গোটা শহরকে চালায় কোচিং ক্লাস! একচিলতে ঘর থেকে যেভাবে দেশের কোচিং হাব হয়ে উঠল কোটা

Kota Coaching City: এই শহরে রয়েছে প্রায় ৩০০০ হোস্টেল এবং ২০০০০ পিজি যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবিকার ব্যবস্থা করেছে ২ লক্ষ মানুষের।

আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে একটি ওয়েব সিরিজ মুক্তি পায়, কোটা ফ্যাক্টরি। বলাই বাহুল্য, সিরিজটি মুক্তি পেতেই দেশের তরুণ দর্শক-শ্রোতার মধ্যে সাড়া ফেলে দেয়। কেন এত জনপ্রিয়তা? সিরিজটি রাজস্থানের কোটা শহরের আইআইটি-জেইই প্রার্থীদের কেন্দ্র করে নির্মিত। সিরিজটি আসলে কোটার অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ, এখানে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের লড়াই, আকাঙ্খার এক বুনন। এখানে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীদের কেবল একটাই স্বপ্ন, 'আইআইটি'। আর সেই স্বপ্নকে কেন্দ্র করে রাত দিন যুদ্ধ, দিন রাত মেহনত। কোটায় না থেকেও কোটার পরিবেশ এবং জীবনকে উপলব্ধি করেছেন মানুষ কোটা ফ্যাক্টরি দিয়ে। কিন্তু পর্দার বাইরেও এমন অনেক বিষয় আছে যা সাধারণ মানুষের কাছে অজানাই। কীভাবে আইআইটি ফ্যাক্টরি হয়ে উঠল কোটা?

কয়েক দশক আগে কোটা শহর খনন ও উৎপাদন কার্যের জন্য সারা দেশে যথেষ্ট পরিচিত এবং সমৃদ্ধ শিল্প শহর ছিল। কোটার মার্বেল সারা ভারতে সুপরিচিত এবং বিখ্যাতও। এখানে বেলেপাথর, চুনাপাথর, মার্বেল, ফসফেট পাথরের উৎপাদন হতো মূলত। এছাড়াও তামা এবং লিগনাইট কয়লার মতো বিভিন্ন খনিজ দ্রব্যের উত্তোলনও করা হতো। এরপর এক বিশাল বাঁক বদল। আশির দশকের শেষ দিক থেকে ধীরে ধীরে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিকেল প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কোটা শহর গোটা দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। এর নেপথ্যে রয়েছেন ভি কে বনসল, যাঁকে কোটার গডফাদার বলা হয়। পেশায় একজন প্রকৌশলী হলেও পরবর্তীতে কোটার জে কে সিনথেটিক্সে নিজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতেই ছাত্রদের পড়াতে শুরু করেন। মূলত গণিতের শিক্ষক ছিলেন ভি কে বনসল এবং ছাত্রদের ইঞ্জিনিয়ারিং প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য পড়াতেন।

আরও পড়ুন- বায়ুদূষণ ঠেকাতে এয়ার পিউরিফায়ার! অজান্তেই ডেকে আনছেন কোন বিপদ

তাঁর পড়ানো প্রথম ব্যাচ ছিল ১৯৮৩ সালের। সেই ব্যাচ থেকে তাঁর ছাত্ররা আইআইটি-জেইই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে, তাঁর নাম গোটা শহরে রটে যায়। তারপর থেকেই তাঁর কাছে কেবল শহরেরই নয় শহরের বাইরে থেকেও ছাত্র ছাত্রীরা পড়তে আসতে শুরু করেন। শোনা যায়, ভি কে বনসলের পড়ানোর ধরন এতটাই মনোগ্রাহী ছিল যে ছাত্রছাত্রীরা অন্য কোথাও পড়তে যেতে চাইতেনই না। শয়ে শয়ে ছাত্রছাত্রীর ভিড় লেগে থাকত কোটায় বনসলের কোচিং ক্লাসে। ধীরে ধীরে শহরের চেহারাও বদলাতে শুরু করে।

বনসল দেখলেন, ছাত্রছাত্রীরা আরও ভালো ফল করতে পারে, যদি ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রিও তাঁদের কেউ দেখিয়ে দেয়। এরপর তিনি নিজ উদ্যোগে নিজেরই বাড়িতে আরও দু'জন শিক্ষক নিয়োগ করলেন ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রির জন্য। এই ভাবেই কোটাতে প্রথম কোচিং সেন্টারের কাঠামো গড়ে উঠল একচিলতে ঘরের মধ্যে। এই শহর তখন কোচিং সেন্টারের আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানত না। তার পর সত্যিই এক ব্যাপক বাঁক বদল, সেই একচিলতে ঘর থেকেই আজ শয়ে শয়ে কোচিং ইনস্টিটিউট গড়ে উঠছে কোটায়।

