WBCS: স্বপ্ন দেখেন অনেকেই, জানেন না প্রস্তুতির এই প্রথম ধাপটুকুও
WBCS Preparation: ইন্টারভিউ আসলে ভবিষ্যতের আধিকারিকদের সামনাসামনি যাচাই করে নেওয়ার একটি পদ্ধতি মাত্র। সেখানে ইংরেজি অথবা বাংলা কোন ভাষায় কথা বলছেন তা ততটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারি চাকরির হাতে গোনা যে কয়েকটি পরীক্ষা এখনও পর্যন্ত নিয়মিতভাবে হয় তার মধ্যে একটি ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস। যেখানে সাধারণত চারটি গ্রুপে নিয়োগ হয়। গ্রুপ এ, গ্রুপ বি, গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি। এর মধ্যে গ্রুপ এ হলো সর্বোচ্চ পদ বা আধিকারিক পদ। গ্রুপ বি তে রয়েছে পুলিশ সার্ভিস। এছাড়াও গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি তে রয়েছে ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার, পঞ্চায়েত ডেভলমেন্ট অফিসার ইত্যাদি পদ। প্রতি বছর প্রায় লক্ষাধিক প্রার্থী এই পরীক্ষায় অংশ নেন, যার মধ্যে নিয়োগ হন মাত্র ৬০০-৭০০ জন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা মূলত তিনটি ধাপে হয়ে থাকে। প্রিলিমিনারি, মেইন এবং ইন্টারভিউ।
এই পরীক্ষা নিয়ে মানুষের মধ্যে একপ্রকার ভুল ধারণাও রয়েছে। যেমন, প্রথমেই সকলে মনে করেন এই পরীক্ষার নির্দিষ্ট কোনও সিলেবাস নেই, সেক্ষেত্রে অনেকেই বাজারে প্রচলিত বেশ কিছু বই কিনে চটজলদি প্রস্তুতি শুরু করে দেন। যার ফলে শুরু হয় বিপত্তি। স্কুল থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত যেমন নির্দিষ্ট সিলেবাস রয়েছে ঠিক তেমনই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ক্ষেত্রেও ভাগ করে দেওয়া আছে একজন পরীক্ষার্থী ঠিক কী পড়বেন এবং কতটা পড়বে।
এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বাজারে বইয়ের অভাব নেই, বরং প্রয়োজনের চাইতে অনেক বেশিই রয়েছে। ধরা যাক, কেউ হয়তো বলবেন ইতিহাসের জন্য সোনালি বনসালের মডার্ন হিস্ট্রি পড়ার কথা, আবার কেউ হয়তো বলবেন আধুনিক ভারতের ইতিহাসের জন্য রাজীব আহিরের স্পেকট্রাম। সেক্ষেত্রে নতুন পরীক্ষার্থীরা অনেক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে একটি বিষয়ের জন্যই একাধিক বই পড়তে শুরু করেন। তবে মনে রাখা দরকার, ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল পরীক্ষা মূলত ৮০-২০ নিয়মে হয়। অর্থাৎ যেকোনও একটি বেসিক ভালো ভাবে পড়লেই পরীক্ষায় ৮০ শতাংশ জানা জিনিস পাওয়া যেতে পারে এবং বাকি যে ২০ শতাংশ থাকে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে রেফারেন্স বুক হিসেবে আরও ১/২ টি বই প্রয়োজন হলে পড়া যেতে পারে। তবে তা কখনই চোখ-কান বন্ধ করে পুরো বই পড়ে ফেলা নয়। রেফারেন্স বই থেকে কী পড়ব এবং কতটা পড়ব তা একজন পরীক্ষার্থী তখনই নির্ণয় করতে পারবেন যখন তিনি পুরনো প্রশ্নপত্রের নিখুঁত গবেষণা করবেন এবং এই বিষয়ে একজন পরীক্ষার্থীর সম্পূর্ণ ধারণা হতে সময় লাগে প্রায় ছয় থেকে সাত মাস। সুতরাং একজন নতুন পরীক্ষার্থীর প্রথম টার্গেট ৮০ শতাংশকে রপ্ত করা। তাই এক্ষেত্রে নবম দশম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে অথবা NCERT নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্য বই পড়া যেতে পারে। আসলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরীক্ষার্থী ২০ শতাংশ প্রস্তুতির ওপর বেশি মনোযোগ দিয়ে ফেলেন। যার ফলে বাজারে প্রচলিত বইয়ের বিক্রি বাড়লেও বছর পেরিয়ে হতাশায় ভোগেন পরীক্ষার্থীরা।
আরও পড়ুন- কোচিং না নিয়েই UPSC পাশ! প্রস্তুতির যে সহজ উপায় আছে হাতের নাগালেই
বর্তমানে স্কুল বা কলেজ পড়ুয়াদের মতো ভূরি ভূরি নম্বর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাওয়া যায় না। সর্বনিম্ন ৫৪-৫৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৬২-৬৩ শতাংশ পেলেই এখানে সিলেকশন পাওয়া সম্ভব। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ক্ষেত্রে একজন পরীক্ষার্থীর লক্ষ্য কখনই প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়া নয় বরং পছন্দের পদটিতে নিয়োগ হওয়ার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। কারণ কোনও নির্দিষ্ট পদে ১০টি শূন্যপদ থাকলে এখানে প্রথম স্থানাধিকারি এবং দশম স্থানাধিকারির মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকে না। কারণ দু’জনেই একই পদে নিয়োগ হন। সুতরাং লক্ষ্য স্থির করা এক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, নিজের দুর্বলতার দিকগুলি চিহ্নিত করা। সেক্ষেত্রে পড়াশোনার পাশাপাশি স্বমূল্যায়ন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, হতে পারে কেউ অঙ্কে তুখোড় আবার কেউ ইতিহাসে। কেউ আবার অবজেক্টিভ টাইপ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কৌশল ভালো জানেন, কেউ আবার বর্ণনামূলক।
ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস এবং ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষার মধ্যে তফাত কোথায়?
সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার কথা শুনে অনেকেই মনে করেন ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস এবং ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা একই রকম। যেকোনও একটি প্রস্তুতি নিলে অন্যটিরও হয়ে যায়। তবে দু’টি পরীক্ষার মধ্যে বেশ অনেকটা অমিল রয়েছে। ধরন গড়ন দুই দিক থেকেই দু’টি পরীক্ষা আলাদা। যেমন –
১. দু’টি পরীক্ষাই তিনটি ধাপে হয়, প্রিলিমস, মেইনস এবং ইন্টারভিউ। তবে ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ধরন অবজেক্টিভ টাইপ। যেখানে ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শুধুমাত্র অবজেক্টিভ টাইপ এবং মেইনস সম্পূর্ণ বর্ণনামূলক অর্থাৎ ডেসক্রিপটিভ।
২. ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ভূগোলের সিলেবাস ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রিক। উল্টোদিকে ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনে তা ভারত এবং গোটা বিশ্বকেন্দ্রিক।
৩. ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আমলা পদে চাকরির জন্য সকল পরীক্ষার্থীকে অপশনাল সাবজেক্ট বা ঐচ্ছিক বিষয়ের পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র গ্রুপে এ এবং গ্রুপ বি পদের জন্যই অপশনাল সাবজেক্ট বাধ্যতামূলক।
৪. ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস মেইনস পরীক্ষায় ২০০ নম্বরের অঙ্ক রয়েছে। অন্যদিকে ইউপিএসসি পরীক্ষায় শুধুমাত্র প্রিলিমিনারিতে অঙ্কের জন্য একটি CSAT পেপার রয়েছে যা শুধুমাত্র একটি কোয়ালিফাইং পেপার অর্থাৎ সেখানে ৩৩ শতাংশ নম্বর পেলেই মেইনস পরীক্ষায় বসা যায়। আলাদা করে মূল পরীক্ষায় অঙ্ক থাকে না।
৫. ইউপিএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কনসেপচুয়াল বা ধারণামূলক হয়। উল্টোদিকে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নের ধরন অনেক বেশি সরাসরি অর্থাৎ টু-দ্য-পয়েন্ট হয়। যদিও বিগত কয়েকটি পরীক্ষায় ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের প্রশ্নপত্রে ইউপিএসসি প্রিলিমিনারির ধরন লক্ষ্য করা গেছে। ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় কোন বিষয় থেকে কত নম্বরের প্রশ্ন আসবে তা সিলেবাসে নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে।
আরও পড়ুন- উচ্চমাধ্যমিক ফেল ছাত্র আজ ইউপিএসসি চেয়ারম্যান! হার না মানা লড়াই অনুপ্রেরণা হতে পারে
যেমন –
ইংরেজি – ২৫
সাধারণ বিজ্ঞান – ২৫
রাষ্ট্র বিজ্ঞান এবং অর্থনীতি – ২৫
ভূগোল – ২৫
ভারতীয় ইতিহাস – ২৫
স্বাধীনতা সংগ্রাম – ২৫
অঙ্ক এবং রিজনিং – ২৫
কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এবং সাধারণ জ্ঞান – ২৫
অর্থাৎ প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ২০০ নম্বর বিষয় ধরে ভাগ করে দেওয়া থাকে। ইউপিএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে এমন সুযোগ নেই।
প্রিলিমিনারি এবং মেইন পরীক্ষার গণ্ডি পেরোলেই আসে ইন্টারভিউ। যেখানে প্রায়শই হাবুডুবু খায় বহু কৃতী প্রার্থীও। বেশিরভাগ সময়ই মূল সমস্যা হয়, কোন ভাষায় ইন্টারভিউ দেবেন তা নিয়ে। অনেকেই মনে করেন, ইংরেজি ভাষায় ইন্টারভিউ দিলেই সিলেকশনের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। তবে যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে একাধিক পদে নিযুক্ত রয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় ইন্টারভিউ আসলে ভবিষ্যতের আধিকারিকদের সামনাসামনি যাচাই করে নেওয়ার একটি পদ্ধতি মাত্র। সেখানে ইংরেজি অথবা বাংলা কোন ভাষায় কথা বলছেন তা ততটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ সকলেরই কাজের পরিধি হবে গ্রাউন্ড লেভেলে অর্থাৎ সকাল থেকে রাত অবধি সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষার উপরই নির্ভর করে থাকবে যোগাযোগ মাধ্যম। তাই এক্ষেত্রে একজন প্রার্থীকে ইন্টারভিউর প্রস্তুতির জন্য ভাষার থেকেও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে সততার উপর। যার উপর ভিত্তি করেই হবে ফাইনাল সিলেকশন।