বিজেপি ভার্সেস বিজেপি! শুভেন্দু-দিলীপের কোন্দল থামাতে বাংলায় আসতে হল অমিত শাহকে?

Amit Shah Bengal BJP: দলের রাজ্য দফতরের ওই বৈঠকে সংবাদমাধ্যম তো দূর, বেছে বেছে প্রবেশের অনুমতি ছিল মাত্র ১৪ জন শীর্ষ বিজেপি নেতার।

ভাইয়ে-ভাইয়ে যুদ্ধ করেন, দাদা আসেন থামিয়ে দিতে! ডিসেম্বর মাস। শীতকাল। সবেমাত্র কুয়াশায় ভরেছে রাজ্য। বঙ্গে 'ধামাকা' না হলেও এখন থেকেই পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে শুরু হয়েছে তোড়জোড়। তবে লড়বে কে? তৃণমূল বনাম বিজেপি নাকি বিজেপি বনাম বিজেপি! রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari BJP) এবং বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের (Dilip Ghosh) সাম্প্রতিক দ্বন্দ্ব আর প্রকাশ্যে তার বিচ্ছুরণ, এই প্রশ্নই তুলে দিচ্ছিল বারবার। আর সেই প্রশ্নের মধ্যেই যেন ঘরের অশান্তির নাগাল ধরলেন অমিত শাহ (Amit Shah) স্বয়ং!

'পূর্বাঞ্চলীয় নিরাপত্তা পরিষদে'র (Eastern Zonal Security Council) বৈঠকে যোগ দিতে শুক্রবার রাতে, তিলোত্তমায় পা রেখেই শাহ বসেন রুদ্ধদ্বার দলীয় বৈঠকে। কর্মসূচিতে এই দলীয় বৈঠকের কথা প্রথমে না থাকলেও হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেন অমিত শাহ। আর এর পরেই ওঠে প্রশ্ন, তাহলে কি দলীয়-কোন্দল কমাতে ভরসা সেই অমিত! অন্যদিকে নির্বাচনে জেপি নাড্ডাদের ছাড়িয়ে শাহ-টোটকাতেই কি ফের অক্সিজেন পেতে চলেছে বঙ্গের 'বিধ্বস্ত' বিজেপি?

জানা গিয়েছে, বঙ্গ বিজেপির নুইয়ে পড়া অংশকে ঠেলে তোলার পাশাপাশি দিলীপ-শুভেন্দু-সুকান্তকে রাজনৈতিক শৃঙ্খলার পাঠ দিতেও শুক্রবার রাতে বঙ্গে হাজির হয়েছেন শাহ! বিমানবন্দর থেকে নিজের গাড়ির পিছনের আসনে শুভেন্দু-সুকান্তকে বসিয়ে সেই কাজের শুরুও নাকি করে দেন তিনি। এরপরেই বসেন বৈঠকে। যদিও বঙ্গের বিজেপি সূত্র বলছে, "কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলায় এলেন দলের সংগঠনের খোঁজ নিতে শুধু নয়, রুটিন সফরেও এসেছেন তিনি। রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক।" কিন্তু আদৌ কি তাই? তাহলে কেন এই দলীয় বৈঠক? কী হল সেখানে?

আরও পড়ুন- ডিসেম্বরে রাজ্য জুড়ে ব্যাপক ডামডোল? শুভেন্দুর ‘তারিখ পে তারিখ’ আসলে যে ইঙ্গিত দিচ্ছে

অমিত-বৈঠকের হাঁড়ির খবর

শুক্রবার সন্ধ্যার বিমানে দিল্লি থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেন অমিত শাহ। শুক্রবার রাতেই দমদম বিমানবন্দর থেকে একই গাড়িতে শুভেন্দু-সুকান্তকে নিয়ে সরাসরি মধ্য কলকাতার মুরলিধর সেন লেনের বিজেপির কার্যালয়ে পৌঁছন অমিত শাহ। একদা বিজেপির শেষকথা, নরেন্দ্র মোদির 'ডানহাত' শাহ এরপরেই তড়িঘড়ি বসেন বৈঠকে। দলের রাজ্য দফতরের ওই বৈঠকে সংবাদমাধ্যম তো দূর, বেছে বেছে প্রবেশের অনুমতি ছিল মাত্র ১৪ জন শীর্ষ বিজেপি নেতার। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, দিলীপ ঘোষ, লকেট চট্টোপাধ্যায়রা উপস্থিত হন ওই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে। সেখানেই চলে আলোচনা।

কী বললেন অমিত শাহ?

