"তুমি আমার সঙ্গে গিয়ে করবে টা কী,” কেন যশোদাবেনকে বিয়ের কথা স্বীকার করতে চাননি মোদি?
Narendra Modi Wife Jashodaben Modi: স্ত্রীকে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, "আমি সারা দেশ ঘুরব, যেখানে খুশি সেখানে যাব; তুমি আমার সঙ্গে গিয়ে করবে টা কী?”
তিনি কোনও বন্ধনে নিজেকে বাঁধেন না। তিনি 'ফকিরি'-তে আস্থা রাখেন। ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে, মাধুকরি করতেই ভালোবাসেন, অন্তত ভালোবাসেন বলেই জানিয়েছেন। এহেন মানুষের পরিবার থাকে না, গার্হস্থ্যের মায়া এঁরা হেলায় সরিয়ে বেছে নেন দেশের-দশের ডাক। মাতৃত্বের আঁচল, স্ত্রীর সাহচর্য, সন্তানের দায়িত্ব বা পরিবারের জাগতিক দায়বদ্ধতা যে বৃহৎ উদ্দেশ্যের পথে বাধা, এমনটা মনে করে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘও। তাই সংঘের সন্তান হতে গেলে ছাড়তে হবে পরিবারের বন্ধন। ছেড়ে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি, ক্ষীণ করেছেন পারিবারিক বরাদ্দ সময়। ব্রহ্মচর্যে গেছেন, আর যাওয়ার পথে বাতিলের তালিকায় পড়ে গিয়েছেন যশোদাবেন মোদি। দেশ যাঁকে জানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সেই স্ত্রী হিসেবে, যার সঙ্গে বৈবাহিক কোনও দায়িত্ব-অনুভূতি কোনওদিন ভাগই করেননি নরেন্দ্র মোদি। সমাজ ভারতীয়, ফলে পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য, পতির পরিচয়ই ধরম ও করম। সহজ ভাষায় যশোদাবেন হয়েছেন স্বামী পরিত্যক্তা। আর নরেন্দ্র মোদি হয়েছেন দেশের রক্ষক।
দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছেন যশোদাবেন চিমনলাল মোদি। যিনি আসলে ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষিকা, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। জন্ম ১৯৫১ সালে। যশোদাবেনের যখন দুই বছর বয়স, তখন তাঁর মা মারা যান। মা হারা মেয়ে, গুজরাতের রক্ষণশীল নিম্নবিত্ত পরিবার- যা হওয়ার তাই হল। বিয়ে হয়ে গেল। ১৯৬৮ সালে যশোদাবেনের সঙ্গে বিয়ে করেন নরেন্দ্র মোদি। নরেন্দ্র মোদির ভাইয়ের মতে, নরেন্দ্র মোদির বয়স তখন সবে ১৮ এবং যশোদাবেনের বয়স তখন প্রায় ১৭। অত্যন্ত অল্প বয়সে ভাদনগরে পরিবারের উদ্যোগে ছোট্ট একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান করে বিয়ে হয়ে যায় যশোদাবেন আর নরেন্দ্র মোদির। মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালেই সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসেন মোদি, আরএসএসের প্রচারক হয়ে কাজ করবেন বলে। ফলে বিয়ের ঘ্রাণ ফিকে হওয়ার আগেই স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগই ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মজার এবং মুশকিলের বিষয় হল, বিয়ের পুরো অধ্যায়টিই চেপে গেলেন নরেন্দ্র মোদি। ২০১৪ সালের ভারতীয় লোকসভা নির্বাচনের আগে আইনি কারণে দরকার না পড়া অবধি প্রকাশ্যে বিয়ের কথা স্বীকার করেননি মোদির।
প্রায় দুই বছর ঘর সংসারের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না নরেন্দ্র মোদির। ২ বছর পর মোদি ভাদনগরে ফিরে আসেন এবং পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিয়ের পরপরই স্বামী যদি বেরিয়ে যায়, শ্বশুরবাড়িতে বধূটির আর কীই বা স্থান? ফলে যশোদাবেন চলে এসেছিলেন নিজের বাপের বাড়ি। ফিরে আসার পরে নরেন্দ্র মোদি ঠিক করেছিলেন, আহমেদাবাদে কাকার কাছে যাবেন। সেখানে কাকার সঙ্গে ক্যান্টিনে কাজ করবেন। নরেন্দ্র মোদির মা, মানে শাশুড়ি হিরাবেনের পীড়াপীড়িতে যশোদাবেন তাঁদের বিয়ে টিকিয়ে রাখতে সেই সময় ফের পরিবারে ফিরে আসেন। কিন্তু স্বামী নরেন্দ্র মোদির জানিয়ে দেন, সংসার টংসার নয়, নিজের জীবন নিজের শর্তে বাঁচবেন তিনি। যশোদাবেনকেও নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বলেন নরেন্দ্র।
আরও পড়ুন-১৯৭১-এ সংসার ছেড়েছিলেন মোদি! প্রধানমন্ত্রীর বাকি পরিবারের কথা কেন জানেই না দেশ
