ভেরা রুবিন মানমন্দির: আকাশ দেখার নতুন জানালা
Vera C. Rubin Observatory Images: টেলিস্কোপটি প্রতি রাতে প্রায় এক কোটি স্বতন্ত্র সংকেত পাঠাবে, যেগুলো নতুন কোনও মহাজাগতিক ঘটনার (হঠাৎ কোনও তারার প্রজ্জ্বলন, সুপারনোভা বিস্ফোরণ, কোনও নতুন গ্রহাণুর আবির্ভাব বা আচরণগত পরিব...
সম্প্রতি ২৩ জুন তিনটি ছবি প্রকাশ করেছে ভেরা রুবিন মানমন্দির (Vera Rubin observatory)। প্রথম ছবিতে দেখা যাচ্ছে ট্রিফিড এবং লেগুন নেবুলার গোলাপি রঙের এক মনোরম দৃশ্য। পৃথিবী থেকে প্রায় ৯,০০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা অঞ্চলে গ্যাস আর ধূলিকণার ঘূর্ণিপাক এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য সৃষ্টি করেছে। পেশাদার ও শখের জ্যোতির্বিদরা এই নেবুলা দু'টির ছবি আগেও অনেকবার ক্যামেরাবন্দি করেছেন, কিন্তু সেগুলোর সাহায্যে পুরো দৃশ্যের একটা ছোট অংশই কেবল দৃষ্টিগোচর হতো। সেখানে এবার ভেরা সি রুবিন টেলিস্কোপের সাহায্যে পুরো দৃশ্যটাই দেখা যাচ্ছে।
তরুণ প্রজন্মের নক্ষত্রের থেকে নির্গত হওয়া তীব্র বিকিরণ গ্যাসের কণাগুলিকে উত্তপ্ত করে, সেজন্য গোলাপি আভা বেরোতে থাকে। সদ্য জন্মানো নক্ষত্রগুলি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্যাসের ধূলিকণাগুলো নক্ষত্রের আলোকে প্রতিফলিত করে, জ্যোতির্বিদ্যার পরিভাষায় যেটি বিচ্ছুরণ (Scattering) নামেই অধিক পরিচিত। এর ফলে আমাদের বায়ুমণ্ডলের মতো সুন্দর নীল বর্ণের সৃষ্টি হয়। কালো সুতোর মতো অংশগুলো ধূলিকণার পথ নির্দেশ করে। ঘন ধূলিকণাপূর্ণ অঞ্চলগুলি অতি উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো ছাড়া অধিকাংশ আলোকে আটকে দেয়। ফলে অনেক তারাই দৃষ্টিগোচর হতো না।
আরও পড়ুন- ১১ বছর ধরে মহাকাশ স্ক্যান করে মানচিত্র! গায়া যেভাবে বদলে দিচ্ছে বিজ্ঞানীদের ধারণাও

চিত্র ১- ট্রিফিড এবং লেগুন নেবুলা (সূত্র: ভেরা সি. রুবিন অবজারভেটরি)
এ জাতীয় ছবি তুলতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ফিল্টার ব্যবহার করে থাকেন, যেগুলি কেবল নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকেই ডিটেক্টরগুলিতে প্রবেশ করতে দেয়। রুবিনে এই ধরনের ফিল্টার রয়েছে ৬টি, যারা ক্ষুদ্র অতি বেগুনি রশ্মি থেকে শুরু করে দৃশ্যমান বর্ণালী, এমনকী ইনফ্রারেড আলোর ক্ষেত্রেও কার্যকরী। ট্রিফিড ও লেগুন নেবুলার ছবিটি আদতে চার রকমের রঙের ফিল্টার দিয়ে তোলা ৬৭৮টি ছবির সমন্বয়। বিভিন্ন ফিল্টার থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা নক্ষত্রের আকার, তাদের ভিতরের গ্যাসের তাপমাত্রা পরিমাপ করেন।
রুবিনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর গতি — একটি ফিল্টারে ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে অন্য ফিল্টার ব্যবহার করার যে দক্ষতা দেখা গেছে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চায় তা ঈর্ষণীয়। চালু হওয়ার মাত্র ১০ ঘণ্টার মধ্যেই রুবিন আবিষ্কার করেছে ২,১০৪টি নতুন গ্রহাণু এবং পৃথিবীর নিকটে থাকা সাতটি মহাজাগতিক বস্তু, যেখানে পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত টেলিস্কোপ সম্মিলিতভাবে বছরে প্রায় ২০,০০০-এর মতো মহাজাগতিক বস্তুর ছবি তোলে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ছবিগুলো এত উন্নত মানের যে যতই জুম করা হোক না কেন ছবিগুলো ফেটে যায় না, প্রতিবারই নতুন নতুন মহাজাগতিক বস্তুর সন্ধান মেলে।

চিত্র ২- ভার্গো ক্লাস্টারের একটি ছোট অংশ (সূত্র: ভেরা সি. রুবিন অবজারভেটরি)
উপরের ছবির (চিত্র ২) নীচের ডানদিকে দৃশ্যমান দু'টি উজ্জ্বল সর্পিল আকৃতির ছায়াপথ (এনজিসি ৪৪১১ ও এনজিসি ৪৪১১ বি), সঙ্গে উপরের দিকে দেখা যাচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত তিনটি গ্যালাক্সির একটি দল, সবই ‘ভার্গো ক্লাস্টার’-এর অংশ। এরা আমাদের থেকে প্রায় ৫৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এদের ভেতরে কোটি কোটি থেকে ট্রিলিয়ন সংখ্যক বিভিন্ন আকারের তারা রয়েছে। এই ছায়াপথের অভ্যন্তরে যে উজ্জ্বল বিন্দুগুলি দেখা যাচ্ছে, সেগুলো তারা গঠনকারী অঞ্চল, অনেকটা লেগুন এবং ট্রিফিড নীহারিকার মতো।

