বিষে হার মানাবে গোখরোকে, পশ্চিমবঙ্গেও হানা দিচ্ছে এই মারাত্মক পোকা
অ্যাসিডপোকা বা নাইরোবি ফ্লাই। কেনিয়া, নাইরোবি-সহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এদের দেখা মেলে। এমনকী, বিশ্বজুড়ে ক্রান্তীয় অঞ্চলগুলিতে এদের দেখা পাওয়া যায়। তাহলে কি পশ্চিমবঙ্গে এদের দেখা পাওয়া সত্যি-ই অস্বাভাবিক বা ভয়ের?
শোনা যায়, গোখরোর বিষের থেকেও বেশি মারাত্মক এই পোকার শরীরে থাকা বিষ। একবার রক্তে মিশলে একাধিক শারীরবৃত্তীয় কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সেই পোকাকে নিয়েই সাম্প্রতিকে হঠাৎ হইচই পড়ে গিয়েছে। পোকাগুলিকে দেখা গিয়েছে উত্তরবঙ্গ-সহ পশ্চিমবঙ্গের নানা অঞ্চলে। এমনকী, পশ্চিমবঙ্গের সীমানা বরাবর বিহারের কিছু অঞ্চলেও।
পোকাটির নাম, অ্যাসিডপোকা বা নাইরোবি ফ্লাই। কেনিয়া, নাইরোবি-সহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এদের দেখা মেলে। এমনকী, বিশ্বজুড়ে ক্রান্তীয় অঞ্চলগুলিতে এদের দেখা পাওয়া যায়। তাহলে কি পশ্চিমবঙ্গে এদের দেখা পাওয়া সত্যি-ই অস্বাভাবিক বা ভয়ের?
বিশেষ কিছু অঞ্চলে নাইরোবি ফ্লাইয়ের উৎপাত একটি বেশি-ই চোখে পড়ে, যার মধ্যে অন্যতম উষ্ণ-আর্দ্র অঞ্চল। ধারণা করা হয়, আর্দ্রতা বেশি থাকার কারণে এরা চট করে শুকিয়ে মারা যেতে পারে না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিভাগের গবেষক সুপ্রতিম লাহা জানাচ্ছেন, "পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বরাবরই এই পোকার দেখা মেলে। বর্ষাকালে গাছপালা বেড়ে যাওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন পোকার মতোই নাইরোবি ফ্লাইয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। এমনকী, কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলেও এদের দেখা মাঝেমধ্যেই পাওয়া যেত কিছু বছর আগেও।"
আরও পড়ুন: মাঙ্কিপক্স আতঙ্কের আঁচ ভারতেও, যৌন সম্পর্ক থেকেই সংক্রমণ? চিন্তায় চিকিৎসকরা
কিন্তু হঠাৎ এই পোকার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ কী?
"এই বছর উত্তরবঙ্গে বৃষ্টি আগেভাগেই শুরু হয়েছে। হয়তো সেই কারণে ঝোপঝাড় দ্রুত বেড়ে ওঠায় এদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে"; সুপ্রতিম লাহা জানাচ্ছেন, "পাশাপাশি এই পোকাদের খায় যেসব প্রাণী (মূলত পাখি), হয়তো তাদের সংখ্যা কমে যাওয়ায়, নাইরোবি ফ্লাইয়ের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে গিয়েছে। ফলে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়েছে। সঠিক গবেষণা ছাড়া, হঠাৎ এই পোকার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ বলা এখনই সম্ভব নয়। তবে বর্ষাকালে এদের দেখা পাওয়া একেবারেই অস্বাভাবিক নয়।"
আশার বিষয় হলো, এই পোকাগুলি কিন্তু মানুষকে কামড়ায় না। ত্বকে জ্বালা তখনই শুরু হয়, যখন এই পোকাগুলিকে ত্বকের ওপর আমরা পিষে ফেলি। কারণ তখনই এদের শরীর থেকে পেডেরিন নামের বিষ নির্গত হয়। এই বিষ থাকে হিমোলিম্ফে। হিমোলিম্ফ যে কোনও পতঙ্গের শরীরে থাকে। উন্নত প্রাণীর শরীরের রক্তের সঙ্গে তুলনা করা যায় হিমোলিম্ফকে। তবে পেডেরিন কিন্তু নাইরোবি ফ্লাইয়ের শরীরের নিজস্ব শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার ফলে তৈরি হয় না। এটি তৈরি হয় পোকাটির শরীরে বাসা বাঁধা একপ্রকার ব্যাকটেরিয়া থেকে।
