ভোটার অধিকার যাত্রা বুঝিয়ে দিল মোদি বিরোধিতার প্রধান মুখ রাহুলই
Voter Adhikar Yatra: নীতিশ কুমারের স্থানও হবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। এই আত্মবিশ্বাস দিয়েছেন রাহুল গান্ধী। আশার সঞ্চার করতে পেরেছেন সবার মধ্যে। ঘরে ফেরা মানুষের মুখে মুখে ফিরছে একটাই কথা, বিহারে এবার সরকার বদল হবে এবং তা এই...
সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। লক্ষ লক্ষ মানুষ পাটনার গান্ধী ময়দানে জড়ো হচ্ছেন, বিভিন্ন গেট দিয়ে প্রবেশ করছে ছোট বড় নানান মিছিল। সবার উদ্দেশ্য এক, দেশের লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীকে একবার নিজে চোখে দেখা। দীর্ঘ ১৩০০ কিলোমিটার ভোটার অধিকার যাত্রা শেষ হবে পাটনার ঐতিহাসিক গান্ধী ময়দানে। সেখানেই আসছেন রাহুল,সেই জন্যেই এই সাজো সাজো রব।
যদিও এই ভোটার অধিকার যাত্রা সরকারি ভাবে বিহারের সমস্ত বিরোধী দলের যৌথ কর্মসূচি, কিন্তু তাও, এই উদ্যোগে প্রথম থেকে সবার আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিলেন রাহুল গান্ধী। এই কর্মসূচি শুরুর ঠিক আগে সাংবাদিক সম্মেলনে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের কাজকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছিলেন রাহুল। উত্তরে নির্বাচন কমিশনও পাল্টা সাংবাদিক সম্মেলন করেছে। কিন্তু রাহুলের অকাট্য যুক্তিগুলি খণ্ডন করা যায়নি সেই সম্মেলন থেকে। মানুষের ভিড় বলছে, একটা বড় অংশই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে,বিজেপি এবং নির্বাচন কমিশনের আঁতাতের ফলেই আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসে আছেন নরেন্দ্র মোদী। তাই গান্ধী ময়দানও সরগরম। শ্লোগান দিয়ে চলেছেন সাধারণ মানুষ, ‘ভোটচোর গদ্দি ছোড়’। সমান উচ্ছ্বাসে শতকণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে ‘রাহুল
গান্ধী জিন্দাবাদ’। মানুষের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে ধরা পড়ছে প্রত্যয়, নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতমূলক আচরণের একমাত্র প্রত্যুত্তর হতে পারেন একজন মাত্র মানুষ, তিনি লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী।
এই রাহুল গান্ধী এক অন্য মানুষ। পাঁচ বছর আগেও আকছার তাঁকে পাপ্পু বলে মস্করা করত বিজেপি। কিন্তু গত পাঁচ বছরে কন্যাকুমারিকা থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত, ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ কিংবা জাতিগত দাঙ্গায় ক্লিষ্ট মণিপুর থেকে পশ্চিমের নাগপুর পর্যন্ত ‘ভারত জোড়ো ন্যায়যাত্রা’ রাহুল গান্ধীকে অনেক পরিণত করেছে। তিনি বুঝতে শিখেছেন এদেশের অন্তরাত্মা লুকিয়ে আছে সাধারণ, প্রান্তিক মানুষের মধ্যে। তাই তাঁদেরকে আপন করার কথা ভেবেছেন।
আরও পড়ুন- রাহুল গান্ধী, ক্রমেই ভরসাযোগ্য হয়ে উঠছেন যেভাবে
যেদিন থেকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বিহারের ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনী করা হবে, ভোটার তালিকা 'পরিশুদ্ধ' করা হবে, সেদিন থেকেই রাহুল গান্ধী-সহ সমস্ত বিরোধীরা বলা শুরু করেন, এই প্রক্রিয়া আসলে দেশের মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার সামিল। এক্ষেত্রে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়, সিপিআইএমএলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের কথা। তিনিই প্রথম বলেন এই প্রক্রিয়া আসলে ‘নোটবন্দি’র মতো ‘ভোটবন্দি’। হয়তো বা ঘুরপথে নাগরিক পঞ্জিকরণের প্রক্রিয়া।
