লোনি-হফম্যান জানাচ্ছেন, মেয়েরা যখন বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছয়, তখন তাদের হাইমেন এমনিতেই ইলাস্টিকের মতো হয়ে যায়। ফলে যৌন সঙ্গমের পরেও তা না-ও ছিঁড়তে পারে। সেক্ষেত্রে যৌন সঙ্গমের পরেও টু ফিঙ্গার টেস্টের ফল জানান দেবে, মহিলার যৌন সঙ্গম ঘটেনি। বা তাঁকে ধর্ষণ করার পর টু ফিঙ্গার টেস্টের ফল বলবে তাঁর ধর্ষণ হয়নি।
মহিলার যোনির মুখ যদি খুব ছোটও হয়, তা সত্ত্বেও হাইমেন না-ও ছিঁড়তে পারে, যেহেতু বয়ঃসন্ধিকালে হাইমেন ইলাস্টিকের মতো হয়ে যায়। গবেষণা বলছে, যৌন সঙ্গমের পরেও যে হাইমেনের আকার বা গঠনে চোখে পড়ার মতো কিছু পরিবর্তন আসে, তা কিন্তু নয়। সেক্ষেত্রে, ধর্ষিতা টু ফিঙ্গার টেস্ট করাতে বাধ্য হলে, টেস্টের ফল যে বলবে তাঁকে ধর্ষণ করা হয়নি, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে!
আমাদের অনেকের মধ্যেই বদ্ধমূল ধারণা, প্রতিটি মহিলার যোনির চারপাশে পর্দার মতো বিস্তৃত থাকে হাইমেন। ড. লোনি-হফম্যান সেই ধারণাকে ভেঙে জানাচ্ছেন, খুব বিরল কিছু ক্ষেত্রেই হাইমেন সম্পূর্ণভাবে যোনির মুখ আবৃত করে রাখে। এবং একমাত্র সেক্ষেত্রেই সঙ্গমের ফলে হাইমেন ছেঁড়ার সম্ভাবনা থাকে।
তিনি জানাচ্ছেন, বিভিন্ন মহিলার হাইমেনের আকার বিভিন্ন রকমের হয়। এমনও হতে পারে, হাইমেনটি কেন্দ্রের দিকে খুব সামান্যই বিস্তৃত। ফলে যোনির মুখ প্রায় খোলাই থাকে।
লোনি-হফম্যান জানাচ্ছেন, কোনও মহিলা যদি প্রতিদিন বারবারও সঙ্গমে লিপ্ত হন, তারপরেও তাঁর হাইমেনের গঠন অপরিবর্তিত ও অক্ষত রয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কোনও মহিলা ধর্ষিতা হলে, টু ফিঙ্গার টেস্ট বলবে, তাঁর ধর্ষণ হয়নি।
এমনও হতে পারে, প্রথমবার বা প্রথম প্রথম কয়েকবার সঙ্গমের পর হাইমেন পরিবর্তিত হলো। সেই পরিবর্তন আসতে সময়ও লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে টু ফিঙ্গার টেস্টের রিপোর্ট কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
রেপ ট্রায়ালে ধর্ষিতাকে অবান্তর প্রশ্নের সামনে ফেলা হয়। যেমন, তাঁকে কোন ভঙ্গিতে ধর্ষণ করা হয়েছে, কতক্ষণ ধরে ধর্ষণ করা হয়েছে, তাঁর এর আগে যৌন সম্পর্ক হয়েছে কি না কারও সঙ্গে, ইত্যাদি।
কিছু কথা বারবার বলেও ক্লান্ত হয়ে গেলেও আবারও উল্লেখ্য, ধর্ষণ মানে কোনও মানুষের সঙ্গে জোরপূর্বক সঙ্গম করা বা তার যৌনাঙ্গে হাত দেওয়া। এবং এখানেই শেষ কথা। সেই ব্যক্তির সঙ্গে আগে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কি না, সে স্বামী বা স্ত্রী কি না, প্রেমিক বা প্রেমিকা কি না, পরিচিত নাকি অপরিচিত, স্বল্পক্ষণ ধর্ষণ করেছে নাকি দীর্ঘক্ষণ, সেই সমস্ত এখানে সম্পূর্ণ অবান্তর।
সবশেষে কিছু কথা- ২০১৯ সালে জার্নাল অফ রিপ্রোডাক্টিভ হেলথের একটি প্রতিবেদনে গবেষকরা জানাচ্ছেন, হাইমেনের বর্ণনা দিতে গিয়ে 'ইনট্যাক্ট', 'ব্রোকেন', 'ভার্জিন' কিংবা 'অক্ষত', 'ছেঁড়া' প্রভৃতি বিবিধ বিশেষণে ডাকা বন্ধ করতে হবে। হাইমেন শরীরের একটি স্বাভাবিক অঙ্গমাত্র। তার আকার, আকৃতি কোনও নারীর শরীরের অস্বাভাবিকতার সূচক নয়। অথচ সেই হাইমেনই নির্ধারিত করে চলেছে কোনও মহিলার সামাজিক মূল্য এবং অবস্থান। সেখান থেকে তাঁকে (নারীকে) পণ্যের স্তরে নামিয়ে আনতেও সমাজের বেশি সময় লাগে না।
আদর্শ নারীর চরিত্র কী কী, তা সমাজ মান্ধাতার আমলেই নির্ধারণ করে রেখেছে। আদর্শ নারীর সংজ্ঞায় প্রাপ্তবয়স্ক নারীর বিবাহ-পূর্ববর্তী যৌন সম্পর্ক থাকা গর্হিত অপরাধ। তার 'চরিত্র' এবং অতীতকে সামনে রেখে সমাজ সেখানে নির্ধারণ করে, মহিলাটিকে যা সহ্য করতে হয়েছে, তা আদৌ ধর্ষণ কি না, ধর্ষণ হলেও অন্যায়ের পাল্লা কতটা ভারী বা আদৌ তা অন্যায় কি না ইত্যাদি।
আর নারীর তথাকথিত সামাজিক অবস্থান অনুসারে তার প্রতি হওয়া অন্যায় যে ফুৎকারে উড়ে যায়, তা কি এখনও অস্বীকার করার সুযোগ আছে?