স্কুলে যাননি কোনওদিন, তবু চিকিৎসা করতেন! মোদির প্রয়াত মা হীরাবেনের যে জীবন অজানাই
Heeraben Modi Passes Away: নরেন্দ্র মোদির মা নিজে কখনও স্কুলে যাননি, তবুও তিনি তাঁদের গ্রামের একজন ডাক্তার ছিলেন।
মায়েদের ভারতবর্ষ ঠিক একটাই অভিমুখে সম্মান করে। অন্যের পরিচয়ে পরিচয়, অন্যের পরিচয়ে খ্যাতি, অন্যকে গর্ভ ধরে সেই গর্ভের গর্ব অনুযায়ীই সামাজিক তুলাদণ্ডে হয় কুমাতা বা রত্নগর্ভা। রত্নের জন্ম দিতে দিতে যাদের বহু বেলাই কেটে গিয়েছে, রত্নকে পালন করতে গিয়ে যাদের পেরিয়ে গিয়েছে সমস্ত শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা বা বসন্ত, তাঁদের ঠাঁই চিরকালই নেপথ্যে। বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের মা হওয়ার গর্বে বা দায়িত্বের আড়ালে তাঁদের যাপনের কতটুকুই বা মানুষ জেনেছে, কবেই বা! সফল পুরুষের পাশে নয়, পিছনে থেকে মায়েরা একদিন চলে গেছেন বিস্মৃতির গহিনে। যেমন চলে গেলেন হিরাবেন। হিরাবেন মোদি, পরিচয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর মা। গুজরাতের ভাদনগরের ছাপোষা এক মহিলার জীবনের গভীরে গেলে, সেই বারোমাস্যাকে পড়লে এমন একজন মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে যিনি শুধুই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বড় করেননি, নিজের জীবনকেও লড়াইয়ের স্রোতে ভাসিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মা হিরাবেন মোদি শুক্রবার ভোরে ইউএন মেহতা ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রীর মা হিরাবেন মোদি শতবর্ষে পা দিয়েছিলেন চলতি বছরই। হিরাবেনের জন্ম অবশ্য পালানপুরে, মোধি-গাঞ্চ-তেলি সম্প্রদায়ে। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জন্ম, অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারানোর পর তার দিদার কাছেই বেড়ে ওঠেন। বাসন মাজা, তুলোর কারখানায় প্রতিদিন ৪/৫ টাকা মজুরিতে কাজ, সবই করেছেন হিরাবেন। বিয়ে হয় চা বিক্রেতা দামোদর মুলচাঁদ মোদির সঙ্গে। বিয়ের পর চলে আসেন ভাদনগরে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাই প্রহ্লাদ মোদি একবার বলেছিলেন, "আমার মায়ের বয়স তখন মাত্র ১৫ কি ১৬, বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তাঁর। আর্থিক চাপ এবং পারিবারিক সমস্যার কারণে তিনি কখনই পড়াশোনা করার সুযোগও পাননি। তবে আমার মা চেয়েছিলেন যে তাঁর সমস্ত সন্তান শিক্ষিত হোক। পরিবারের আর্থিক অবস্থা এমন ছিল যে আমাদের কাছে ফি দেওয়ার মতো টাকাও ছিল না কিন্তু মা কখনই টাকা ধার করেননি। কিছু কাজ করে তবেই সেই টাকা চুকিয়ে দিতেন তিনি।"
ছয় সন্তানের মা হিরাবেনের তৃতীয় সন্তান নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রী মোদি ভাদনগরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। জানিয়েছিলেন, তাঁদের পরিবারের কাছে স্কুলের ফি দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী মোদির একটিই স্কুল ইউনিফর্ম ছিল এবং যখনই ইউনিফর্ম ছিঁড়ে যেত, হিরাবেন অন্য কোনও রঙের কাপড় দিয়ে তা রিফু করে দিতেন।
আরও পড়ুন- মোদির সংকটে ‘পাশে আছি’! দেশকে ভালোবাসার নতুন পাঠ শেখাচ্ছেন রাহুল গান্ধী
