বিরাট কোহলি: খুঁজে ফেরা এক অনন্য লড়াইক্ষ্যাপাকে
Virat Kohli: 'ঘর মে ঘুস কর', বিরাট কাঁদিয়ে ছাড়তে উদ্যত প্রতিপক্ষকে। তিনি স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন দেখতে বিশেষ রূপে আগ্রহী।
গ্রেগ চ্যাপেল বিরাট কোহলি সম্পর্কে একদা বলেছিলেন, ‘দ্য মোস্ট অস্ট্রেলিয়ান নন-অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার, উই হ্যাভ এভার সিন’। তিনি আসলে মন্তব্য করছিলেন বিরাটের আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে। আরও খানিক খোলসা করলে বলা যায়, বিরাট প্রতিপক্ষকে শুধু মাত্র হারিয়ে শান্তি পেতেন না, তিনি যাকে বলে— পুঁতে দিতে চাইতেন তাদের, চাইতেন ক্ষতবিক্ষত সে প্রতিপক্ষ কেঁদেকেটে ফিরুক আস্তানায়। সম্ভবত এইটেই হলো গ্রেগের মতে ‘মোস্ট অস্ট্রেলিয়ান’ ক্ষমতা, বিরাটের মধ্যে। এর আগেও ম্যাথ্যু হেডেন আগ্রাসন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, প্রকৃত আগ্রাসন বুঝতে গেলে সটান তাকাতে হবে দ্রাবিড়ের চোখের দিকে। কিন্তু ভেবে দেখুন, গ্রেগ যেভাবে বিরাটের আগ্রাসনকে দেখছেন এবং হেডেন যেভাবে দ্রাবিড়ের, তফাৎ আছে। কোথায়? থামার মুহূর্তে। অর্থাৎ, দ্রাবিড় এক নীরব, নিশ্চল, অবিরত আগ্রাসী ভাব নিয়ে ঠায় মোকাবিলা করে গিয়েছেন যাবতীয় ঝড়-ঝঞ্ঝার। বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তুমি ভাই যতই বোমাবর্ষণ করো, আমি এক চুলও নড়ব না ফ্রন্টলাইন থেকে, দরকারে ব্যাকফুটে যাব, তবু পড়ে থাকব মাটি আঁকড়ে, যতক্ষণ না তুমিই, প্রতিপক্ষ হতোদ্যম হয়ে পড়ছ, ছেড়ে দিচ্ছ দান। হ্যাঁ, সে-ও তো পাল্টা মারই।
কিন্তু বিরাট কী করছেন? ওই পাল্টা মারের সিকোয়েন্স চালিয়েই যাচ্ছেন। থামছেন না। থামছেন তখনই, যখন প্রতিপক্ষের হুঁশ বলে আর কিছুই থাকছে না। 'ঘর মে ঘুস কর', তিনি কাঁদিয়ে ছাড়তে উদ্যত প্রতিপক্ষকে। তিনি স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন দেখতে বিশেষ রূপে আগ্রহী। ‘মোস্ট অস্ট্রেলিয়ান’ ক্ষমতা সেই! এবং বিরাট যেখানে ফের চমকে দেন, তা হলো এ কাণ্ড তিনি বহাল তবিয়তে করে গিয়েছেন লাল বল ক্রিকেটে। অপশন ছিল কিন্তু তাঁর কাছে, ওয়ান ডে বা টি-২০-তে অধিক রং ছড়ানোর। আগ্রাসন দেখানোর অনেক বেটার জমি, এই দুই আঙিনা, দ্বিমত নেই নির্ঘাৎ! তবুও বিরাট বিশেষভাবে তেতে উঠতেন টেস্টের সাদা পরলেই। মনে করতেন, পাঁচ দিনের এই ফর্ম্যাটই সবচেয়ে সুন্দর অংশ ক্রিকেটের। এবং ঠিক এখানেই জেগে উঠত তাঁর ‘ইনার অ্যানিমাল’ বিশেষভাবে যখন তাঁকে ঘিরে চলত স্লেজিং, মাঠের ভিতর, বাহির উভয়েই। অস্ট্রেলিয়ায় তাই তিনি অধিক মাত্রায় জ্বলে উঠতেন বোধহয়। ’১৪ সালের বক্সিং ডে টেস্টে, তাঁর ১৬৯ স্রেফ একটি উদাহারণ। বা ধরা যাক অ্যাডিলেডের অনবদ্য ইনিংসের কথাও। মেলবোর্নের বক্সিং ডে টেস্টে, প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথা কাটাকাটির পর, দিনের খেলা শেষে তিনি বলেন,
