মোদি নন, বাজপেয়ীই প্রকৃত বিজেপি! অটল বিহারীর স্মৃতিসৌধে গিয়ে কোন বার্তা দিলেন রাহুল?

Bharat Jodo Yatra: বাজপেয়ী নিজেই একবার একটি সাক্ষাত্কারে জানিয়েছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা করাতে তাঁকে কীভাবে সাহায্য করেছিলেন রাজীব গান্ধী।

ভারতকে জুড়তে জুড়তে এগিয়ে চলেছেন রাহুল গান্ধী। মাঝে মাঝে বিরতি নিচ্ছেন, যাত্রায় জুড়ে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ, বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। গৈরিক রথ নয়, দলীয় পতাকার আগে এখানে উড়ছে ভারতের তেরঙ্গা। এই ভারত জোড়ো যাত্রাকে দেশের অখণ্ডতার যাত্রা বলেই ডেকেছে কংগ্রেস, ভালোবাসার, পারস্পরিক শ্রদ্ধার যাত্রা হিসেবেই দেখছে ভারতের এই সুপ্রাচীন রাজনৈতিক দল। সোমবার ভারত জোড়ো যাত্রায় সাময়িক বিরতি নিয়ে এই পারস্পরিক শ্রদ্ধার নজির তুলে ধরেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। মহাত্মা গান্ধী, দলিত নেতা জগজীবন রাম এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সহ দিল্লিতে বেশ কয়েকজন নেতার স্মৃতিসৌধে সময় কাটিয়েছেন তিনি। এই স্মৃতিসৌধের মধ্যেই অন্যতম সদৈব অটল, নরেন্দ্র মোদির আগে বিজেপির একমাত্র প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর স্মৃতিসৌধ।

বাজপেয়ীর সময়ের গেরুয়া দল আর নরেন্দ্র মোদির সময়ের বিজেপি- পংক্তিতে পংক্তিতে ফারাক। ভারতের রাজনৈতিক সুরে এই বিজেপি এক বেখাপ্পা উচ্চগ্রাম বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। রাজনৈতিক আদর্শের বিরোধিতা আর হিংসাত্মক ও ক্ষতিকারক রাজনীতির মধ্যেখানের ফারাক অটলের আমল থেকে কতখানি প্রকট এ বুঝতে অবশ্য বিশ্লেষক না হলেও চলে। কিন্তু উচ্চগ্রামের এই গেরুয়াতন্ত্রে কেন বিজেপির অটলবিহারীকে শ্রদ্ধা নিবেদন রাহুলের? রাহুল বিজেপি এবং আরএসএসের বিরুদ্ধে আক্রমণের সামান্য সুযোগটুকুও ছাড়েননি কোনওদিন। রাজনীতিবিদরা বলেন, রাহুলের রাজনীতির 'আভিজাত্য' ভারতের স্বাস্থ্যের পক্ষে বেমানান। রাহুল যে আদর্শ দিয়ে ভারতকে দেখেন তা এই জমানায় ভারতের সমাজে চার আনাও খুঁটে খেতে পারবে না। বিজেপি বিরোধী রাজনীতি তাহলে কেন অটল বিহারী বাজপেয়ীর কাছে এসে নরম হল? বিষয়টিকে কয়েকটি ভাগে খতিয়ে না দেখলেই নয়।

'জোড়ো জোড়ো, ভারত জোড়ো'

রাহুলের নেতৃত্বে সারা দেশ জুড়ে চলতে থাকা 'ভারত জোড়ো যাত্রা'-র লক্ষ্য হল ভারতকে একত্রিত করা, একত্রিত হওয়া এবং দেশকে শক্তিশালী করা। সোমবার কংগ্রেস জানিয়েছে, অটল বিহারী বাজপেয়ীর স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন আসলে এই একত্রিত হওয়ার চেতনার সঙ্গেই জড়িত। কংগ্রেসের মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনাতে জানিয়েছেন, রাহুলের এই সফর বুঝিয়ে দিচ্ছে রাজনীতি করতে গেলে 'বড় দিল' লাগে। মিছিল চলাকালীন, বিজেপি কর্মীদের মুখোমুখি হলে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ গালিগালাজ করলে, রাহুল তাদের দিকে চুম্বন ছুঁড়ে দেন। অর্থাৎ ভারত জোড়ো যাত্রা বিজেপির ঘৃণার বাজারে লাখো লাখো 'মোহাব্বত কি দুকান'-এর জন্ম দিয়েছে, মনে করছে কংগ্রেস।

আরও পড়ুন- ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ বুঝতেন অটল বিহারী, বাজপেয়ীর বিজেপির থেকে কোথায় আলাদা মোদির বিজেপি?

নরমপন্থাই কংগ্রেসের মূলধন?

