টেস্ট ক্রিকেটে আধুনিক ব্যাটিংয়ের জয়গান গেয়েছেন বিরাট কোহলি

Virat Kohli: টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে কোহলির তুলনা গাভাস্কার, সচিন, পন্টিং, দ্রাবিড়, কালিস এমনকী স্টিভ ওয়, সঙ্গকারা, বর্ডার বা ব্রায়ান লারার সঙ্গে হয় না, বরং হয় হাসিম আমলা বা গ্রেম স্মিথের সঙ্গে।

আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে সীমিত ওভারের খেলা হচ্ছে আজ পাঁচ দশকেরও বেশি। কিন্তু রসিকের কাছে এই সময়টার বেশিটা জুড়েই উৎকর্ষের একমেবাদ্বিতীয়ম মানদণ্ড হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটের অবস্থান প্রশ্নাতীত। সেইটা পাল্টাতে শুরু করেছে অনেক পরে। অন্তর্জাল-উত্তর পৃথিবীতে, তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দশকের পরের দিকে একদিনের ক্রিকেটের বিপুল জনপ্রিয়তার পাশাপাশি টি-টোয়েন্টি হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক, বিশ্বকাপের ফর্ম্যাট হিসেবে অনুমোদিত হয়ে কুড়ি-বিশের ক্রিকেট দর্শককে দিল উত্তেজক ক্রিকেটযুদ্ধের মশলাদার স্বাদ। একই সময়ে বাজার সরগরম করে তুলল ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লীগ। সীমিত ওভারের খেলার আদিলগ্নে যে স্বপ্ন প্যাকার ক্রিকেট পূরণ করতে পারেনি, টি-টোয়েন্টির উন্মাদনা যেন সেটাই আরও অমোঘভাবে সুনিশ্চিত করল। খালি, টেস্ট ক্রিকেটকেই শেষ কথা মনে করাটা অ্যাদ্দিন ছিল অনস্বীকার্য। বিরাট সংখ্যক ক্রিকেটপাগল মানুষ এবার সেই ধারণাকে অতীতবিলাসী প্রাচীনপন্থার চিহ্ন হিসেবেই দেখা শুরু করল।

কোহলির উত্থান ঠিক এই সময়টাতেই। টেস্ট ক্রিকেট যখন অস্তিত্বের সঙ্কটে খানিক ভুগতে শুরু করেছে, তখন। কোহলির আগে যত ব্যাটসম্যান 'সর্বশ্রেষ্ঠ' তকমায় ভূষিত হয়েছেন, তাঁদের সবার ক্ষেত্রেই আগে বিচার্য হয়েছে টেস্ট ম্যাচে তাঁদের প্রদর্শন। ক্রিকেটে যুগান্তরের পোস্টার বয় কোহলিই প্রথম যিনি সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ব্যাটিং শৌর্যের এমন অনন্যসাধারণ সব কীর্তি গড়লেন, যে শুধু তার প্রেক্ষিতেই তাঁকে সর্বকালের সর্বসেরার আলোচনায় সসম্ভ্রম উচ্চাসন দেওয়া হতে লাগল। টেস্ট ক্রিকেটে বিরাট কোহলি সত্যিকারের ডানা মেলবার আগে থাকতেই কিন্তু তিনি প্রতিষ্ঠিত 'কিং কোহলি' রূপে।

তাহলে টেস্ট ক্রিকেটে বিরাট কোহলির অবদানটা ঠিক কী? ওডিআই আর টি-টোয়েন্টিতে রাজপাট বিস্তারের পাশাপাশি স্রেফ আরেকটা ফর্ম্যাটে বিরাটের শ্রেষ্ঠত্বের পরিসংখ্যানগত দলিল তৈরিতেই সীমিত কোহলির টেস্ট কৃতিত্ব? এখানেই মজা! যদি সেটুকুই হতো, তাহলেও ক্রিকেট ইতিহাসে বিরাট কোহলির জায়গা নিরঙ্কুশ হতো কিন্তু ক্রিকেটরসিকদের সৌভাগ্যই বলতে হবে যে, দেড়শো বছরের প্রতিষ্ঠান টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম টালমাটাল সময়ে এই ফর্ম্যাটে দাপুটে রাজত্ব করেছেন কোহলি। টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে যাদের তেমন হেলদোল নেই, তাদেরকেও কোহলির ব্যাটিং দেখতে বারবার টেস্ট ক্রিকেট মুখী হতে হয়েছেই।