দীর্ঘ ১৬ দিন ধরে বিহারের বিরোধী দলগুলোর যৌথ ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’ চলল। বিহারের ২২টি জেলা ঘুরে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে তা যখন পাটনার গান্ধী ময়দানে শেষ হল, এই পুরো পথ জুড়েই কিন্তু রাহুল গান্ধীর পাশে যাঁকে দেখা গেছে তিনি দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। হয়তো তেজস্বী যাদব কিংবা বিকাশশীল ইনসাফ পার্টির মুকেশ সাহানিও ছিলেন, কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় যা যা বক্তব্য রাহুল রেখেছেন মানুষের উদ্দেশ্যে, তা পরিষ্কার দেখিয়ে দিয়েছে রাহুলের রাজনৈতিক এই পথে অন্যতম সাথী কিন্তু দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। যখন রাহুল বলেন যে ওঁরা এখন ভোটাধিকার কাড়ছে, এরপর রেশন কার্ড কেড়ে নেবে, তারপর সংরক্ষণ কেড়ে নেবে, শেষমেষ জমি জিরেত কেড়ে তা আদানি আম্বানির হাতে তুলে দেবে, তখন তা শুনে অনেক কংগ্রেস কর্মীর হয়তো খটকা লাগতে পারে, কিন্তু রাহুল যে ক্রমশ ‘লেফট টু দি সেন্টার’ এই রাজনীতির প্রতি ঝুঁকছেন তা পরিষ্কার বোঝা যায়।
এই যাত্রার শেষ দিনে বিহার প্রশাসন চেষ্টা করে গিয়েছে যাতে ভোটার অধিকার যাত্রার এই সমাবেশের প্রশাসনিক অনুমতি না মেলে। যাতে পাটনা শহরের মানুষ এই উন্মাদনা স্বচক্ষে না দেখতে পারে। প্রথমে ঠিক ছিল, একটি সমাবেশের মধ্যে দিয়ে এই ভোটার অধিকার যাত্রা গান্ধী ময়দানে শেষ হবে, কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, গান্ধী ময়দানের গান্ধী মূর্তিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে ওই যাত্রা ৩ কিলোমিটার দূরের আম্বেদকর পার্কে শেষ হবে। এই সিদ্ধান্তে নড়েচড়ে বসে নীতিশ কুমারের প্রশাসন। এতদিন পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় সমাবেশ এবং যাত্রায় যাঁরা কোনোরকম অসহযোগিতা করেনি, সেই প্রশাসন কেন অনুমতি দিতে চাইল না? এখানেই লুকিয়ে আছে রহস্য।
আসলে বিজেপি জেডিইউ’র সরকার দেখেছে, রাহুল গান্ধীর জনপ্রিয়তা ক্রমশ ঊর্দ্ধমুখী, সমাজ মাধ্যমেও প্রচুর মানুষ রাহুল গান্ধীর কথা শুনতে চাইছেন। প্রচলিত গণমাধ্যমে এই ভোটার অধিকার যাত্রা’র খবর যত কম দেখানো যায় সেই চেষ্টা সত্ত্বেও যখন দেখা গেছে, রাহুল গান্ধীর জনপ্রিয়তার পারদ চড়ছে, তখন শাসকশিবির চেষ্টা করে যাতে পাটনা শহরের মানুষের কাছে যেন কোনোভাবেই রাহুলের বার্তা না পৌঁছয়। পাটনা শহরের মধ্যবিত্ত মানুষ যাঁরা নরেন্দ্র মোদীর বিকাশে মগ্ন, তাঁদের কাছে যদি অন্য বার্তা যায়, তাহলে সমূহ বিপদ।
প্রচুর কথা চালাচালির পরে অনেক দেরিতে এই সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। অসম্ভব রৌদ্রজ্বল দিন, বাতাসে আদ্রতার পরিমাণও ছিল বেশ বেশি। সকাল থেকে হাতে লাঠি, পিঠে শিশু নিয়ে গ্রামীণ মহিলারা পাটনা শহরের দখল নিয়েছিলেন। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে যাঁরা ওই সমাপ্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন, তাঁরাও ক্লান্ত বোধ করছিলেন। মেট্রোরেলের কাজ চলায় রাস্তাঘাট এমনিতেই গাড়িতে গাড়িতে পরিপূর্ণ ছিল, সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনে রাস্তায় এই খেটে খাওয়া মানুষজনদের বিভিন্ন ছোট বড় মিছিল ঢুকছিল গান্ধী ময়দানে। সবার মধ্যে একটা আত্মপ্রত্যয়, এবার হয়তো বিহারের সরকার বদল হবে এবং তাতে মুখ্য ভূমিকা রাখবেন তেজস্বী যাদব, রাহুল গান্ধী, দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের ‘মালে’ পার্টি এবং মুকেশ সাহানির ভিআইপি পার্টি।