বিজেপি সূত্রের খবর, আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রণকৌশল নির্ধারণ করে দিয়েছেন অমিত শাহ। কেমন ভাবে বঙ্গে লড়বে বিজেপি, কীভাবে চলবে প্রতিরোধ, সব বিষয়ে রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছেন শাহ। দিলীপ ঘোষ বলছেন, "পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।" সূত্রের দাবি, নির্বাচনের প্রস্তুতি খতিয়ে দেখার পাশাপাশি বঙ্গ বিজেপির নেতাদের লড়াই আরও শক্তিশালী করার নির্দেশ দিয়েছেন অমিত শাহ। দলের নেতাদের কাছ থেকে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শুনেছেন একাধিক বিষয়ও। ওই বৈঠকে দলের সংগঠনের জন্য একাধিক পরামর্শও এসেছে শাহর তরফে।

সূত্রের খবর, নির্বাচনে জিততে অমিতের একাধিক টোটকার সঙ্গেই এদিন বঙ্গের দলীয় কোন্দল নিয়েও পরোক্ষে উষ্মা প্রকাশ করেন অমিত শাহ। বঙ্গ বিজেপির ওই সূত্রের দাবি, গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের কাণ্ডারি বঙ্গ বিজেপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন! জানা গিয়েছে, সরাসরি না বললেও দিলীপ ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদারদের অমিত শাহ বুঝিয়ে দিয়েছেন, দলের অভ্যন্তরের এই অস্বস্তি সহ্য করবে না কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের নেতাদের পাখির চোখ করতে বলেছেন ২০২৪-র লোকসভা নির্বাচনকেই। এখন থেকেই শুরু করতে বলেছেন প্রস্তুতি।

অমিত শাহের এই বৈঠক প্রসঙ্গে প্রকাশ্যে বঙ্গ বিজেপির তরফে বিস্তারিত কিছু না বলা হলেও সূত্রের দাবি, এদিনের বৈঠকে অমিত শাহের সামনে একাধিক অভিযোগও করেন বঙ্গের বিজেপি নেতারা। সেখানে উঠে আসে রাজ্য সরকার এবং বিজেপি নেতা-কর্মীদের প্রতি রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের 'অত্যাচার' প্রসঙ্গও। যা শুনে অমিত শাহ সরাসরি কিছু বলেননি বলেই খবর। নেতাদের শুধু রাজনৈতিক লড়াই জারি রাখার নির্দেশ দিয়েছেন গেরুয়া-শিবিরের এই চাণক্য।

অমিত-সফরে মমতা-লাভ

দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শনিবারই মুখোমুখি হন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee)। এই সাক্ষাৎ নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। বাম-কংগ্রেসের তরফে ফের উঠেছে 'সেটিং তত্ত্ব'। যদিও এই প্রসঙ্গে বিজেপির দাবি, নিরাপত্তা সংক্রান্ত বৈঠক দেশের জন্য অন্যতম। এই বৈঠক নিয়ে রাজনীতি করা মানে, মূর্খের স্বর্গে বাস, দাবি গেরুয়া-নেতাদের।

দিলীপ-শুভেন্দু দ্বন্দ্ব

এক দিকে শুভেন্দু অন্যদিকে সুকান্ত। বঙ্গের গেরুয়া শিবিরের 'দুই রত্নে'র প্রকোপে প্রথম থেকেই খুব একটা ভালো নেই দিলীপ ঘোষ, এমনও বলেন কেউ কেউ। একদা গরুর দুধে সোনা থেকে শুরু করে বারবার খবরের শিরোনামে থাকা এই নেতার শুভেন্দু-অস্বস্তি নিয়েও টিপ্পনি শোনা যায় মাঝে মাঝেই। ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই একের পর ঘটনায় প্রকাশ্যে এসেছে দিলীপ-শুভেন্দু বিরোধ। দুই নেতার মন্তব্য-তিরে অস্বস্তিতে পড়েছেন বঙ্গের বিজেপি নেতারা। খবর গিয়েছে দিল্লির দফতরেও।