আমার চোখে বিরাটের টেস্ট ব্যাটিংয়ের সোনালি পর্যায় যে সময়কাল, অর্থাৎ ২০১৪ থেকে ২০১৯, মোটামুটি সেই সময়েই টেস্ট ক্রিকেট সবচেয়ে বেশি ভুগেছে অস্তিত্বের সঙ্কটে। টেস্ট ক্রিকেট আবার যখন নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেল ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বিবাৎসরিকতায়, ততদিনে বিরাট কোহলির টেস্ট ব্যাটিংয়ে লেগেছে অধারাবাহিকতার আংশিক গ্রহণ। বিরাট কোহলির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর সাফল্য যতটা প্রয়োজনীয় ছিল, তার থেকে ঢের বেশি টেস্ট ক্রিকেটের প্রয়োজন ছিল কোহলির। নতুন সহস্রাব্দের দ্বিতীয় দশকে, বাণিজ্যিকভাবে টেস্ট ক্রিকেটের যেটা সবচেয়ে সংশয়াকীর্ণ সময়, সেই সময়টায় কোহলি গেয়েছেন টেস্ট ক্রিকেটে আধুনিক ব্যাটিংয়ের জয়গান। এই আধুনিকতা প্রতি বলে ছয়-চার মারবার উগ্রতায় সংজ্ঞায়িত হয়নি। সংজ্ঞায়িত হয়েছে স্থিতধী অথচ গতিশীল, নিশ্ছিদ্র অথচ আগ্রাসী এক ব্যাটিং শৈলীতে। এই ব্যাটিং শৈলী যেন কোহলি আমদানি করেছিলেন তাঁর ওডিআই খেলার প্লেবুক থেকে। অথচ লাল বলের ক্রিকেটে সেটাকে একটিবারও অনুপযোগী লাগেনি। এখানেই বিরাটের ব্যাটিংয়ের সেই বিশিষ্ট আধুনিকতার জয়।

শুদ্ধবাদী টেস্ট দর্শকও কোহলির টেস্ট ব্যাটিংয়ের সরব গরিমা অস্বীকার করতে অপারগ। কারণ ব্যাটসম্যানশিপের যুগাতীত ঐতিহ্যের যে চিরন্তন ধারা, বিরাট কোহলি সেই ধারার অগুনতি বৈশিষ্ট্য সানন্দে বয়ে চলেছিলেন তাঁর ব্যাটিংয়ে। গুড লেংথের বলে তাঁর অন দ্য রাইস কভার ড্রাইভ, দেশ-বিদেশের পিচে অটল এক একটা শতক-দ্বিশতক, মিডল অর্ডারে নেমে সর্বময় কর্তার মতো প্রভুত্ব দর্শিয়ে ইনিংস অ্যাংকর করা, এসবই সেই চিরকালীন ক্রিকেটীয় গ্রেটনেসের অনাবিল সেলিব্রেশন। অফস্টাম্পের বাইরের বল খেলতে গিয়ে তাঁর পৌনঃপুনিক চ্যুতি তাঁর টেস্ট কেরিয়ারের শুরুতে আর শেষে সমালোচকদের খুঁত ধরবার সুযোগ দিয়েছে বারংবার। বিরাট কোহলিকে খানিক বদলাতে হয়েছে তাঁর ব্যাটিং। কিন্তু তাতে তাঁর স্বকীয়তায় চিড় ধরেনি। কালবিনির্ভর ব্রিলিয়ান্সের সঙ্গে একুশ শতকীয় টেম্পারামেন্টের সহজ সংশ্লেষ বিরাট কোহলির ব্যাটিংকে করে তুলেছে সবার হৃদয়গ্রাহী।

২০১৬ থেকে ২০১৮, পরপর তিনটে ক্যালেন্ডার বর্ষে বিরাট কোহলির মোট টেস্ট রানসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১২১৫, ১০৫৯ আর ১৩২২। রেকর্ডবই ঘেঁটে যা বুঝলাম, ম্যাথু হেডেন ছাড়া একটানা তিনটে ক্যালেন্ডার বর্ষে হাজারের ওপর টেস্ট রান করার মাইলফলক গড়েছেন একমাত্র কোহলিই। মোট চোদ্দটা টেস্ট সেঞ্চুরি আছে তাঁর এই সময়ে। যে আট বছর তিনি ছিলেন জাতীয় দলের টেস্ট অধিনায়ক, সেই সময়টায় ১১৩টা ইনিংস খেলে তাঁর গড় পঞ্চান্ন ছুঁইছুঁই, সেঞ্চুরি কুড়িটা। সাতটা আলাদা দেশের বিরুদ্ধে টেস্ট ক্রিকেট খেলেছেন কোহলি। প্রতিটি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তাঁর কম করে দুটো সেঞ্চুরি আছে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আছে ন'টা। ফোর্থ স্টাম্প সংলগ্ন অনিশ্চয়তার বারান্দায় হোঁচট খাবার প্রবণতার জন্য ইংল্যান্ডে আর নিউজিল্যান্ডে তাঁর রেকর্ড অতটা ঝকঝকে না হলেও, অস্ট্রেলিয়া আর দক্ষিণ আফ্রিকার পিচে তাঁর গড় প্রায় পঞ্চাশ।

