ভাইদের ছেড়ে পাণ্ডবপক্ষে! ধৃতরাষ্ট্র-পুত্র হয়েও কেন এত অবহেলিত যুযুৎসু
Mahabharat Yuyutsu: ভারতের অস্থির সময়েও, আদর্শহীনতার খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে যে চরিত্রের কাছ থেকে আজও ন্যায়পরায়ণতা ও আদর্শে অবিচল থাকার শিক্ষা নেওয়া যায়, তিনি যুযুৎসু।
বড় বীর ছিলেন কিন্তু সারা জীবন পেয়েছেন শুধু উপেক্ষা ও বঞ্চনা। মহাভারতের নানা রথী-মহারথীদের ভিড়ে যেন হারিয়েই গিয়েছেন, অথচ মহাভারতে তাঁর অস্তিত্ব ও প্রভাব ছিল যথেষ্টই। তিনি না থাকলে হয়তো মহাভারতের গল্পটাই অন্য রকম হত। মহাভারতের এক উপেক্ষিত মহানায়ক যুযুৎসু, সারা জীবন থেকেছেন ন্যায় আর ধর্মের পথে।
মহাভারতের কথা অমৃতসমান। যেমন তার বিস্তার, তেমনই বিচিত্র তার চরিত্রসমূহ। মহাকাব্যটি পৌরাণিক সময় ধারণ করে আছে বটে কিন্তু আজকের দিনেও তাকে মনে হয় আধুনিক। তাই সমকালের আলোকে যুযুৎসুর মতো চরিত্রকে বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আপাতশান্ত, ধীর স্থির অথচ মহাপরাক্রমশালী মহানায়ক যুযুৎসু মহাভারতের শেষ পর্বেও রয়ে গিয়েছিলেন উপেক্ষিত। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র হয়েও সারা জীবন বয়ে বেরিয়েছেন অবহেলা। বিকর্ণও শেষ পর্যন্ত ন্যায়ের পথ থেকে সরে গিয়ে দুর্যোধনের সঙ্গেই ছিলেন। যুযুৎসুই ছিলেন একমাত্র কৌরব যিনি স্রোতের বিপক্ষে হেঁটে ধর্মের পথে গিয়েছিলেন। তাই তাঁর জন্য এই শতক কি রেখে যাবে না সামান্য সহানুভূতি আর বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য?
“আর্যসমাজে যত কিছু জনতি ছড়াইয়া পড়িয়াছিল তাহাদিগকে তিনি (ব্যাস) এক করিলেন। জনশ্রুতি নহে, আর্যসমাজে প্রচলিত সমস্ত বিশ্বাস, তর্কবিতর্ক ও চরিত্রনীতিকেও তিনি এই সঙ্গে এক করিয়া একটি জাতির সমগ্রতার এক বিরাট মূর্তি এক জায়গায় খাড়া করিলেন। ইহার নাম দিলেন মহাভারত। ... ইহা কোনও ব্যক্তিবিশেষের রচিত ইতিহাস নহে, ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস।”
‘ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা’- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রাজশেখর বসু তাঁর মহাভারত সূচিত করেছেন এই কথাগুলো দিয়েই। একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস বলেই সমকালের আলোকে এর ঘটনা পরম্পরা ও চরিত্রে আলোকপাত প্রয়োজন, যে কারণেই যুযুৎসু আজও প্রাসঙ্গিক।
আরও পড়ুন- মহাভারতে সতীত্বের কোনও চিহ্ন নেই, বলেছিলেন রাধাপ্রসাদ গুপ্ত
জন্মবৃত্তান্ত
ধৃতরাষ্ট্রের সন্তানলাভের ইচ্ছা অদৃষ্টের খেয়ালে বার বার বিঘ্নিত হচ্ছিল। তখন হস্তিনাপুরে এসেছিলেন বশিষ্ঠ মুনির প্রপৌত্র ও পরাশর মুনির পুত্র জ্ঞানান্বেষী ঋষি ব্যাসদেব। ধৃতরাষ্ট্রজায়া গান্ধারী ব্যাসদেবের যথাসম্ভব সেবা করেছিলেন এবং তাঁর পুত্রলাভের ইচ্ছা ব্যাসদেবকে জানিয়েছিলেন। গান্ধারীর আতিথ্যে খুশি হয়ে ব্যাসদেব তাঁকে শতপুত্রের বর দিয়েছিলেন।
অন্যদিকে ধৃতরাষ্ট্রও সন্তানলাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। কারণ গান্ধারীর গর্ভধারণের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছিল। বংশরক্ষার তাগিদে ধৃতরাষ্ট্র বৈশ্য দাসী সুগধার (মতান্তরে সৌবলী) সঙ্গে মিলিত হন।
যথাসময়ে গান্ধারী ও সুগধা নামের দাসীটি গর্ভবতী হলেন। গান্ধারীর উদর এতই বড় হয়েছিল যে স্বর্গের দেবতারাও আশঙ্কিত হয়েছিলেন গান্ধারী ও গর্ভের সন্তানদের জীবন নিয়ে। কিন্তু ব্যাসদেবের মতো মহাঋষির বর বিফলে যেতে পারে না!