ভাদনগরে হিরাবেন ছোট শিশু এবং মহিলাদের ঘরোয়া টোটকা দিয়ে চিকিত্সা করতেন। প্রহ্লাদ মোদি বলেছিলেন, "আমার মা অনেক দেশজ টোটকা জানতেন। মাকে সবাই দোসি মা নামেই ডাকতেন। মা নিজে কখনও স্কুলে যাননি, তবুও তিনি আমাদের গ্রামের একজন ডাক্তার ছিলেন। ১০০ বছর পার করেছেন সংগ্রাম এবং কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়েই।"
প্রহ্লাদ মোদির কথায়, দিনে দু'বার কুয়ো থেকে জল তুলতেন, এত বয়সেও টানটান ছিল পিঠ। প্রতিদিন পুকুরপাড়েই কাপড় ধুতে যেতেন এবং পুকুরে নামা ওঠার এতগুলি সিঁড়ি পেরোতে হতো যে পা হাঁটুর সমস্যা কাবু করতে পারেনি দীর্ঘকাল। শতবর্ষ ছুঁইয়েও হিরাবেন বাইরের খাবার কোনওদিনও খাননি।"
হিরাবেনের বয়সকালের বন্ধুরা জানিয়েছেন, হিরাবেন সবসময় নিজের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। প্রতিদিনের রুটিন কাজ এবং নিজের পরিবার- এর বাইরে তাঁর জীবন বলতে কিছুই ছিল না।
শোনা যায়, পরিবারের আর্থিক অবস্থা এককালে এমন ছিল যে সপ্তাহে পাঁচ দিন শুধু বাজরা রুটি এবং কড়ি তৈরি করা হতো। প্রহ্লাদ মোদির কথায়, "সবজি কেনার টাকা ছিল না। তখন ছাস (যাকে বাটার মিল্ক বলা হয়) তখন বিনামূল্যেই পাওয়া যেত। বাড়িতে শুধু বাজরার রুটি আর কড়ি রান্না করা হতো। আসলে নরেন্দ্র ভাই, বাড়ি ছাড়ার কয়েক বছর আগে পর্যন্ত, শুধু দুটো রুটি আর চা ছাড়া কিচ্ছু খেত না।"
দেশ এবং মোদি ভক্তরা বলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি দিনে ১৮ ঘণ্টা কাজ করেন। আর এই কাজের শক্তির অনুপ্রেরণা পেয়েছেন মা হিরাবেনের থেকেই। বরাবরই ধার্মিক মানুষ হিরাবেন মোদি। শোনা যায়, দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার পন্থায় আস্থা ছিল তাঁর। নিজে নিরক্ষর ছিলেন ঠিকই কিন্তু স্বামী দামোদর তাঁকে ধর্মীয় বই পড়ে শোনাতেন।
মায়ের মৃত্যুতে টুইট করেছেন মোদি, লিখেছেন, "এক গৌরবময় শতাব্দী ঈশ্বরের পায়ে বিশ্রামে শুয়ে আছে," জীবনের শেষ কয়েকদিন, হিরাবেন গুজরাতের গান্ধীনগরের উপকণ্ঠে রায়সানে তাঁর আরেক ছেলে পঙ্কজ মোদির বাড়িতেই কাটিয়েছেন। এই বছরের শুরুর দিকে হিরাবেনের শততম জন্মদিনে মোদি লিখেছিলেন, "আমার মা যতটা সহজ, তিনি ততটাই অসাধারণ।" মোদিই জানিয়েছিলেন, একজন কর্তব্যপরায়ণ নাগরিক হিসাবে, হিরাবেন পঞ্চায়েত থেকে সংসদ পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। মোদি ভাইদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং আশির দশকের শুরু থেকে এই পরিবারকে চেনেন কিশোর মাকওয়ানা। ইন্ডিয়া টুডেকে তিনি জানিয়েছেন, “২০০৪ সালে হিরাবেন প্রথম বলেছিলেন যে আমার ছেলে একদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবে। সেই সময়ে, নরেন্দ্র মোদি তিন বছর ধরে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং তাঁর জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে আসার কথা ভাবেননি কেউই। প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি যখন তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তখন হিরাবেন তাঁকে একটাই উপদেশ দিয়েছিলেন— কখনও দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়ো না।” হিরাবেন একমাত্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ২০০২ সালে, যখন দ্বিতীয়বার গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছিলেন মোদি।