আর সেই বিষই ত্বকের সংস্পর্শে এলে জ্বালাভাব দেখা যায়। তবে এক্ষেত্রে কে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই বিষের প্রভাবে, তা নির্ভর করছে কী পরিমাণ বিষ ত্বকের সংস্পর্শে এসেছে এবং কতক্ষণ তা ত্বকের সংস্পর্শে থেকেছে, এই দু'টি বিষয়ের ওপর। সাধারণত বিষের পরিমাণ লঘু হলে অথবা ত্বকের সংস্পর্শে অল্প সময় ধরে থাকলে, সামান্য জ্বালা এবং ত্বকে লালচে ভাব দেখা দেয়। মাঝারি পরিমাণ পেডেরিনে, অবশ্য চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চুলকানি এবং আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ফোসকা দেখা যায়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই সেরে যায় জ্বালাভাব এবং ফোসকা। বাড়াবাড়ি তখনই হয়, যখন ত্বকের অনেকটা জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে পেডেরিন, কিংবা যখন তা চোখের সংস্পর্শে আসে। সেক্ষেত্রে জ্বর, নার্ভে ব্যথা, গাঁটে ব্যথা, এমনকী, বমি হতে পারে। চোখের সংস্পর্শে এলে কনজাংটিভাইটিসের মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
তবে এর প্রতিকার অবশ্যই রয়েছে। যেহেতু পোকাটি নিজে থেকে কামড়ায় না এবং পিষে না দিলে এর থেকে বিষ নির্গত হয় না, তাই এদের আঘাত করা যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়াই উচিত। কাছাকাছি দেখতে পেলে আঘাত করে মেরে না ফেলে উড়িয়ে দেওয়াই ভালো। তবে যদি ভুল করে পিষে ফেলার কারণে বিষটি ত্বকের সংস্পর্শে আসে, সেক্ষেত্রে ত্বকের ক্ষতিগ্রস্ত স্থান যত দ্রুত সম্ভব জল দিয়ে ধুয়ে ফেলা উচিত। ত্বকের ওই অংশে বরফ লাগালে, আরওই দ্রুত ফল পাওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে জ্বালাভাব কমবে; কমবে ফোসকা পড়ার সম্ভাবনাও।
সুপ্রতিম লাহা জানাচ্ছেন, "বাড়িতে পোকার হার থেকে বাঁচতে মশারির ব্যবহার করা প্রয়োজন। সাধারণত এই পোকাগুলি অন্যান্য পোকার মতোই আলো দেখে আকৃষ্ট হয়। ফলে রাতে দরজা-জানলা বন্ধ রাখা উচিত, যাতে পোকাগুলি ঘরের ভেতর ঢুকতে না পারে। তবে মশা বা পোকামাকড় তাড়ানোর জন্য সাধারণত যে স্প্রে-গুলি আমরা ব্যবহার করি, সেগুলি না ব্যবহার করাই ভালো। তাতে উপরন্তু আমাদের শরীরেরই ক্ষতি হয়, যদিও আমরা তার প্রভাব প্রথমে বুঝতে পারি না।" এছাড়াও, বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখাই শ্রেয় এই পোকার থেকে বাঁচার জন্য।
"দেখতে গেলে নাইরোবি ফ্লাই কিন্তু আসলে উপকারী পোকা। চাষের ক্ষতি করে এমন অনেক পোকাকেই আবার এরা খেয়ে নেয়। ফলে চাষেরই লাভ হয় তাতে", জানাচ্ছেন সুপ্রতিম লাহা।
নাইরোবি ফ্লাই সম্পর্কে আরও বিশদে বলতে গেলে বলা যায়, এরা পেডেরাস বংশের অন্তর্ভুক্ত। প্রায় ৬০০ প্রজাতি আবার পেডেরাস বংশের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু পেডেরাসের সব প্রজাতির শরীরে এই বিষ থাকে না।পেডেরাসের অন্তর্ভুক্ত মাত্র কুড়িটি প্রজাতির পোকার শরীর থেকে এই বিষ নির্গত হয়। এরা আবার প্রত্যেকেই স্ট্যাফাইলিনিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, যাদেরকে আবার সাধারণ ভাষায় রোভ বিটল বলা হয়। রোভ বিটলের মাত্র দু'টি প্রজাতিকে নাইরোবি ফ্লাই বলা হয়।
মজার বিষয় হলো, একাধিক রোভ বিটলকে (যদিও নাইরোবি ফ্লাই নয়) ফরেনসিক তদন্তর কাজে ব্যবহার করা হয়। মৃতদেহের আশপাশে রোভ বিটলের উপস্থিতি দেখে বলে দেওয়া যায়, সেই ব্যক্তি কতক্ষণ আগে মারা গেছেন। মৃতদেহের জৈবরাসায়নিক পরিবর্তন একটি নির্দিষ্ট মাত্রা অবধি ঘটলে তবেই এদের আনাগোনা শুরু হয়। আর অবশ্যই জৈব-রাসায়নিক পরিবর্তন কোন স্তরে পৌঁছেছে, তা অনেকটাই নির্ভর করে, কোনও ব্যক্তি কতক্ষণ আগে মারা গেছেন, তার ওপর।