আইনের পথে ব্রাত্য মহিলারা! দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রথম মহিলা বিচারপতি আজও আড়ালেই

Justice Fathima Beevi: ১৯৫০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত ভারতে নিযুক্ত ৪৬ জন প্রধান বিচারপতির মধ্যে একজনও মহিলা নন।

স্বাধীনতা এসেছে ১৯৪৭ সালে। আর ভারতে প্রথম শীর্ষ আদালতে কোনও মহিলাকে বিচারপতি হিসেবে দেখা গিয়েছে ১৯৮৯ সালে! মাঝের সময়কালে ভারতে প্রধানমন্ত্রীর পদে মহিলা নির্বাচিত হয়েছেন, অথচ আইনের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে বিচার বিভাগের দায়িত্বে আসেননি কোনও মহিলা। প্রথম মহিলা বিচারপতি হিসেবে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন ফাতিমা বিবি। উচ্চ বিচার বিভাগীয় কোনও পদে প্রথম মুসলিম মহিলাও ছিলেন ফাতিমাই। ভারতীয় ইতিহাসে এশিয়ার কোনও দেশে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হওয়া প্রথম মহিলা ছিলেন কেরলের এই মানুষটিই। 

জন্ম ১৯২৭ সালের ৩০ এপ্রিল। ত্রাভাঙ্কোরের (বর্তমানে কেরলের) পাথানামথিট্টায় খাদেজা বিবি এবং আন্নাভিটিল মীরা সাহেবের ঘরে জন্ম হয় ফাতিমা বিবির। ছয় বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়। ১৯৪৩ সালে ক্যাথলিকেট হাইস্কুল থেকে স্কুলের পড়াশোনার পাঠ শেষ করেন তিনি। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে আসেন ত্রিভান্দ্রমে। তিরুবনন্তপুরমের ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক হওয়ার পরে তিরুবনন্তপুরম সরকারি আইন কলেজ থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন ফাতিমা।

বিজ্ঞান নিয়েই আরও পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন ফাতিমা। কিন্তু তাঁর বাবা সম্ভবত আন্না চান্ডির (ভারতের প্রথম মহিলা বিচারক এবং ভারতের প্রথম মহিলা যিনি হাইকোর্টের বিচারক হন) সাফল্যে ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়েই মেয়েকে আইন নিয়ে পড়তে উৎসাহিত করেন। সেই সময় গোটা ক্লাসে আইনের ছাত্রী ছিলেন মাত্র ৫ জন। পরে অবশ্য সেই পাঁচজনও কমে যায়। শেষ অবধি পড়া চালিয়ে যান তিন ছাত্রী। ১৯৫০ সালে আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর বার কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ফাতিমা। সেই পরীক্ষায় সবাইকে পিছনে ফেলে প্রথম স্থান অধিকার করেন ফাতিমাই। বার কাউন্সিলের স্বর্ণপদকও জয় করেন তিনি।

আরও পড়ুন- গর্ভবতী অবস্থায় ৭ জনের গলা কেটে খুন! স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলার ফাঁসি দেখবে দেশ?

আইনজীবী হিসেবেই নিজের প্রাথমিক কর্মজীবন শুরু করেন ফাতিমা। ১৯৫০ সালের ১৪ নভেম্বর কেরলের নিম্ন বিচার বিভাগে কর্মজীবন শুরু করেন ফাতিমা। আট বছর পর, তিনি কেরলের অধস্তন বিচার পরিষেবাতে মুন্সিফের চাকরি নেন। বছর যেতে না যেতেই, তিনি কেরলের অধস্তন বিচারক (১৯৬৮-৭২), চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (১৯৭২-১৯৭৪), জেলা ও দায়রা জজ (১৯৭৪- ১৯৮০), বিচার বিভাগীয় সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে কেরল হাইকোর্টের বিচারপতি হন তিনি। তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে দাঙ্গা ও খুনের মতো বিভিন্ন সেশন এবং দেওয়ানি মামলা পরিচালনা করেছেন। কেরল হাইকোর্ট থেকে অবসর নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে, তিনি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন, প্রথম মহিলা হিসেবে। ১৯৮৯ সালের ৬ অক্টোবর বিচারপতি ফাতিমা বিবি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন।

২০১৬ সালের এক সাক্ষাত্কারে ফাতিমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভারতীয় বিচার বিভাগ পুরুষতান্ত্রিক কিনা। উত্তরে ফাতিমা স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, "একেবারেই তাই। এই ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।এখন আইনের ময়দানে অনেক মহিলাই আছেন। তবে তাদের অংশগ্রহণ খুবই কম। তাদের প্রতিনিধিত্ব পুরুষদের সমান নয়। এর একটা ঐতিহাসিক কারণও আছে। মহিলারা দেরিতে মাঠে নামেন। বিচার বিভাগে নারীদের সমান প্রতিনিধিত্ব পেতে সময় লাগবে।”

আরও পড়ুন- ঠাকুমার কাছেই আজীবন কৃতজ্ঞ রতন টাটা! টাটা সন্সের প্রথম মহিলা পরিচালক আজও আড়ালেই

১৯৯২ সালে সুপ্রিম কোর্ট থেকে অবসর নেওয়ার পর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য এবং কেরল কমিশন ফর ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসের চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ফাতিমা। শুধুই আইনের শীর্ষে থাকাই নয়, রাজনৈতিক আঙিনাতেও স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেরিয়েছেন ফাতিমা। ১৯৯৭ সালের ২৫ জানুয়ারি বিচারপতি ফাতিমা বিবি তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল হিসেবে নিযুক্ত হন। রাজীব গান্ধী হত্যা মামলায় চার দণ্ডিত বন্দির দায়ের করা আবেদন প্রত্যাখ্যান করে রাজ্যপাল হিসাবে তিনি বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তামিলনাড়ুর রাজ্যপালের পদের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নেওয়ার পর ফাতিমা কেরলে নিজের পৈতৃক বাড়িতেই ফিরে আসেন। বর্তমানে, নিজের রাজ্যেই অবসর পরবর্তী জীবনযাপন করছেন ভারতের শীর্ষ আদালতের এই প্রথম মহিলা বিচারপতি।

১৯৫০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে মাত্র আটজন মহিলা বিচারক নিযুক্ত হয়েছেন এবং ভারতের নিযুক্ত ৪৬ জন প্রধান বিচারপতির মধ্যে একজনও মহিলা নন। বিভিন্ন হাইকোর্টে কর্মরত ৬৭০ জন বিচারকের মধ্যে মাত্র ৭৩ জন নারী, মাত্র ১১%। ফাতিমা বিবি উদাহরণ, ফাতিমা অনুপ্রেরণা। কিন্তু ফাতিমার পথে এগনোর পরিস্থিতি ও সুযোগ পেতে যে লড়াই লড়তে হয় ভারতের মেয়েদের সেই লড়াইয়ে দরজাটুকুও দেখতে দেওয়া হয় না। প্রতি নারী দিবসে, 'মেয়েরা অনেক কিছুই করছে এখন' আসলে সেই কথাটিই ঘুরে ফিরে আসে, যেন কিছুই করার কথা ছিল না। করছে, এই তো ঢের!

More Articles