বনসল ক্লাস, অ্যালেন ক্যারিয়ার ইনস্টিটিউট থেকে শুরু করে মোশন, রেজোন্যান্স এবং ভাইব্রেন্টের মতো আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কোটায় তাদের ভিত্তি স্থাপন করেছে। কোটার ৯০ শতাংশ মানুষের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ রোজগার এই কোচিং সেন্টার গুলোকে কেন্দ্র করেই। কেউ ইনস্টিটিউট খুলে ব্যবসা করছেন, তো কেউ সেই ইনস্টিটিউটেই পড়াচ্ছেন, কেউ সেখানেই অন্যান্য কাজ সামলানোর চাকরি করছেন। কেউ আবার সেই ইনস্টিটিউটের বাইরেই ক্যান্টিন খুলে বসেছেন, কেউ স্টেশনারি দোকান, কারও আবার পিজি, মেসবাড়ি। গোটা শহরের প্রাণ যেন এই ছাত্রছাত্রীরাই। কোটার প্রত্যেকটি বাড়িতেই মেস রয়েছে, প্রত্যেকটি বাড়িতেই তৈরি হয়েছে ছাত্রবাস। কোনও কোনও পরিবারের সমস্ত রোজগারই আসে মেসভাড়া থেকে। একটি বাড়ির একতলা ঘর থেকে শুরু হওয়া ক্লাস গোটা শহরের রূপ বদলে দিয়েছে।

আরও পড়ুন- মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই ডাক্তারির কোচিং! যেভাবে এ সমাজে গেঁড়ে বসলো টিউশন শিল্প

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ২ লক্ষ শিক্ষার্থী প্রতি বছর কোটা শহরে পড়তে আসে এবং বিভিন্ন কোচিং ইনস্টিটিউটে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করে। বলা হয়, ভোরের পাখি ডাকার আগেই এখানকার ছাত্রছাত্রীদের ঘুম ভেঙে যায়। অ্যালেনের কেমিস্ট্রি শিক্ষক অনিরুদ্ধ শ্রীধরন কোটায় ক্লাসের সময়কাল সম্পর্কে কিছু তথ্য জানিয়েছিলেন, কোটায় যেকোনও ইনস্টিটিউটেই মূলত দু'টি শিফ্টে ক্লাস হয়ে থাকে। একটি সকালের, একটি রাতের। ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের সুবিধা মতো এই সময় বেছে নেন। যেমন অ্যালেন ইনস্টিটিউটে সকালের পড়াশোনা শুরু হয় ভোর ৬টা থেকে এবং চলে দুপুর ১টা অব্দি। আবার পরবর্তী ক্লাস শুরু হয় বিকেল ৩টে থেকে এবং চলে রাত ৮টা পর্যন্ত।

তালওয়ান্দি এবং বিজ্ঞান নগর এই শহরের প্রধান দু'টি এলাকা। এখানে মূলত ছাত্রদের পিজি দেখতে পাওয়া যায়। এখানে থাকা-খাওয়ার জন্য সাধারণত মাথাপিছু প্রতি মাসে ৬০০০ টাকা কম করে লাগেই। বর্তমানে এই শহরের শিক্ষাকাঠামো গোটা দেশের শিক্ষাবিদদের আকর্ষণ করছে। এই শহরে রয়েছে প্রায় ৩০০০ হোস্টেল এবং ২০০০০ পিজি যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবিকার ব্যবস্থা করেছে ২ লক্ষ মানুষের। কোটা শহরে প্রতিবছর হাজার হাজার ছেলে মেয়ে আসে, থাকে, পড়াশোনা শুরু করে, আবার হাজার হাজার ছেলে মেয়ে এই শহর ছেড়ে চলেও যায়। তবে পড়ুয়ারা কোটা থেকে চলে গেলেও কোটা তাঁদের মধ্যে আজীবন থেকে যায়। অনেকেই বলেন, যে পড়ুয়া এই শহরে দু'বছর পড়াশোনা করে বেরিয়ে এসেছেন জীবনে ঠিক কিছু না কিছু তিনি করেই নেবেন।

More Articles