সিপিআই থেকে শুরু করে কংগ্রেসের যে কোনও কর্মী, যাঁর সঙ্গেই কথা হয়েছে, যাঁকেই প্রশ্ন করেছি, যে এই ‘ভোটচোর’ কাকে বলা হচ্ছে? প্রতিটি মানুষের ধারণা সুস্পষ্ট। নির্বাচন কমিশন এবং বিজেপি যৌথভাবে ভুয়ো ভোটার ঢুকিয়ে ভোটার তালিকাকে নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করে এতদিন পর্যন্ত ভোটে জিতেছেন। এই বিষয়টা রাহুল গান্ধী বহু মানুষের মনে গেঁথে দিতে পেরেছেন। সংবাদমাধ্যমের ভূমিকায় হতাশ মানুষ নতুন সঞ্জীবনী পেয়েছেন রাহুলের টিমওয়ার্কে। রাহুল হয়ে উঠেছেন মোদী শিবিরের সবচেয়ে বড় বিরোধী মুখ। বিশেষ নিবিড় সংশোধনের নামে, ভোটার তালিকা পরিচ্ছন্ন করার নাম করে জীবিত বিরোধী ভোটারদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, মনে করছেন জমায়েতে অংশগ্রহণকারীরা। যাঁরা মনে করেন, মধ্যবিত্ত মানুষই রাজনীতির ধারণা তৈরি করেন, তাঁদের মুখে ভোটার অধিকারযাত্রার গান্ধী ময়দানের জমায়েত যেন বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়।
আরও পড়ুন- এবার ঝুলিতে ‘হাইড্রোজেন বোমা’, রাহুলের ঝোড়ো ব্যাটিংয়ের ফলাফল কী হবে?
ভোটার অধিকার যাত্রা আবারও প্রমাণ করছে এই মানুষেরাই আসলে দেশের চালিকাশক্তি। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নওয়াদা জেলার সংগঠক, বা মালে পার্টির দ্বারভাঙ্গার একজন সাধারণ সমর্থক কিংবা কংগ্রেসের গয়া জেলার হাঁটুর ওপর ধুতি পরা চন্দন পাসওয়ান তাই একইভাবে বলে ফেলেন, শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির যা অবস্থা হয়েছিল, একই অবস্থা হবে এ দেশের শাসকের। নীতিশ কুমারের স্থানও হবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। এই আত্মবিশ্বাস দিয়েছেন রাহুল গান্ধী। আশার সঞ্চার করতে পেরেছেন সবার মধ্যে। ঘরে ফেরা মানুষের মুখে মুখে ফিরছে একটাই কথা, বিহারে এবার সরকার বদল হবে এবং তা এই মানুষেরাই করবেন।
রাহুল গান্ধী বলে ওঠেন, কর্ণাটকের যে বিষয়টা তিনি সামনে আনার চেষ্টা করেছেন, তা ভোট চুরির কণামাত্র। ঐ অনুসন্ধান এবং তার ফলাফল যদি পারমানবিক বোমা হয়ে থাকে তাহলে আগামীদিনে তিনি ‘হাইড্রোজেন বোমা’ বিস্ফোরণ করতে চলেছেন। সেই শুনে সমবেত মানুষের হর্ষধ্বনি বুঝিয়ে দেয় এই নতুন জননেতাকে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করছে, ভরসা করতে শুরু করেছে। এই ‘ভোট চোর গদ্দি ছোড়’ শ্লোগান এখন বিহার ছাড়িয়ে জাতীয় স্তরের শ্লোগান হতে চলেছে। নেপথ্যে বিহারের বিরোধীদের অমানুষিক পরিশ্রম রয়েছে, রাহুল গান্ধীর স্বপ্ন রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। বিরোধী দলনেতা থেকে রাহুল গান্ধী এখন যে জননেতা হয়ে উঠছেন, মানুষের হৃদস্পন্দন পড়তে পারছেন তা এই ভোটার অধিকার যাত্রা বুঝিয়ে দিয়েছে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)

Whatsapp
