জেলেনস্কির উপর যুদ্ধবিরতির চাপ বাড়াচ্ছে ওয়াশিংটন?

US Peace Plan for Russia–Ukraine War: ইউক্রেনকে উল্লেখযোগ্যভাবে সামরিক বাহিনী কমিয়ে দিতে হবে; ৪ লাখের বেশি সৈন্য রাখা যাবে না। ইউক্রেনকে ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা কমাতে হবে; যাতে রাশিয়ার ভেতরে আঘাত হানার সক্ষমতা সীমিত থাকে।

আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যৌথভাবে একটি নতুন পরিকল্পনা তৈরি করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই পরিকল্পনাটি মোট ২৮ দফায় সাজানো; যুদ্ধ থামানোর শর্ত হিসেবে ইউক্রেনকে অস্ত্রের পরিমাণ কমানো থেকে শুরু করে কিছু ভূখণ্ড ছাড় দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত মানতে হতে পারে। এই খবর প্রকাশিত হয় এমন এক সময়ে, যখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি মার্কিন সামরিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

এই পরিকল্পনা এখনও যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার কোনো সরকারি প্রস্তাব নয়। তবে জেলেনস্কির কার্যালয় নিশ্চিত করেছে যে তিনি পরিকল্পনার একটি খসড়া পেয়েছেন; আগামী কয়েক দিনের মধ্যে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করবেন। এই পরিকল্পনা নিয়ে প্রায় এক মাস ধরে কাজ করছেন— মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। হোয়াইট হাউস জানায়, ইউক্রেনীয় ও রুশ দুই পক্ষের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে এমন শর্তগুলো নিয়ে মতামত সংগ্রহের কাজ চলছে।

হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বলেন, ট্রাম্প তাঁকে পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করেছেন; তিনি প্রস্তাবটি সমর্থন করে। তিনি এও বলেন, পরিকল্পনাটি রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়পক্ষের জন্য ভালো হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। লেভিট আরও জানান, পরিকল্পনাটি এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যাতে দুই পক্ষই তা গ্রহণ করতে পারে। তবে, যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত এই পরিকল্পনা নিয়ে ইউরোপে প্রকাশ করছে।

আরও পড়ুন

রাশিয়াকে ‘শাস্তি’ দিতে ইউক্রেনকে অস্ত্র! প্যাট্রিয়ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কী?

মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস ও ব্রিটেনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস নাম প্রকাশ না করা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে পরিকল্পনার খসড়া প্রকাশ করেছে। রয়টার্সও জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র জেলেনস্কিকে পরিকল্পনাটি মেনে নেওয়ার 'ইঙ্গিত' দিয়েছে; এর মধ্যে রয়েছে অস্ত্র ও কিছু ভূখণ্ড সমর্পণের শর্ত। বিনিময়ে মার্কিন নিরাপত্তা সুরক্ষা পাওয়ার কথাও আলোচনায় এসেছে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের দাবি, এই খসড়া পুরোপুরি রাশিয়ার পক্ষে এবং পুতিন সরকারের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরিকল্পনাটি তৈরিতে মূল ভূমিকা ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কর্মকর্তাদের।

অ্যাক্সিওসের তথ্য অনুযায়ী, ২৮ দফার এই কাঠামোর প্রধান দিকগুলো হলো—

ভূখণ্ডগত পরিবর্তন

রাশিয়া ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়া এবং পূর্বাঞ্চলীয় দনবাস অঞ্চলের (দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক) উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পাবে। ইউক্রেনকে দনবাস থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। দনবাসকে সেনামুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হবে; যতে কোনো পক্ষ সেনা মোতায়েন করতে পারবে না।

সামরিক সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা

ইউক্রেনকে উল্লেখযোগ্যভাবে সামরিক বাহিনী কমিয়ে দিতে হবে; ৪ লাখের বেশি সৈন্য রাখা যাবে না। ইউক্রেনকে ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা কমাতে হবে; যাতে রাশিয়ার ভেতরে আঘাত হানার সক্ষমতা সীমিত থাকে।

জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসনের যুদ্ধরেখা

এই অঞ্চলের বর্তমান যুদ্ধরেখাগুলো স্থির রেখা হিসেবে ধরা হবে। কোনো অংশ ইউক্রেনকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে কিনা তা ভবিষ্যতের আলোচনায় নির্ধারিত হবে।

ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ-নোয়েল বারো বলেন, ইউক্রেন এমন শান্তি চায় যা সার্বভৌমত্ব বজায় রাখবে এবং ভবিষ্যতে আগ্রাসনের আশঙ্কা তৈরি করবে না। তিনি স্পষ্ট বলেন, 'শান্তি মানে আত্মসমর্পণ নয়।' ইইউ পররাষ্ট্র প্রধান কাজা ক্যালাস জানান, যে কোনো শান্তি প্রস্তাব কার্যকরের জন্য ইউরোপ ও ইউক্রেনের সমর্থন অপরিহার্য। পোলিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাদোস্লাউ সিকোরস্কি বলেন, যে কোনো সম্ভাব্য চুক্তির বিষয়ে ইউরোপের সঙ্গে পরামর্শ করা হবে, এই প্রত্যাশা তাদের রয়েছে।

বিশ্লেষকদের ধারণা এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তা ইউক্রেনের পক্ষে একেবারেই সুবিধাজনক নয়। ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা কমালে ভবিষ্যতে রাশিয়ার মোকাবিলায় ইউক্রেন খুব দুর্বল হয়ে পড়বে। রাশিয়ার দখলকৃত অঞ্চলগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হতে পারে কিয়েভ। এই পরিকল্পনাকে ইউরোপের সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্যও অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

আরও পড়ুন

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে গিয়ে শ্যুটিং? যেভাবে ‘RRR’-র গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি

উল্লেখ্য, রাশিয়ার আক্রমণে ইউক্রেনীয় সেনারা পূর্বাঞ্চল থেকে পিছু হটছেন। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কূটনৈতিক উদ্যোগে যোগ দিতে জেলেনস্কির উপর চাপ বাড়ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দাবি করেছেন, ২০২৪ সালে রুশ সেনারা প্রায় ৫,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করেছে। তবে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (ISW)-এর তথ্য অনুযায়ী, দখলের পরিমাণ ৩,৪৩৪ বর্গকিলোমিটার।

অন্যদিকে, ২০২৪-২৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেন ইস্যুতে বারবার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। অগাস্টে, তিনি বলেছিলেন, উভয় পক্ষকেই ভূখণ্ড ছাড়তে হবে (জেলেনস্কি প্রত্যাখ্যান করেন)। সেপ্টেম্বরে ট্রাম্প বলেন, ন্যাটো ও ইইউ-এর সহায়তায় ইউক্রেন হারানো এলাকা পুনরুদ্ধার করতে পারে। অক্টোবরে, তিনি যুদ্ধকে বর্তমানে যেসব রেখায় আছে সেখানেই স্থগিত করার আহ্বান জানান, যদিও রাশিয়া তা মানেনি। বিশ্লেষকদের মতে, এই অসঙ্গত অবস্থান ভবিষ্যৎ আলোচনায় সমস্যা তৈরি করতে পারে।

বিশ্লেষকদের ধারণা, ইউক্রেন ও ইউরোপ সম্ভবত পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করবে। এতে নতুন করে আলোচনা শুরু হবে, ইউক্রেন এবং ইউরোপও নিজেদের দাবি উপস্থাপন করতে পারে। সব পক্ষই জানে, তাদের প্রস্তাব অন্য পক্ষ প্রত্যাখ্যান করবে। ফলে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাপ পড়বে ইউক্রেন ও ইউরোপের উপর। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা, বিশেষত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থান আগামী দিনের কূটনৈতিক পরিস্থিতি নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে।

More Articles