কংগ্রেসের মধ্যে রাহুল নিজেকে কট্টরপন্থী অবস্থানেই রেখেছিলেন। কংগ্রেস নেতারা দল ত্যাগ করে বিজেপিতে চলে যাওয়া নিয়ে রাহুল হামেশাই বলেছেন, যারা বিজেপি এবং আরএসএসকে ভয় পায় তাদের তিনি ধর্তব্যেই আনেন না। কংগ্রেসের মধ্যে অনেকেই বলছিলেন, দলকে আরেকটু নরম হতে হবে। দলের চিরাচরিত নরমপন্থা দিয়ে মন জয়ের স্ট্র্যাটেজিকে ভুলে গেলে চলবে না। রাহুল সম্ভবত ভারত জোড়ো যাত্রাতে সেই পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত দিচ্ছেন।
দিল্লিতে ভারত জোড়ো যাত্রার সময় লাল কেল্লার সামনে বক্তৃতায় বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রাহুল রুটিরুজির সমস্যাকেই সামনে এনেছেন। রাহুল দলীয় অবস্থান সাফ করে জানিয়েছেন, বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতির পিছনে আসল উদ্দেশ্য হলো সাধারণ মানুষের জীবনকে রোজ প্রভাবিত করে এমন সমস্যাগুলি থেকে জনগণের মনোযোগ সরিয়ে দেওয়া। ঠিক একবছর আগেই, ২০২১ সালের শীতকাল এই রাহুলই ছিলেন অন্য। মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে একটি সমাবেশের মঞ্চ থেকে তিনি 'হিন্দু বনাম হিন্দুত্ববাদী' নিয়ে বিতর্ক শুরু করেছিলেন।

ভোট না আসুক, সমর্থন বাড়ুক

২০১৪ এবং ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে, কংগ্রেসের ভোট ১৯ শতাংশের সামান্য বেশি ছিল। কংগ্রেস মনে করছে, এই ভোট আরও ১০ শতাংশ মতো বাড়াতে হলে সেই সব মানুষের সমর্থন দরকার যারা ইউপিএর শেষদিকের সময়কালে বিজেপিকে সমর্থন করা শুরু করে। এমন নয় যে মানুষ বিজেপির নীতিকে সমর্থন করে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, দুর্নীতি এবং নীতিহীনতায় ধুঁকতে থাকা কংগ্রেস থেকে বাঁচতে বিজেপির হিন্দুত্ব এজেন্ডায় আকৃষ্ট হয়েছেন অনেকেই। সমস্ত বিজেপি ভোটাররাই বিজেপি বা প্রধানমন্ত্রী মোদির অন্ধ সমর্থক নন, বিশ্বাস কংগ্রেসের।

হিন্দুত্ববাদী মোদি বনাম 'মধ্যপন্থী' বাজপেয়ী

আরএসএসের বংশের সন্তান হলেও বাজপেয়ী ছিলেন একজন কবি এবং প্রধানমন্ত্রী! অটলবিহারী সেই পুরনো জমানার রাজনীতিবিদদের একজন যাঁরা দূরদর্শী, সস্তার হার-জিতের ম্যাজিকে যাঁদের আস্থা নেই। আসলে জোট সরকার চালাতে গেলে নরমভাবে চলা ছাড়া বাজপেয়ীর কাছে তেমন বিকল্পই বা ছিল কই? ১৯৯৮ থেকে ২০০৪-এর মধ্যে, যখন বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ ক্ষমতায় ছিল, অনেক ক্ষেত্রেই গেরুয়া দল এবং কংগ্রেসের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। সনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস বাজপেয়ীর সরকারকে 'অদক্ষ, অসংবেদনশীল, দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত' বলে অভিহিত করায় তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন অটল।

আরও পড়ুন- অলক্ষ্যেই ম্যাজিক করছেন রাহুল! হিংসার বিরুদ্ধে মানুষকে জুড়বে ভারত জোড়ো যাত্রাই?

তবে রাজনীতির বাজারে মোদির উত্থানের ঘটার পর থেকেই বাজপেয়ীর নরম বিজেপি ব্র্যান্ডের প্রশংসা করতে শুরু করে কংগ্রেস। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। উত্তর প্রদেশে একটি নির্বাচনী সমাবেশে তখন সনিয়া বলেছিলেন, “দেশ অনেক প্রধানমন্ত্রীকে দেখেছে। তাঁরা সম্মানীয় মানুষ। এমনকী বিজেপির অটল বিহারী বাজপেয়ীও প্রধানমন্ত্রীর পদের মর্যাদা বজায় রেখেছিলেন।” ২০১৮ সালে "বাজপেয়ীজি, আডবাণীজি, যশবন্ত সিংজি"-কে অপমান করার জন্য মোদি-শাহ নেতৃত্বাধীন বিজেপিকে নিশানা করেন রাহুল। উগ্র বিজেপি বনাম নরম বিজেপির মধ্যে কংগ্রেসের পাল্লা চিরকালই বাজপেয়ীর দিকেই ঝুঁকে।

পুরাতন প্রেম

বাজপেয়ী নিজেই একবার একটি সাক্ষাত্কারে জানিয়েছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা করাতে তাঁকে কীভাবে সাহায্য করেছিলেন রাজীব গান্ধী। “আর্থিক ব্যবস্থা করা আমার পক্ষে কঠিন ছিল। কোনওভাবে রাজীবজি বিষয়টি জানতে পারেন। তিনি আমাকে ডেকেছিলেন, এবং তিনি আমাকে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। আমি একজন পূর্ণাঙ্গ সদস্য হলাম, চিকিৎসার যাবতীয় খরচ সরকার দেবে। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছিলাম,” বলেছিলেন বাজপেয়ী।

অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং বিরোধী নেতাদের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক বজায় রাখতে হয়, বিদেশের সরকারের সঙ্গে, জোট শরিকদের সঙ্গে এবং সর্বোপরি নিজের রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে যে শ্রদ্ধা এবং সৌজন্যের যে নজির বাজপেয়ী গড়েছিলেন মোদির ভারত কি মনে রেখেছে সেই নম্র বুদ্ধিদীপ্ত বিজেপিকে?

More Articles