অযোধ্যার রামমন্দিরে ৬ কোটি বছরের পুরনো শালগ্রাম! ইতিহাস নাকি মিথ?
Shaligram Stones Ayodhya Ram Mandir : পবিত্র এই শিলা খোদাই করেই নাকি মন্দিরের জন্য রাম-সীতার মূর্তি তৈরি করা হবে বলে জানা গিয়েছে। তবে সেই কাজ শুরু হতে এখনও খানিক সময় লাগবে।
বাইরে থেকে দেখলে, বিশাল বড় দুটি পাথর। অন্যান্য পাথরের মতোই সাধারণ, কঠিন তার চেহারা। কিন্তু সেই পাথর দুটিকে ঘিরেই দেশজুড়ে উত্তেজনায় মাতছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। এই মুহূর্তে ভারতের খবরের শিরোনামেও রয়েছে এই দুটি পাথর। যে সে পাথর নয়, খোদ শালগ্রাম শিলা! আর এই শিলা দিয়েই তৈরি হবে অযোধ্যার রাম মন্দিরের রাম-সীতার মূর্তি তৈরির কাজ।
রাম মন্দির কেবল ধর্মের দিক থেকে নয়, ভারতের বর্তমান রাজ্য-রাজনীতির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল এই বিতর্কের। তারপর গঙ্গা দিয়ে গড়িয়ে গিয়েছে অনেক জল। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রাম মন্দির নির্মাণের জন্য ট্রাস্ট গঠনের নির্দেশ দেয়। তারপরও বিতর্কের রেশ থামেনি। সেই আবহের মধ্যে ফের একবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেন রামলালা। ইতিমধ্যেই অযোধ্যার প্রস্তাবিত জায়গায় রাম মন্দিরের নির্মাণ কাজ চলছে। সেখানেই নিয়ে আসা হল এই বিরাট দুটি শালগ্রাম শিলা।
আরও পড়ুন : ফের আতঙ্কে যাত্রীরা, ‘জয় শ্রী রাম’-এর বদলা নিতেই কি বারবার পাথর বৃষ্টি বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে?
একটির ওজন ১৮ টন, অন্যটি ১২ টন। মোট ৩০ টনের এই দু’টি শালগ্রাম পাথরের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল নেপালের কালীগণ্ডকী নদী থেকে এই বিশেষ পাথর দুটি পাওয়া গিয়েছে। করসেবকদের দাবি, এই শিলা প্রায় ৬ কোটি বছরের পুরনো। নেপাল থেকে ট্রাকে করে এই শালগ্রাম শিলা পৌঁছয় উত্তর প্রদেশের গোরক্ষনাথ মন্দিরে। সেখান থেকে ২ ফেব্রুয়ারি অযোধ্যার প্রস্তাবিত রাম মন্দিরে আনা হয়। তারপর থেকেই সমানে শুরু হয়েছে পুজো। পবিত্র এই শিলা খোদাই করেই নাকি মন্দিরের জন্য রাম-সীতার মূর্তি তৈরি করা হবে বলে জানা গিয়েছে। তবে সেই কাজ শুরু হতে এখনও খানিক সময় লাগবে। নকশা তৈরি করে, সেরা ভাস্করকে দিয়ে মূর্তি তৈরির কাজ করানো হবে। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৪-এর মকর সংক্রান্তি তিথিতে রামলালার মূর্তির অভিষেক হবে।
শালগ্রাম শিলা বরাবরই ভারতের সনাতন ধর্মের স্রোতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। বিভিন্ন ধর্মীয় কাজে এই শিলার প্রয়োজন। স্বয়ং বিষ্ণুর প্রতীক হিসেবে মানা হয় এই বিশেষ শিলাকে। হিন্দু ধর্মের নিরিখে অত্যন্ত পবিত্র বলেও মানা হয়। কিন্তু সেটি সংগ্রহের জন্য একেবারে নেপালে যেতে হল কেন?
বিজ্ঞানের দিক থেকে দেখলে, এই শালগ্রাম শিলা আসলে জীবাশ্ম পাথর। ইংরেজিতে এর নাম Ammonite fossils। কয়েক কোটি বছর আগে যখন টেথিস সাগর থেকে হিমালয়ের সৃষ্টি হয়েছিল, তখন বহু প্রাণী, উদ্ভিদ সেই ভূকম্পন, বিপর্যয়ে প্রাণ হারায়। ধীরে ধীরে পলির নিচে চাপা পড়তে পড়তে একেবারে পাথরের আকার ধারণ করে। হিমালয় পাললিক শিলা দিয়েই তৈরি; কাজেই সেখানে এরকম জীবাশ্ম পাথর পায়া যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর নেপালের ওপর দিয়েই হিমালয়ের বেশিরভাগ অংশটি গিয়েছে।
আরও পড়ুন : এর নাম ভক্তি! নির্লজ্জ! অযোধ্যায় কেন নিজেদের মধ্যে লড়ছেন সাধুরা!
যে বিশেষ পাথরটির কথা বলা হচ্ছে, সেটি প্রধানত নেপালের কালীগণ্ডকী নদী সংলগ্ন অঞ্চলেই পাওয়া যায়। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, অন্যান্য অনেক জায়গায় শালগ্রাম শিলা পাওয়া গেলেও, গণ্ডকী নদী সংলগ্ন এই জায়গার শিলা একেবারে খাঁটি। পুরাণেও বর্ণিত রয়েছে একই কথা। সেখানে বলা হয়েছে, হিমালয়ের দক্ষিণে গণ্ডকী নদী সংলগ্ন অঞ্চলটির নাম ‘হরিক্ষেত্র’। এখানেই নাকি স্বয়ং বিষ্ণু শিলারূপে অবস্থান করছেন। আর সেই শিলাই শালগ্রাম বা নারায়ণী শিলা। আর পুরাণে, রামকে বিষ্ণুর অন্যতম অবতার হিসেবে মানা হয়। তাই গণ্ডকী নদীর আসল শালগ্রাম শিলা দিয়েই মূর্তি তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তবে এখানে সামনে আসছে অন্য প্রসঙ্গও। সামনের বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালে রয়েছে ভারতের লোকসভা নির্বাচন। তার আগে ধর্মীয় রাজনীতির ধ্বজা ওড়াতেই কি আরও একবার রামলালার অবতারণা? কেন এমন কথা? ২০১৯ সালে মোদি সরকার দুটি কাজ করে। প্রথম, কাশ্মীরের বিশেষ ৩৭০ ধারা রদ। অন্যটি হল, রাম মন্দিরের স্থাপন। ১৯৯২ সাল থেকে যা ভারতের রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ২০১৯ সালেই ছিল গত লোকসভা নির্বাচন। রাম মন্দির, রামলালার হাত ধরে ২০১৪ ও ২০১৯- দুই বছরই নির্বাচনে জিতেছে বিজেপি। ২০২০-র দিল্লি বিধানসভা ভোটের আগে ট্রাস্ট গঠন সম্পূর্ণ করে মোদি সরকার। তারপর ২০২৪ সাল। আবারও একটা লোকসভা নির্বাচন। তাই কি এত ধুমধাম করে শালগ্রাম শিলার আবির্ভাব? ২০২৪-র মকর সংক্রান্তিতে রামের মূর্তির উদ্বোধনও হবে বলা হচ্ছে। ভোটই কি বড় বালাই? ধর্ম কি স্রেফ ক্ষমতা দখল আর ব্যবসার অস্ত্র? প্রশ্ন তো উঠছেই।