আন্ডারগ্রাউন্ড রেডিও স্টেশন চালাতেন একাই, এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর কথা ভুলেছে দেশ

Usha Mehta Underground Radio: দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন ঊষা। তবু, তিনিই প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড রেডিও স্টেশন চালানোর ধারণাটি দলের অভ্যন্তরে জানান।

"ভারতের কোনও এক জায়গায় ৪২.৩৪ মিটার দূর থেকে কংগ্রেস রেডিও শুনছেন আপনারা।"

সাল ১৯৪২, দিনটা ১৪ অগাস্ট। ভারত তখনও স্বাধীনতার প্রত্যাশার খুব কাছেও নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ২২ বছরের এক তরুণীর কণ্ঠস্বর তখন সতর্ক করে দিচ্ছে ভারতকে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আস্ত একটা দেশ ফুঁসছে। চরম উত্তাল সময়েই বিপ্লবের সন্তান হয়ে জন্ম নিয়েছেন ঊষা মেহতা। আজীবন গান্ধীবাদী এই ঊষা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রেডিওর ব্যবহারকে চরম এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আন্ডারগ্রাউন্ড রেডিওস্টেশন চালিয়ে নিয়ে গেছেন প্রায় একাই। জেল খেটেছেন, অত্যাচার সয়েছেন- আন্দোলনের পথ তবু ছেড়ে যাননি কখনও।

জন্ম ১৯২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। বাবা ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় কর্মী। বাবার রাজনৈতিক জীবন দেখে ঊষা এতটাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যে তিনি শৈশব থেকেই রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। একেবারে খুদে বয়সে 'বানর সেনা' হয়ে অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে পুলিশের হাজতেও দিন কাটিয়েছিলেন ঊষা। রাজনীতির পরিবেশে বেড়ে ওঠা ঊষা ১৯৩৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন বা সেকালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। শুধু উত্তীর্ণ বললে অবশ্য ভুল বলা হয়, সেরা ২৫ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ইংরেজি, গুজরাতি, হিন্দি এবং মারাঠি- এই চারটি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন ঊষা। উইলসন কলেজে বিতর্ক ও বক্তৃতায় তার ধারালো অংশগ্রহণ ঊষাকে অনন্য করে তুলেছিল প্রতিদিন, একটু একটু করে।

আরও পড়ুন- আইনের পথে ব্রাত্য মহিলারা! দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রথম মহিলা বিচারপতি আজও আড়ালেই

দর্শনশাস্ত্রে ফার্স্ট ক্লাস। স্নাতক শেষে আইন নিয়ে স্নাতকোত্তর করার কথা। কিন্তু ভারত ছাড়ো আন্দোলন তখন জমাট বাঁধছে। দলের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং লড়াকু নেত্রীদের মুখ হয়ে উঠলেন ঊষা। আন্দোলনের পথে নেমে এমন জড়িয়ে পড়লেন ঊষা, আইনে স্নাতকোত্তরের পড়াশোনা আর হলো না। ১৯৪০-এর দশকে, ঊষা মেহতা কংগ্রেসের সদস্য হন এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলনের পরিকল্পনা ও তা কার্যকর করার লক্ষ্যে অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে মিলে কাজ শুরু করেন। দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন ঊষা। তবু, তিনিই প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড রেডিও স্টেশন চালানোর ধারণাটি দলের অভ্যন্তরে জানান।

ডঃ আলু জে দস্তুর 'উওমেন পাইওনিয়র্স ইন ইন্ডিয়াজ রেনেসাঁ' বইতে লিখেছেন, “যারা এটি শুনেছেন এবং যারা ট্রেন, ট্রাম এবং বাসে এটির বিষয়ে শুনেছেন তারা ১৯৪২ সালের ১২ নভেম্বর শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা এই রেডিও স্টেশন আঁকড়ে ছিলেন। তখন ঊষার কণ্ঠস্বরই শ্রোতাদের জানান দিয়েছিল যে পুলিশ রেডিও স্টেশনটিকে বাজেয়াপ্ত করেছে এবং কর্মীদের গ্রেপ্তারি এড়াতে ক্রমাগত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরে যেতে হচ্ছে তাঁদের।”