তবে সংখ্যা দিয়ে কোহলির টেস্ট ক্রিকেট লিগ্যাসি বিচার করা মুশকিল। দশ হাজার রানের শৃঙ্গজয় অধরাই থেকে গেছে তাঁর। তাঁর সমসাময়িক আর যে তিন ব্যাটসম্যানের সঙ্গে তাঁর তুলনা হয়েছে, সেই স্মিথ-রুট-উইলিয়ামসন ত্রয়ীর প্রত্যেকের টেস্ট রান আর শতকের সংখ্যা কোহলির চেয়ে বেশি। চারজনের মধ্যে একমাত্র কোহলিরই কেরিয়ার অ্যাভারেজ পঞ্চাশের নীচে। স্রেফ পরিসংখ্যানগতভাবে দেখতে গেলে, টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে কোহলির তুলনা গাভাস্কার, সচিন, পন্টিং, দ্রাবিড়, কালিস এমনকী স্টিভ ওয়, সঙ্গকারা, বর্ডার বা ব্রায়ান লারার সঙ্গে হয় না, বরং হয় হাসিম আমলা বা গ্রেম স্মিথের সঙ্গে। কাছাকাছি সংখ্যক ইনিংসে সোয়া ন'হাজার মতো রান করেছেন আমলা, গ্রেম স্মিথ আর কোহলি। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের এক সংকটাকীর্ণ সময়ে জনমানসে এমন বিপুল ছাপ ফেলেছে কোহলির ব্যাটিং, যে এইসব সংখ্যার কচকচিকে বেরসিক ঘ্যানঘ্যানানি বলে মনে হয়।

ক্রিকেটজগতে ভারতের বাজার এবং ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অধুনা আধিপত্য যে সময়ে ভারতকে করে তুলেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ভরকেন্দ্র, সেই সময়ে ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা বিরাট কোহলি। তিনটে ফর্ম্যাট জুড়ে তাঁর সাবলীল শাসন যেমন চাঞ্চল্যকর, টেস্ট ক্রিকেটকে এক বিরাট ক্যাপটিভ অডিয়েন্সের কাছে অতিপ্রাসঙ্গিক করে তোলাটাও তেমনই বিস্ময়-উদ্রেককারী। সাদা বলের ক্রিকেটের বেতাজ বাদশা কোহলি যে ছত্রিশেই টেস্ট ক্রিকেট ত্যাগ করলেন, এতে কোহলি কিছুই হারালেন না, বরং দেড়শো বছর পার করে ফেলা টেস্ট ক্রিকেট ভারাক্রান্ত মনে হারাল এক অমূল্য সম্পদ, এইখানেই বিরাট কোহলি জিতে গেলেন। যে সমালোচক আর ট্রোলাররা তাঁর টেস্ট কেরিয়ারের শেষদিকে তাঁকে নিয়ত বিদ্ধ করতে ব্যস্ত ছিলেন, হেরে গেলেন তাঁরা। কোহলির ম্যাজিক ধুলোপড়া রেকর্ডের একঘেয়ে পাতায় পাওয়া মুশকিল। চোখ-ধাঁধানো হাইলাইট রিলের বর্ণময় জগতেও সেটার এক খণ্ডিত রূপই প্রকাশ পায় বড়জোর। লাল বলের ক্রিকেটে বিরাট কোহলির ম্যাজিক উজ্জ্বল হয়ে থেকেছে তাঁর গনগনে সজীবতায়। টেস্ট বিরাট কোহলির ম্যাজিকটা ঠিক কেমন, তা বুঝতে গেলে, "ইউ জাস্ট হ্যাড টু বি দেয়ার"। তিনি তৈরি করেছেন এমন সব মুহূর্ত, যেখানে তিনি আছেন, তাঁর ব্যাটিং আছে, আমরাও আছি — সে '১৩-র জোহানেসবার্গ হোক বা '১৪-র অ্যাডিলেড কিংবা '১৮-র এজবাস্টন। সজীব মুহূর্তের সহজ সৃষ্টি তাঁর ব্যাটে এমন নৈমিত্তিক ছিল বলেই এবার থেকে টেস্ট ক্রিকেটের বিরাট কোহলি স্মৃতিতেই খালি বেঁচে থাকবেন, এটা মানতে গেলে মন বিদ্রোহ করে।

More Articles