যশোদাবেন জানিয়েছিলেন, সেই সময় নরেন্দ্র তাঁকে বলেন, তাঁর রয়েছে কর্ম, তাঁর রয়েছে বিশ্বলোক। "আমি সারা দেশ ঘুরব, যেখানে খুশি সেখানে যাব; তুমি আমার সঙ্গে গিয়ে করবে টা কী?” নিজের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে বলেছিলেন মোদি। ফলে ফের চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নেন যশোদাবেন। যশোদাবেন অবশ্য স্বামীর সঙ্গে যেতেই চেয়েছিলেন। পরে অনেকবার যখন শ্বশুরবাড়ির অনুষ্ঠানে বা কোনও বিশেষ দরকারে যশোদাবেন সেখানে গেছেন, নরেন্দ্রকে পাননি। আস্তে আস্তে শ্বশুরবাড়ি যাওয়াও কমিয়ে দেন তিনি, নিজের বাপের বাড়িতেই থেকে যান। তবে জানা যায়, আরএসএস বা তাঁর রাজনৈতিক আগ্রহের সম্পর্কে কখনও যশোদাবেনের সঙ্গে কোনও আলোচনা করেননি মোদি। যশোদাবেন জানিয়েছিলেন, তাঁদের চূড়ান্ত বিচ্ছেদের আগে তিন বছরের সময়কালে স্বামী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মোট প্রায় তিন মাস সময় কাটিয়ে ছিলেন।
বাপের বাড়িতে ফিরে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যান যশোদাবেন। ১৯৭২ বা ৭৪ নাগাদ স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন। ১৯৭৬ সালে শিক্ষক প্রশিক্ষণ শেষ করেন এবং ১৯৭৮ সালে শিক্ষিকা হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বানাসকাঁথা জেলায় শিক্ষকতা করেছেন যশোদাবেন। ১৯৯১ সালে রাজোসানা গ্রামে চলে আসেন এবং সেখানেই থেকে যান। অবসরের পর পেনশন দিয়েই চলে সংসার। মোদির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে, এক সাক্ষাত্কারে যশোদাবেন বলেছিলেন, "আমাদের আর কখনই যোগাযোগ হয়নি... তাঁর তরফ থেকে আজ পর্যন্ত কোনও যোগাযোগ করেননি।"
রাজনৈতিক ফর্মে যখন জীবনসঙ্গীর নাম লেখার অপশন এসেছে মোদি বারবারই স্বামী-স্ত্রীর তথ্য বিভাগটি ফাঁকা রেখেছিলেন। রাজনৈতিক সমাবেশেও মোদি বলেছিলেন, তিনি অবিবাহিত। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে, মোদি ভাদোদরা আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের অধীনে বলা হয়, ধোঁয়াশা রাখা যাবে না। বিবাহ সম্পর্কে স্পষ্ট করে জানাতে হবে, পূর্ববর্তী কোনও বিয়ে থাকলে তাও লিখতে হবে। সেই সময় প্রথম জনসাধারণ এবং মিডিয়ার কাছে মোদি স্বীকার করেন তাঁর একজন স্ত্রী ছিলেন।
মোদির সঙ্গে বিয়ের খবর প্রকাশ্যে আসামাত্রই চারিদিকে সন্ধান চলতে থাকে যশোদাবেনের। দেখাও মেলে তাঁর। তবে প্রচণ্ড দ্বন্দ্বে পড়ে যান যশোদাবেন, জানান স্বামীর বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না তিনি কারণ নরেন্দ্র মোদি খুব শক্তিশালী। তিনি মুখ খুললে পরিণতি কী হবে ভেবে ভয় পেয়েছিলেন যশোদাবেন। নরেন্দ্র মোদির ভাই সোমভাই মোদি বিবৃতি জারি করে জানিয়েছিলেন, সেজো ভাই নরেন্দ্র মোদির বিয়েটি বাড়ি থেকে জোর করে দেওয়া। বিয়েটি সম্পন্নই হয়নি। যশোদাবেন নিজে জানিয়েছিলেন, নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, আমন্ত্রণ করলে তিনি যেতেন। "আমি তাঁর সঙ্গে থাকতে চাই। যদি তিনি আমাকে ডাকেন, আমি তাঁর সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করতে আগ্রহী। কিন্তু তাঁকেই ডাকতে হবে,” ২০১৪ সালে বলেছিলেন যশোদাবেন।
আরও পড়ুন- মোদি নন, বাজপেয়ীই প্রকৃত বিজেপি! অটল বিহারীর স্মৃতিসৌধে গিয়ে কোন বার্তা দিলেন রাহুল?
২০১৪ সালের মে মাস থেকে যশোদাবেনকে পুলিশি সুরক্ষা দিতে শুরু করে প্রশাসন। বিশেষ সুরক্ষা গোষ্ঠী আইন অনুযায়ীই এই নিরাপত্তা মেলে, এই আইনেই বলা রয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীকে পুলিশ সুরক্ষা দিতে হবে। মন্ত্রীদের বেতন ও ভাতা আইন অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীরা যা ভাতা পান, তা দিতে হবে। ওই বছরই নভেম্বর মাসে যশোদাবেন প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হিসেবে তাঁর নিরাপত্তা এবং অধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে তথ্যের অধিকার আইনে একটি আবেদন দায়ের করেন। জানা যায়, সেই সময় সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে যশোদাবেনকে কথা বলতে বাধা দিতেন ওই নিরাপত্তারক্ষীরা। নিরাপত্তার নামে এ এক নজরদারি বলেই মনে করেছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আসলে, অবসরপ্রাপ্তা সামান্য শিক্ষিকার চেয়ে বড় হয়ে গিয়েছে নরেন্দ্র মোদির 'স্ত্রী' পরিচয়টিই, এমনটাই তো হয়ে থাকে। 'স্বামী পরিত্যক্তা', 'বিবাহ বিচ্ছিন্না' এসব পরিচয়ের আড়ালে কতিপয় চরিত্র উঠে এসে ধক দেখাতে পারে। বাকিরা, যশোদাবেন হয়ে যান। আর নরেন্দ্র মোদিরা, কর্ম, বিশ্বলোক দাপিয়ে বেড়ান- ঝোলা উঠাকে যে কোনও সময় চাইলে বেরিয়ে পড়া যায় তাঁদের।