একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে তোলপাড়! কেন রাস্তায় নামল বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ ছাত্রযুব?
Bangladesh: সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারসহ সব কোটা বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবি করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন পড়ুয়ারা। এরই মধ্যে আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢেলেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য।
ছাত্রবিক্ষোভে উত্তাল বাংলাদেশ। বৈষম্যমূলক কোটা সিস্টেম বন্ধ করার দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন পড়ুয়া ও চাকরিপ্রার্থীরা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ক্রমশ ঝাঁঝ বাড়ছে আন্দোলনের। দিন কয়েক ধরেই আন্দোলন চলছে ঢাকা-সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। গোটা বাংলাদেশ জুড়ে এর আগে এত বড় ছাত্রবিক্ষোভ দেখা গিয়েছে কিনা সন্দেহ। সোমবার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবরোধ করেন পড়ুয়ারা। শাহবাগ-সহ একাধিক জায়গায় চলে দফায় দফায় অবরোধ। তীব্র যানজট তৈরি হয় রাস্তায়। সোমবারের পর মঙ্গলবারও জায়গায় জায়গায় বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন পড়ুয়ারা।
সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারসহ সব কোটা বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবি করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন পড়ুয়ারা। এরই মধ্যে আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢেলেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য। আন্দোলনকারীরা নিজেদের রাজাকারদের সঙ্গে তুলনা করেন। আর সেই স্লোগান 'অত্যন্ত দুঃখজনক' বলেই মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। সেই বক্তব্যে ক্ষোভ বেড়েছে আন্দোলনকারীদের মধ্যে। সোমবার সে নিয়ে নতুন করেই বিক্ষোভে নামে বাংলাদেশের পড়ুয়ারা। সোমবারের বিক্ষোভে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা কলেজ, বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, ঢাকা নার্সিং কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা যোগ দেন। তাঁদের ওই সমাবেশ থেকে 'চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার', 'কে বলে রে রাজাকার, ধিক্কার ধিক্কার', 'প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, প্রত্যাহার করতে হবে' প্রভৃতি স্লোগান দেওয়া হয়। সেখানেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্তদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। দুইপক্ষই একে অপরের দিকে ইট–পাটকেল ছুড়তে থাকে। ঘটনায় বেশ কয়েক জন আহত হয়।
আরও পড়ুন: জারি ১৪৪ ধারা, ভোটের আগে দিল্লির পারদ চড়াছে কৃষক বিক্ষোভের আঁচ
প্রধানমন্ত্রী আপত্তি জানিয়েছেন আন্দোলনকারীদের স্লোগান নিয়েই। যারা ‘রাজাকার’ বলে স্লোগান দেয় তাঁরা কোন চেতনায় বিশ্বাস করে বলেও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। হাসিনা বলেন, ‘রোকেয়া হলের মেয়েরা রাজাকার বলে স্লোগান দেয়! কোন চেতনায় তারা বিশ্বাস করে? এ কোন দেশে বাস করছি?’ নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে স্লোগান দেওয়া কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা একাত্তরের গণহত্যা, মহিলাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন এবং তাঁদের সহায়তাকারী রাজাকারদের ভূমিকা সম্পর্কে জানে কি না সেটা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শেখ হাসিনা। এদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে দেশ জুড়ে আন্দোলন আরও তীব্র করার ডাক দিয়েছেন পড়ুয়ারা। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরেই ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, শাহজাহাল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন পড়ুয়ারা। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ চলাকালীন তাঁদের উপরে হামলা করা হয় বলেও অভিযোগ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ-ও জানান, আদালতের চুড়ান্ত রায় মেনেই তাঁরা সব কিছু করবেন। রবিবার, একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘আদালতের বিষয় আদালতেই সমাধান হওয়া উচিত। কোটা আন্দোলনকারীদের দেশের বিচার ব্যবস্থা এবং সংবিধান সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই।’