চিত্র ৩- ভার্গো ক্লাস্টারের অপর একটি ছোট অংশ (সূত্র: ভেরা সি. রুবিন অবজারভেটরি)
চিলির আন্দিজ পর্বতমালার পাদদেশে আতাকামা মরুভূমির প্রান্তে অবস্থিত একটি পর্বতের এক উঁচু চূড়ায় স্থাপিত এই মানমন্দির। উঁচু ও শুষ্ক এই স্থানে আকাশ পরিষ্কার থাকায় কোনও বাধা বিপত্তি ছাড়াই মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করা যায়। এই মানমন্দিরের নামকরণ করা হয়েছে বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ ভেরা রুবিনের নামে। সত্তরের দশকে গ্যালাক্সিগুলির ঘূর্ণন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে রুবিন দেখেন, ছায়াপথের ভরের হিসেবে গোলমাল হচ্ছে, সেই সময় তিনি ডার্ক ম্যাটারের সন্ধান পান।
এই টেলিস্কোপের মূল শক্তি লুকিয়ে আছে ক্যামেরাতে। ৬১ ইঞ্চি ব্যাসের লেন্স বিশিষ্ট এই ক্যামেরার রেজোলিউশন ৩২০০ মেগাপিক্সেল। অত্যাধুনিক আই ফোনের ক্যামেরার ৬৬ গুণ! এই ক্যামেরা প্রতি দু'মিনিটে তিনটি করে ছবি তুলবে এবং রাতে গড়ে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা ধরে কাজ করবে। প্রতি রাতে ২০ টেরাবাইট পর্যন্ত ডেটা সংগ্রহ করতে সক্ষম এটি। আগামী এক দশক ধরে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করবে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি এবং ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত এই অবজারভেটরি।
শুধু একবার ছবি তুলবে তাই নয়, প্রতি তিনদিন অন্তর সমগ্র আকাশের ছবি তুলবে এই টেলিস্কোপ। এর ফলে কোনও মহাজাগতিক বস্তুর অবস্থান বদলাচ্ছে কিনা, অথবা মহাকাশ থেকে হারিয়ে গেল কিনা সে বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা পাওয়া যাবে। ইদানীং অ্যাস্টরয়েড নিয়ে বেশ হইচই শুরু হয়েছে — এই বুঝি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে এল, সেই সব বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারবে বলেই বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস।
আরও পড়ুন- প্রকাণ্ড ডানা, অপার্থিব সৌন্দর্য! মহাকাশে কীভাবে লুকিয়ে দানবাকৃতি মহাজাগতিক প্রজাপতি?

বিভিন্ন ফিল্টারে তোলা ভেরা রুবিনের প্রথম ছবি
জ্যোতির্বিদ্যায় প্রধান কাজ হলো, দূরের মহাজাগতিক বস্তুগুলো থেকে আলো বা কোনও সংকেত আসছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা। এই কাজে ভেরা রুবিন টেলিস্কোপ যে যথেষ্ট দক্ষ তা অনুমান করা যায়। প্রতি রাতে গড়ে প্রায় কোটিখানেক নতুন ঘটনা বা মহাজাগতিক বস্তু শনাক্ত করতে সক্ষম রুবিন মানমন্দির। অর্থাৎ টেলিস্কোপটি প্রতি রাতে প্রায় এক কোটি স্বতন্ত্র সংকেত পাঠাবে, যেগুলো নতুন কোনও মহাজাগতিক ঘটনার (হঠাৎ কোনও তারার প্রজ্জ্বলন, সুপারনোভা বিস্ফোরণ, কোনও নতুন গ্রহাণুর আবির্ভাব বা আচরণগত পরিবর্তন) ইঙ্গিত দিতে পারে। মেশিন লার্নিং এবং উন্নত মানের পরিসংখ্যান পদ্ধতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এই সংকেতগুলো বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করবেন, মহাবিশ্বে নতুন নতুন কী পরিবর্তন হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে মহাবিশ্বের এই যে পরিবর্তন, জ্যোতির্বিদ্যার পরিভাষায় তাকে বলে ‘টাইম ডোমেইন অ্যাস্ট্রোনোমি’। মহাজাগতিক বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করার জন্য অন্যান্য অবজারভেটরি থাকলেও ভেরা সি রুবিনের বিশেষত্বই হলো এই বিষয়ক তথ্য পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা।
আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন ঘটনা যেমন, সুপারনোভা বিস্ফোরণ, কিলোনোভা বিস্ফোরণ, গামা-রে বিস্ফোরণ, নিউট্রন তারার মধ্যে সংঘর্ষের মতো অনেক ক্ষণস্থায়ী ঘটনা পর্যবেক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়েছে এই টেলিস্কোপ। অদূর ভবিষ্যতে এটিই হবে মহাকাশ পর্যবেক্ষণের অন্যতম সমৃদ্ধ তথ্যভাণ্ডার। মহাকাশে এমন অনেক তারা আছে, যাদের আলো এতটাই ক্ষীণ যে তাদের এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এই টেলিস্কোপ দিয়ে বিজ্ঞানীরা এমন সব দুর্বল আলোকরশ্মি বিশ্লেষণ করতে পারবেন, যেগুলোর সৃষ্টি হয়েছে কোটি কোটি বছর আগের কোনও মহাজাগতিক ঘটনার সময়। বহুল আলোচিত সেই ‘নবম গ্রহ’ যদি সত্যিই কোথাও থেকে থাকে, তাহলে তার হদিশ কি দিতে পারবে এই ভেরা রুবিন মানমন্দির? সেজন্য আপাতত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকুন মহাকাশ প্রেমীরা।