আরও পড়ুন- একটি প্রণামেই তছনছ সাজানো বাগান? শুভেন্দু-সৌজন্যে বিজেপির অন্দরে যে তোলপাড়

তৃণমূল কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফলে নিজেদের দলের নেতা খুনের অভিযোগের মধ্যেই উত্তেজনা বাড়িয়েছেন বিজেপির শুভেন্দু এবং দিলীপও। সম্প্রতি, নবান্ন অভিযান থেকে শুরু করে দলের একাধিক কর্মসূচি- সব ক্ষেত্রেই দিলীপ-অসন্তোষে পড়েছেন শুভেন্দু। সম্প্রতি, আসানসোলে শিবচর্চা এবং কম্বল বিতরণ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে অশান্তি, তিন জনের মৃত্যুর ঘটনায় সুর চড়ান দিলীপ ঘোষ। তিনি বলেন, "দান-খয়রাত মানবতার অপমান। পুলিশের উপর সব ছাড়া ঠিক নয়। বিরোধী দলনেতার দায় ছিল।" এদিকে দিলীপ ঘোষের প্রাতঃভ্রমণ এবং রাজনীতি নিয়েও কটাক্ষের সুর শোনা যায় শুভেন্দু অধিকারীর গলায়। পাল্টা দিলীপ ঘোষও কটাক্ষে বিদ্ধ করেন শুভেন্দুকে। 'ডিসেম্বর ধামাকা' নিয়েও সরব হন দিলীপ! একের পর এক শুভেন্দু বিরোধিতায় অস্বস্তিতে পড়ে রাজ্য বিজেপি। কয়েক মাস আগে সুকান্ত-বিরোধিতা করে দলীয় এক বৈঠকেও নাকি ঢুকতে বাধা পান দিলীপ ঘোষ! আবার কেন্দ্রীয় নেতাদের তরফেও বারবার মুখে লাগাম লাগানোর কথা বলা হয় দিলীপকে। প্রশ্ন ওঠে, বিতর্ক বাড়ে নিরন্তর।

এই বিতর্ক আরও বৃদ্ধি পায় ১৯ ডিসেম্বর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হওয়া একটি বৈঠককে কেন্দ্র করে। রাজ্যের নেতা, দলীয় সাংসদদের নিয়ে দিল্লিতে দিলীপ ঘোষের বাড়িতে বঙ্গ বিজেপির একটি বৈঠকের কথা থাকলেও তার স্থান পরিবর্তন করা হয়। কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রী সুভাষ সরকারের বাড়িতে বৈঠকের স্থান নির্ধারণ করা হয় পরে। এখানেও ওঠে প্রশ্ন। দিল্লির ওই বৈঠকে শুভেন্দু অধিকারীর উপস্থিতির জন্যই কি এই সিদ্ধান্ত? জল্পনা শুরু হয় এই প্রশ্নেও। তৃণমূলের তরফে কুণাল ঘোষ বলেন, "শীতকালীন সার্কাস চলছে!"

যদিও অমিত শাহ বঙ্গে পা রাখার আগেই দেখা যায় ফের পাশাপাশি এসেছেন দিলীপ-শুভেন্দু। আর এই বিবাদ প্রসঙ্গে দিলীপ ঘোষ বলেন, "বিজেপিতে গণতন্ত্র আছে বলেই কথা বলতে পারি। আমাদের কি বোমা, বন্দুকের লড়াই হয়েছে নাকি!" ফের শুরু হয় জল্পনা। তাহলে কি মিটছে কোন্দল? এই প্রশ্নের আবহেই দিলীপ ঘোষ সমস্ত বিতর্কের দায় চাপান সংবাদমাধ্যমের উপরেও।

প্রসঙ্গত, একদা মমতার কাছের মানুষ শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপিতে যোগদান এবং অল্প সময়েই বঙ্গের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা খুব একটা মেনে নিতে পারেনি বিজেপির একটা বড় অংশ। যার মধ্যে অন্যতম দিলীপ ঘোষ গোষ্ঠীও, দাবি করা হয় এমনও। আর সেখান থেকেই বারবার শুরু হয় বিতর্ক। যে বিতর্ক শেষের রসদ শুধু নয়, বঙ্গ বিজেপির পঞ্চায়েত নির্বাচন কৌশলও হতে চলেছে অমিত শাহর এই বৈঠক, বলছেন রাজনীতিক কারবারিদের একাংশ।

 

More Articles