"ওরা আমায় বদ বলছিল... হয়তো আমি ঠিক তেমনই, কিছু এসে যায় না আমার। ওরা আমায় সহ্য করতে পারে না আর আমার ঠিক সেটাই বড় ভালো লাগে…"
এই ‘ব্যাড বয়’ ইমেজ নিয়ে বীরদর্পে অনবদ্য স্কিল দেখিয়ে বারেবারে জয়পতাকা ওড়ানোও যে সম্ভব, তা বিরাট দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। বা একটু ভুল বললাম বোধহয়, বিরাট কখনও এই ইমেজকে ‘ব্যাড বয়’ রূপেই দেখেননি। প্রশ্ন তিনি তুলেছেন তথাকথিত ‘গুড’ ও ‘ব্যাড’-এর সংজ্ঞা নিয়েই নিশ্চিতভাবেই। সাধারণত আমরা, ভারতীয়রা একটা গণ্ডি টেনে নিয়ে গুড থেকে ব্যাড-কে আলাদা করে রাখি। যে, এই অমুক অবধি আমি গুড, ওই তমুকে ঢুকে পড়লেই আমি হয়ে গেলাম ব্যাড। বিরাট এ সমস্ত কম্পার্টমেন্টকেই তছনছ করে ক্রমাগত একটা অন্য শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন বোধ করি। যে, অন্যের গড়ে দেওয়া সর্বজন স্বীকৃত কোনও মাপকাঠি, মানদণ্ডে নিজেকে বেঁধে না রেখে প্রকাশ করো নিজেকে। অভ্যাস করো অতঃপর, প্রত্যেক সেই ‘সর্বজন স্বীকৃত’ ভাবনাধারাকে প্রশ্নের মুখে ফেলার। সমস্বরের চেয়ে পৃথক সে এক অদ্ভুত ইন্ডিভিজুয়্যালিটি। বিরাট-স্বাক্ষর যার গায়ে অদম্য। তা সাংঘাতিকভাবে ঠিক বা প্রবল রূপেই ভুল, হয়তো, কিন্তু তা অবশ্যই কোহলিসর্বস্ব। আনমিসটেকেবল বিরাট। প্রণিধানযোগ্য।
আরও পড়ুন- ক্যাপ্টেন কোহলির ‘বিরাট’ সরে যাওয়া, যা রেখে গেলেন…
এবং খেয়াল করার আরও যে, এই তাঁর পার্সোনা শুধুমাত্র মাঠ-মধ্যে নয়। এটাই প্রকৃত বিরাট। একটি নিউজ় আটিকেলে পড়েছিলাম, লেখক নাগপুরে একটি ম্যাচ কভার করতে গিয়েছেন। ঘটনা যখনকার, তখন তিনি হোটেলের জিমে। দেখলেন বিরাট আসছেন জিম করতে। তা ভালো কথা। তা সেই সময় সামনে টিভিতে রজার ফেডেরার ও নাদালের খেলা চলছে, অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ফাইনাল। সেই প্রতিবেদক দেখলেন, বিরাট টিভির খুব সামনে হেঁটে চলে গেলেন, প্রায় মুখে ঠেকে যায় টিভি স্ক্রিন, চার ইঞ্চির ব্যবধান মাত্র। বিরাট এর পর অন্ধর মতো ডুব দিলেন রজার ও রাফার পাসিং শটে, ব্যাকহ্যান্ডে। প্রতিটা ওঠা, প্রত্যেকটা নামায় তখন রজার ও রাফার সঙ্গেই প্রাণপণে যোগ দিচ্ছেন বিরাট, কেশর ফুলিয়ে আস্ফালন করছেন রজারের ব্রহ্মাস্ত্রে, চাপা টেনশনে প্রায়ই চেঁচিয়ে উঠছেন, কাম অন রজার... ইয়েস রজার...লেট্স গো...ইয়েস…
সেই প্রতিবেদক আশ্চর্য হয়ে দেখেছিলেন, মাত্র একজন দর্শক চৌহদ্দিতে, অর্থাৎ সেই প্রতিবেদক নিজে, কিন্তু বিরাটের তাতে কিছু এসে যায় না, কারণ বিরাট শুধু মাঠভর্তি দর্শকের সামনেই অমন সুপারচার্জ্ড হন না, তিনি জ়োনে চলে যান প্রকৃত প্রতিপক্ষ খুঁজে পেলেই, সো হোক না মনে মনে...সে যুদ্ধে তাঁর হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা... এ লড়াইক্ষ্যাপার দর্শনই যে ভিন্ন।