পোস্টার বয় থেকে ফ্যামিলি ম্যান— অন্দরের বিরাট, অন্তরের বিরাট
Virat Kohli: বিরাট একবারও নিজেকে গড়ে-পিটে নিতে চাননি সমাজের ফেলে দেওয়া টেমপ্লেটে। কারণ? বিরাট নিজের ভেতরের রক্তমাংসের বিরাট কোহলির নিঃশব্দ রক্ষক হয়ে থেকেছেন।
বাজার অর্থনীতি চায় তারকা— যে তারকার মূর্তির সামনে নতজানু হবে বাজার— যে বাজারের চাহিদা মেনে সে মূর্তির গায়ে পড়বে না কোনও ধুলোর আস্তরণ। আবার সেই তারকার সামান্যতম সামাজিক অবস্থানের হেরফের গড়ে দেবে প্রবল বিতর্কের পরিসর। দুই ক্ষেত্রেই, ব্যক্তি হয়ে ওঠে বাজারের নিয়ন্ত্রক। আর এই ব্যক্তিকে প্রতি দশকে খুঁজে নেয় বাজার নিজেই, তার নিজস্ব প্রয়োজনে। নয়ের দশকের উদার অর্থনীতি এই দেশের পোস্টার বয় হিসেবে যেমন প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল মারাঠি সেনসেশনকে, তার জোরেই সচিন তেণ্ডুলকর কেবল এক নাম থেকে হয়ে উঠেছিলেন ব্র্যান্ড! বিলিতি পণ্যের এদেশে ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ার ভরসা হয়ে উঠলেন সচিন। মিডিয়াসহ সবরকম প্রচারমাধ্যমের উৎস থেকে সমস্ত শক্তি দিয়ে তৈরি করা হলো সচিনকে; তাঁর ক্রিকেটীয় জিনিয়াস, বাইশ গজে তাঁর উত্তুঙ্গ মেধা নিঃসন্দেহে সকলের চেয়ে দড়, কিন্তু তারপরেও সচিন সচিন হতে পারতেন না যদি না বাজার চাইত। তাই সচিনের অবসরের পরেই বাজারের প্রয়োজন পড়েছিল আরেকজন পোস্টার বয়ের। সেই চাহিদার বিশাল হাঁ-এর সামনে এসে দাঁড়ালেন ঝকঝকে তরুণ বিরাট কোহলি। হোবার্টের ইনিংসের পর তাঁর শরীরী ভাষা, বিশ্বকাপ ফাইনালে সচিন-শেহবাগের উইকেটের পর তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়ী ব্যাটিং, অ্যাডিলেডের সেঞ্চুরির পর হেলমেট খোলা আগ্রাসন— সবটাই নিঃশব্দে হয়ে গেছে বাজারের রসদ এবং বিরাট হয়ে উঠেছেন সচিনের পর এদেশের সবচেয়ে বড় পণ্য।
তবে, সচিন এবং বিরাটের মধ্যে থেকে গেছে এক সামান্য তফাত। কী তফাত? সচিন নিজের জীবনকে, ব্যক্তি ও পেশাদার জীবনের সুতোকে জুড়ে দিয়েছেন বৃহত্তর বাজারের চাহিদার সঙ্গে। তাই সচিনের জীবনের প্রতিটি বাঁকই প্রবলভাবে বন্দিত উপমহাদেশীয় জনতার মনে। যেমন ধরা যাক, নিজের বাবার মৃত্যুর পরেও দেশের হয়ে খেলে তবে বাড়ি ফেরা, নিজের স্ত্রী-সন্তানের চাওয়া-পাওয়া, সুখ-দুঃখের পানসির অনেক আগে নিজের পেশাকে রাখা। ভারতীয় উপমহাদেশে আইকনের যে বাজার চলতি ছাঁচ, তাতে নিজেকে নিখুঁতভাবে বসাতে পেরেছিলেন সচিন। তাই অবসরের এতবছর পরেও সচিনের সঙ্গেই তুলনা করা হয় পরবর্তী তারকা-মহাতারকাদের।
আরও পড়ুন-ক্যাপ্টেন কোহলির ‘বিরাট’ সরে যাওয়া, যা রেখে গেলেন…
তবে বিরাটের ক্ষেত্রে বিষয়টি কিঞ্চিৎ আলাদা। তিনি গুডবয় ইমেজের ধারক নন, হাতে ট্যাটু, কৈশোরে বেপরোয়া, একাধিক বান্ধবী, বলিউডি নায়িকার সঙ্গে প্রকাশ্যে প্রেম-বিয়ে এবং সর্বোপরি নিজের সন্তান জন্মের সময়ে স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য ৩৬ রানে অলআউট হয়ে যাবার পরেও আডিলেড থেকে সোজা দেশে ফিরে এসেছেন— এই প্রতিটি ঘটনাই বিরাটকে ফেলেছে বিতর্কের মুখে। অথচ, বিরাট একবারও নিজেকে গড়ে-পিটে নিতে চাননি সমাজের ফেলে দেওয়া টেমপ্লেটে। কারণ? বিরাট নিজের ভেতরের রক্তমাংসের বিরাট কোহলির নিঃশব্দ রক্ষক হয়ে থেকেছেন। সেই অন্তঃলোকে প্রবেশাধিকার তিনি দেননি মিডিয়াকে— সেখানে আছে কেবল পরিবার ও প্রিয় মানুষেরা।
বিরাট টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেল থেকে পোস্ট আসার সঙ্গে সঙ্গেই চারদিকে শুরু হলো হইহই। বিরাট-বন্দনা থেকে সচিনের সঙ্গে তুলনা, পুরনো ব্যাটিং ক্লিপিংস থেকে প্যাটার্নাল লিভ বিতর্ক সবই হলো। আর এরই মাঝে একটি পোস্ট করলেন তাঁর স্ত্রী অনুষ্কা শর্মা। প্রথম লাইনে তিনি লিখলেন-
‘ They’ll talk about the records and the milestones- but I’ll remember the tears you never showed...’
এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে এই অনুষ্কাই সেই অনুষ্কা শর্মা যাঁকে বারবার দোষারোপ করা হয়েছে বিরাটের খারাপ ফর্মের কারণে। বিন্দুমাত্র অপরাধ না থাকা সত্ত্বেও তাঁর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নেট-নাগরিকেরা। বিরাট যখন সন্তান জন্মের সময়ে স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য ফিরে এলেন, তখনও এই মেয়েটিকে কাঠগড়ায় তুলেছিল বড় সংখ্যক জনতা। সেই অনুষ্কাই বোধহয় টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর দিন শ্রেষ্ঠ উপহারটি দিলেন তাঁকে এবং বিরাট কোহলির বাজারের আইকন হয়ে ওঠা মূর্তির পিছনে ব্যক্তি বিরাটকে প্রতিষ্ঠা দিলেন বিরাট সংখ্যক জনতার মনে।
আরও পড়ুন-আইপিএলের কিং কোহলি নন, সব ধরনের ক্রিকেটের আজীবন ‘ঈশ্বর’ সচিনই
আমাদের দেশে সুবৃহৎ ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসের কারণে আজও বেশিরভাগ মানুষ মনে করে থাকেন, একজন ব্যক্তি যিনি দেশের জন্য কিছু করছেন, যিনি দেশের পতাকা হাতে ময়দানে নামছেন কিংবা সীমান্তে যুদ্ধ করছেন তাঁর ব্যক্তিগত জীবন গৌণ। মুখ্য কেবল দেশপ্রেম। এই সামাজিক ধারণাকে ভেঙেছেন রক্তমাংসের বিরাট। তিনি জানেন এবং নিশ্চিতভাবেই মানেন, একজন মানুষের কাছে সবার আগে তাঁর পরিবার। সেই পরিবারের ছোট ছোট সুখ-দুঃখকে জীবনে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া মানে কখনই কর্তব্যে অবহেলা নয়। দ্বিতীয়ত, পরিপাটি আঁচড়ানো চুল, টাক-ইন করে পরা শার্টের যে ধোপদূরস্ত ইমেজ সমাজের কাছে গুড-হিউম্যান হিসেবে স্বীকৃত, তাকেও ভেঙেছেন বিরাট। হাতে ট্যাটু, চুলে রঙ করা কোনও ছেলেও যে নিজেকে নিংড়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ব্যাটার হতে পারে সেই ধারণাকে গেঁথে দিয়েছেন দেশবাসীর মনে গত একযুগ ধরে। আর এই স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে গিয়েই বিরাটকে ঝরাতে হয়েছে অনেক রক্ত, শারীরিকভাবে নয়— মানসিকভাবে। এই মানসিক যন্ত্রণার সমস্ত কান্না সযত্নে আগলে রেখেছেন অনুষ্কা শর্মা, যিনি বিরাটের স্ত্রীয়ের চেয়েও বেশি বন্ধু-আত্মজন। এই বাজার বিরাটকে যত পণ্যায়িত করতে পেরেছে, তত ক্লান্ত হয়ে বিরাট ফিরে এসেছেন অনুষ্কার কাছে এবং ব্যক্তি বিরাট এখানে প্রমাণ করে দিয়েছেন, সামগ্রিকভাবে একজন মানুষের শেষ আশ্রয় তাঁর প্রিয় মানুষটিই, আর কিচ্ছু নয়।
এই ক্রমশ বেড়ে চলা অসহিষ্ণু আবহে, গত দশ বছরে বিরাট কোহলি নিঃশব্দে পাশে থেকে গেছেন তাঁর স্ত্রীয়ের, তাঁর সমস্ত আঘাত যেমন বে-আব্রু হয়েছে তাঁর সামনে, তেমনই তিনি অনুষ্কাকে আগলেছেন বাজারের আগুনের আঁচ থেকেও। অবসরের পর তাই অনুষ্কা সেই পারস্পরিক বন্ধুতার স্মারকটুকুই তুলে ধরলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়, আর বিরাট কোহলি বাজারের ঝকঝকে পোস্টার বয় থেকে শেষবেলার আলোয় হয়ে উঠলেন একজন আদ্যোপান্ত ফ্যামিলি ম্যান— যে ইমেজের সঙ্গে বৈরিতা নেই ক্রিকেটার বিরাটের, বরং বিরাটের এই নির্মাণই আগামীদিনে বাজারে তারকা তৈরির ছাঁচ হয়ে উঠবে বলেই বিশ্বাস।