ঊষা মেহতা এবং তাঁর সহকর্মীরা মিলে এই রেডিও স্টেশনটি থেকে এমন সব খবরই প্রচার করতেন যা দেশের সরকারি সংবাদ সংস্থাগুলি ধামাচাপা দিত, সরকার নিষিদ্ধ করত। যে নেতাদের গ্রেপ্তারি থেকে বাঁচতে লুকিয়ে থাকতে হতো তারা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার এবং ভবিষ্যতের পদক্ষেপের বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতেন এই রেডিও স্টেশন। ধরা পড়ার পরে চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন ঊষা। পুণের ইয়েরভাড়া জেলে তাঁর স্বাস্থ্য একেবারেই ভেঙে পড়ে, চিকিৎসার জন্য জেজে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তাঁকে। রাজ্যের দ্বিতীয় কংগ্রেস সরকারের অধীনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোরাজি দেশাইয়ের নির্দেশে বম্বে প্রদেশে মুক্তি পাওয়া তিনিই প্রথম রাজনৈতিক বন্দি। জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ে রাজনীতি ছেড়ে শিক্ষার দিকেই সম্পূর্ণ রূপে এগিয়ে আসেন ঊষা।

পরবর্তী জীবনে বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন ঊষা মেহতা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নব-প্রতিষ্ঠিত বিভাগের প্রথম পিএইচডি পড়ুয়াদের মধ্যে একজন ছিলেন ঊষা। মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাধারা বিষয়েই গবেষণা করেছিলেন তিনি। ১৯৮০ সালে অবসর গ্রহণ করেন ঊষা।

আরও পড়ুন- প্রদীপের নিচে এত অন্ধকার? স্বাধীনতার ৭৫-এ কোথায় দাঁড়িয়ে ভারত

আজীবন শিক্ষা এবং সমাজে মহিলাদের অবস্থানের বিষয়ে নানা কাজে জড়িয়ে থেকেছেন ঊষা মেহতা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), গুজরাতের প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি এবং বম্বেতে শ্রীমতি নাথিবাই দামোদর ঠাকরে মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন ঊষা। জীবনের শেষ ২০ বছর মণিভবন গান্ধী সংগ্রহালয়কেই উৎসর্গ করেছিলেন ঊষা। পরে বম্বে গান্ধী স্মারক নিধির সভাপতিও হন ঊষা মেহতা। তাঁর অধীনে, মণিভবন ভারতের একমাত্র গান্ধী সংগ্রহালয় হয়ে ওঠে যা একটি বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা স্বীকৃত এবং স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে। মুম্বইতে মণিভবনের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন ঊষা। এই কেন্দ্রের লক্ষ্য ছিল ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রচার। এখন ভারত জুড়ে তো বটেই, বিদেশেও শাখা রয়েছে এই মণিভবন কেন্দ্রের।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সমাজে ঊষা মেহতার লড়াই ও অবদান স্বাভাবিক নিয়মেই ধামাচাপা পড়ে থাকে, মহিলাদের ব্যাপক অংশগ্রহণের কথা ব্যাপকভাবে কখনই লিখিত হয় না। ১৯৯৮ সালে পদ্মবিভূষণে ভূষিত হন ঊষা। আজীবন গান্ধীবাদী মূল্যবোধ ও আদর্শ প্রচারের জন্য লড়ে গিয়েছেন ঊষা। এমনকী মৃত্যুর ঠিক চরম মুহূর্তেও তিনি ছিলেন দেশের কাজে। নিজেই যেন নিজের মৃত্যুর দিনটি বেছে নিয়েছিলেন তিনি। দেশের জন্য ঊষা মেহতা কাজ শুরু করেছিলেন ১৯৪২ এর ৯ অগাস্ট, বম্বের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দান থেকে মহাত্মা গান্ধীর ভারত ছাড়ো আহ্বানের মাধ্যমে। ঠিক ৫৮ বছর পরে, ২০০০ সালে সেই একই মাঠে জাতীয় পতাকাকে অভিবাদন জানান ঊষা। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে ফিরে আসেন বাড়ি, ৪৮ ঘণ্টা পরেই মৃত্যু হয় তাঁর। ঊষা চলে যান, কিন্তু রেডিওতে তাঁর সেই স্বর জেগে থাকে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। জেগে থাকেন এমন অনেক ঊষারাই, যাদের অন্ধকার থেকে বেরনোর পথের কথা লিখে রাখতে ভুলে যায় সময়।

 

More Articles