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম সূত্রের খবর, সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটার বিষয়ে আপিল বিভাগের আদেশের প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনকারীরা পাল্টা জানিয়েছেন, আদালতের সঙ্গে তাঁদের আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁরা চাইছেন সরকার যে কোটা সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান করেন। সেই সঙ্গেই তাঁরা জানিয়েছেন, এই সমস্যার উপযুক্ত সমাধান তাঁরা চান। না হলে তাঁরা আন্দোলনের রাস্তা থেকে সরবেন না। এদিকে সিভিল সার্ভিসে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবিতে তাদের এই আন্দোলন। বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থার অবসান চান তাঁরা। কোটা পুনরায় বহাল সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই পড়ুয়ার আবেদন করার সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক নেই বলেও দাবি করেছেন আন্দোলনকারীরা। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কো অর্ডিনেটর নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে কোনও আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়নি। আমাদের দাবি সরকার ও নির্বাহী বিভাগের কাছে। যারা আদালতে গিয়েছেন তাঁরা নিজের উদ্যোগ গিয়েছেন। এর সঙ্গে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক নেই।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের হামলায় শিক্ষার্থী আহতের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। সোমবার রাত আড়াইটার দিকে ছাত্রাবাস থেকে বের হয়ে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নির্বিচার হামলার প্রতিবাদে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের চার নেতাকে পেটানোর অভিযোগ সোমবার বিকেল ৬টা ২০ মিনিটের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস কমপ্লেক্স ভবনের সামনে এ ঘটনা ঘটে। সরকারি চাকরির সব গ্রেডে বৈষম্যমূলক কোটার যৌক্তিক সংস্কার ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা। সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চ থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল জব্বার মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন।
যশোরেও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হেলমেট দিয়ে পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। এতে যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজ, যশোর সরকারি মহিলা কলেজ ও যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন। সোমবার দুপুরে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনের সড়কে এ ঘটনা ঘটে। হামলার প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রেসক্লাবের সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ ও পরে শহরে মিছিল করেন। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের অবমাননা করা হয়েছে দাবি করে রবিবার মধ্যরাতে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা তাঁদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তা উপেক্ষা করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ভবনের সামনে এ ঘটনা ঘটে। গাইবান্ধায় সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে বের করা মিছিলে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেই ঘটনাটিও ঘটে রবিবারই। গাইবান্ধা সরকারি কলেজ চত্বরের এই ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এদিকে রবিবারই সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি সংস্কারে এবার আইন প্রণয়ন চেয়ে রাষ্ট্রপতিকে স্মারলিপি দিয়েছেন চট্টগ্রামের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। কোটা বিরোধী আন্দোলন বাংলাদেশে শুরু হয়েছে দিন কয়েক আগে থেকেই। শুক্রবারই রাজশাহীতে রেললাইন অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন পড়ুয়ারা। শুক্রবারই আন্দোলনে সামিল হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ওই দিন বিকেলে কলা ভবনের সামনে থেকে মিছিল বের করে আশপাশের সড়ক ঘুরে আবার ক্যাম্পাসে ফিরে আসেন তাঁরা। কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে পুলিশের হামলার প্রতিবাদে এই কর্মসূচি পালন করেন তাঁরা। শুক্রবার একই দাবিতে বিক্ষোভ হয় চট্টগ্রামেও। ষোলশহর রেলস্টেশন থেকে শুরু হয় মিছিল। যেখানে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় থাকা অন্যান্য কলেজ এবং চট্টগ্রাম বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। বৃহস্পতিবারও আন্দোলনে কোথাও কোথাও দু'পক্ষের মধ্যে অশান্তি হয়। কুমিল্লায় শূন্যে গুলি চালায় পুলিশ। চট্টগ্রামেও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটার ঘটনা ঘটে। এসবের প্রতিবাদেই শুক্রবারের বিক্ষোভ মিছিল বলে জানান শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন আন্দোলনরত পড়ুয়ারা। সরকারি চাকরির সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিলের দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও।
আরও পড়ুন:দিল্লি থেকে শুরু করে পোল্যান্ড, ফ্রান্স! কৃষিবিক্ষোভের আগুনে পুড়ছে যে সব দেশ
মঙ্গলবার দুপুরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান কর্মসূচি ডেকেছে ছাত্রলীগ৷ ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান’ শীর্ষক এই কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার কথা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের। এর আগে পড়ুয়া ও চাকরিপ্রার্থীদের এত বড় আন্দোলন আগে দেখেনি বাংলাদেশ? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এর জল? আদৌ কি মানা হবে পড়ুয়াদের দাবি? দেশজোড়া এই আন্দোলনে কী ভূমিকাই বা নেবে সরকার, প্রশ্ন নানামহলে।