গান্ধারীর গর্ভপাত হওয়ার পর, গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা মাংসপিণ্ড থেকে ব্যাসদেব ১০১টি ভ্রূণ আলাদা করে ১০১টি ঘিয়ের কলসিতে রাখলেন। প্রথম কলসি থেকে জন্ম নিয়েছিলেন দুর্যোধন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাঁর কান্নার আওয়াজ শুনে পৃথিবীর সবকটি জঙ্গলের ভয়ঙ্কর পশুরা একযোগে চিৎকার করে উঠেছিল। যা ছিল অত্যন্ত অশুভ লক্ষণ।
দুর্যোধনের জন্মের এক মাস পরে বাকি ১০০টি কলসি থেকে জন্ম নিয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের এক কন্যা এবং আরও নিরানব্বই জন পুত্র। কন্যার নাম ছিল দুঃশলা। একই সময় দাসী মা সুগধার গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন মহাভারতের উপেক্ষিত বীর যুযুৎসু। যিনি কৌরব হওয়া সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র হওয়ার কৌলীন্য পাননি কোনও দিন। হস্তিনাপুর দাপিয়ে বেড়াতেন দুর্যোধন ও তাঁর ৯৯ ভাই। যুযুৎসুর জীবন কেটেছে একা, দাসীপুত্র হওয়ার অপরাধে।
পাণ্ডবদের পক্ষে যুযুৎসু
পরিচারিকার গর্ভজাত যুযুৎসু ছিলেন ধার্মিক এবং ন্যায়পরায়ণ। ধর্মের পথে থাকার জন্য তিনি তাঁর পারিবারিক বন্ধনও ত্যাগ করেছিলেন।
মহাভারতের যুদ্ধকে বলা হয় ধর্মযুদ্ধ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে যুযুধান দু’পক্ষের সমস্ত কুশীলবকে যে কোনও একটি পক্ষ অবলম্বনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। এই ঘোষণা শুনেই যুযুৎসু কৌরবপক্ষ ত্যাগ করে ধর্ম ও ন্যায়ের জন্য পাণ্ডব শিবিরে যোগদান করেন।
এছাড়াও, যুযুৎসু পাণ্ডবদেরকে, দুর্যোধনের ধূর্ত পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করে ভীমের জীবন রক্ষা করেছিলেন, যার মধ্যে বিষাক্ত জল পরিবেশনের কথাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। যুযুৎসু এবং বিকর্ণ উভয়েই দুর্যোধনের ষড়যন্ত্র এবং দুরভিসন্ধিকে ঘৃণা করতেন। কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় বিকর্ণ ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার কারণে কৌরব পক্ষ ছেড়ে যাননি এবং যুদ্ধে ভীমের হাতে নিহত হন।
যুযুৎসু ধর্ম রক্ষার জন্য কৌরব শিবির ত্যাগ করে পাণ্ডব শিবিরে যোগ দেন এবং পাণ্ডবদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করেন। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম মহারথী, (মহারথী হলেন এমন ব্যক্তি যিনি একসঙ্গে ৭,২০,০০০ সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সমর্থ)। যুদ্ধ শেষে কৌরবপক্ষের যে ১১ জন যোদ্ধা বেঁচেছিলেন তাঁদের মধ্যে যুযুৎসু অন্যতম। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সপ্তম দিনে, কুলগুরু কৃপাচার্যের সঙ্গে তাঁর প্রচণ্ড তলোয়ার লড়াই হয় এবং তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হন। তবে বেঁচে যান। ষোড়শতম দিনে যুযুৎসু শকুনির পুত্র উলুকের সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং তাঁকে আহত করেন। আহত হয়ে উলুক পালিয়ে যাওয়ার কারণে তাঁকে তিনি হত্যা করতে পারেননি।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে শ্রীকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর পাণ্ডবগণ পৃথিবী থেকে মহাপ্রস্থানের সিদ্ধান্ত নিলেন। তখন মহারাজ যুধিষ্ঠির যুযুৎসুকে হস্তিনাপুরের তত্ত্বাধায়কের দায়িত্ব দিয়ে অর্জুনের প্রৌত্র পরীক্ষিতকে হস্তিনাপুরের রাজা হিসেবে নিযুক্ত করেন।
আরও পড়ুন- পিটার ব্রুকের হাতে মহাভারত হয়ে উঠেছিল পৃথিবীর মহাকাব্য
কেন আজও প্রাসঙ্গিক যুযুৎসু?
কখনও নিজের বিবেকের সঙ্গে তঞ্চকতা করেননি যুযুৎসু। আমৃত্যু ছিলেন ন্যায়ের পথে। কৌরব হওয়া সত্ত্বেও ধর্ম ও অধর্ম বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল গভীর। তবুও মহাভারতের রথী মহারথীদের ভিড়ে চাপা পড়ে গিয়েছে এই অসামান্য ব্যক্তিত্বের অবদান।
আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে যুযুৎসুর বিচার করতে বসলে হয়তো ভুল হয়ে যাবে। মহাভারতের যুদ্ধ ১৯৬২-র চিন-ভারত যুদ্ধ নয় বা কারগিলের যুদ্ধ, সার্জিকাল স্ট্রাইক নয়। তাই এর পক্ষ নেওয়া বা না নেওয়ার সঙ্গে কুরুক্ষেত্রের তুলনা চলে না। যুযুৎসুর শিবির বদল নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে, তাহলে তো রামায়ণে বিভীষণকে রামচন্দ্রের শিবিরে যোগ দেওয়ার জন্যও দোষী বলতে হয়। যখন রাজসভায় যাজ্ঞসেনীকে অপমান করা হচ্ছে তখন তো নীরব ছিলেন ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্যরা, একমাত্র কণ্ঠ শোনা গেছিল ১০০ ভাইয়ের একজনের, যাঁর নাম বিকর্ণ। তিনিও সেইভাবে আলোচিত নন। এই ঘটনা পরম্পরাকে সামনে রেখে বলতে হয়, বিদুর, দ্রোণ, কৃপাচার্যরা সকলেই একই দোষে দুষ্ট। তাঁরা প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত ভাবে দুর্যোধনকে পছন্দ না করলেও হস্তিনাপুরের রাজ সিংহাসনের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন। তাই কৌরবরা অন্যায় করছে জেনেও কেন তাঁদের পক্ষ নিয়েছিলেন ‘মহামতি’রা? এ কি শুধুই সিংহাসনের প্রতি আনুগত্য?
সমকালের আলোয় দেখা যুযুৎসুর জীবন এককথায় ন্যায়-নীতির সহজপাঠ। ভারতের অস্থির সময়েও, আদর্শহীনতার খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে যে চরিত্রের কাছ থেকে আজও ন্যায়পরায়ণতা ও আদর্শে অবিচল থাকার শিক্ষা নেওয়া যায়, তিনি যুযুৎসু। মহাভারতের শেষপর্বেও উপেক্ষিত থেকে যাওয়া এই মহানায়ককে ফিরে দেখা তাই অবশ্যকর্তব্য।