অন্য জন্মে, অন্য বিশ্বে আমাদের ফের দেখা হবেই
Irfan Khan: ও চলে যাওয়ার পরেও আমি রাতের পর রাত ওর সমস্ত প্রেসক্রিপশন পড়েছি, পড়েই গিয়েছি স্ক্রিপ্টের মতো। কোথাও কি ভুল হয়ে গেল আমারই!
বন্ধু! গত ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বছর ধরে এই শব্দটার আর একটা অর্থ আমার কাছে ইরফান। প্রেমিক, জীবনসঙ্গী, সন্তানের পিতার থেকেও ও আমার অনেক বেশি বন্ধু। প্রায় কয়েক দশক ধরে। যে বন্ধুত্বটার শুরু হয়েছিল দিল্লির এনএসডি-তে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেখা হওয়াটা কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। কোথাও লেখা ছিল এই দেখা হওয়া। লেখা আছে, আজও!
ইরফানের সঙ্গে প্রথম আলাপটা অবশ্য ছিল বেশ মজার। ওর তখন মিঠুন চক্রবর্তীর মতো বড় বড় চুল, উস্কোখুস্কো। খুব রোগা-পাতলা চেহারা। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, প্রথম দেখায় ওকে তেমন পছন্দও হয়নি আমার। দিল্লিতেই আমার জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা। বরাবরই ডাকাবুকো, প্রথাভাঙা। দশটা-পাঁচটার চাকরি করার ইচ্ছে হয়নি কোনওদিন। অন্যরকম কিছু করার ভাবনা থেকেই ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার পরীক্ষায় বসা। তবে পরীক্ষায় বসার আগেই কিন্তু আমি এনএসডি রেইকি করে এসেছি। তখনই থার্ড ইয়ারের কয়েকজন সিনিয়রের সঙ্গে আলাপ হয়, আলাপ গড়ায় বন্ধুত্বে। এনসিডি-তে দ্বিতীয় পরীক্ষা। সেই দিনই প্রথম দেখা হয় আমার সঙ্গে ইরফানের। আমাকে কোনও একটি জায়গার দিকনির্দেশ জিজ্ঞেস করেছিল ও। সদুত্তর তো পায়ইনি, বরং সিনিয়র সেজে আমিই ওকে ব়্যাগিং করেছিলাম। কিন্তু ইরফান! ভীষণ ভদ্র, ভীষণ ভালো ব্যবহার। ম্যাম, ম্যাম বলে আমার সব কথার উত্তর দিয়েছিল সেদিন!
তারপর পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখে, আরে এ তো সেই মেয়েটাই! এ-ও তো একই পরীক্ষা দিতে এসেছে। সেটা জানার পর ভীষণ রেগে গিয়েছিল ও। সম্ভবত আমাকে অপছন্দও করেছিল। আমি মোটেও পাত্তা দিইনি তাতে। তারপর এনএসডি-তে পড়াকালীন কীভাবে যেন বন্ধুত্ব হয়ে গেল। দিল্লির সিআরপার্কে আমাদের বাড়িতে এনএসডি-র সমস্ত বন্ধুরা আসত। ঘরের একটি কোণায় ভাইয়ের পড়াশোনার বইপত্তর থাকত। সেখানে গিয়ে চুপটি করে বসে পড়ত ও। শুধু কলেজজীবনে নয়, পরের দিনগুলোতেও কিন্তু দিল্লির বাড়িতে ইরফানের প্রিয় কোণা ছিল ওইটাই । শান্ত, মিষ্টি ছেলেটাকে মা-বাবাও পছন্দ করে ফেলেছিল বেশ। না, তখনও আমাদের মধ্যে প্রেম, প্রণয় কিছুই ছিল না। বরং যা ছিল, তা হল নিখাদ বন্ধুত্ব। আর সেই নিখাদ বন্ধুত্ব এমনই, আমি কীভাবে যেন হয়ে গিয়েছিলাম ইনট্রোভার্ট ইরফানের মেসেঞ্জার। এমনকী এনএসডি-র প্রফেসরদের কাছেও। ইরফানের সমস্ত কথাটুকু পৌঁছে দেওয়ার মতো একজন নিখাদ বন্ধু।
আরও পড়ুন: সুশান্ত থেকে কে কে- আমাদের মৃত্যুশোক ভুলিয়ে দেয় মুহূর্তের প্রতিশোধ
কিন্তু তখন থেকেই অভিনেতা হওয়ার একটা আশ্চর্য রকম খিদে ছিল ওর মধ্যে। ভীষণ সিরিয়াস, ভীষণ সিনসিয়ার। আমি অবশ্য অভিনয়ের পথে হাঁটিনি কোনওদিনই। আমার আগ্রহ ছিল পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার হওয়ার দিকে। একটা সময় পর গিয়ে এনএসডি-তে অভিনেতা আর ডিরেক্টর হওয়ার পড়াশোনাটা আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু তার আগে দেড় বছর একসঙ্গে পড়াশোনা করতে হয়েছে আমাদের। কিন্তু সত্যি বলতে আমি কোনওদিন অভিনেতাকে বিয়ে করতেই চাইনি। অলক্ষ্যে বসে ঈশ্বর বোধহয় হেসেছিলেন। মনে আছে, কোনও এক রাতে এনএসডি-র ইউনিয়ন রুমের সামনে বসে, সেই প্রথম আমাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথাবার্তা হল। তারপর আমি কতবার জয়পুরে গিয়েছি। ইরফান দিল্লিতে সিআরপার্কে এসে থেকেছে। আমাদের ধর্মটা আলাদা। না, আমরা সামাজিক বিয়ে করিনি কোনওকালেই। আইনি সইসাবুদ করে বিয়ে হয়েছিল মাত্র। না আমি ধর্মন্তরিত হয়েছি, না ইরফান। হ্যাঁ, ইরফানকে বিয়ে করছি শুনে মা একটু ইতঃস্তত করেছিল বটে। কিন্তু বাবা! বাবা এসব নিয়ে কোনওদিনই মাথা ঘামাননি। দু-বাড়ি থেকেই কোনও বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি আমাদের। আমাদের আংটিবদল হয়নি, মালাবদল হয়নি, ইসলাম কোনও রীতিরেওয়াজ মেনে নিকাহও নয়। লোন নেওয়ার প্রয়োজনেই তড়িঘড়ি বিয়েটা সেরে ফেলেছিলাম তখন।
মুম্বই আমার পছন্দ ছিল না কোনওকালেই। কিন্তু ইরফান! ও জানত অভিনয়জগতে ওর কিছু করার আছে। এনএসডি-তে থাকতে একবার গোর্কির একটা নাটক অভিনীত হওয়ার কথা। তার একটা চরিত্রের জন্য প্রতিদিন সকালে উঠে জামা মসজিদে গিয়ে বসে থাকত ধুলোর মধ্যে। গরিব ভিখারির চরিত্রে অভিনয়ের জন্য চাঁদনী চকে গিয়ে দিনের পর দিন শুয়ে থেকেছে। এমনই ছিল ইরফান। বলতে দ্বিধা নেই, কাজের প্রতি, নিজের বিশ্বাসের প্রতি ওর ওই সততাই বোধহয় আমাকে আকর্ষণ করেছে বরাবর। কাজের জগতেও বরাবর ভীষণ রকম অন্তর্মুখী ছিল ইরফান। বলিউডের পার্টি, অনুষ্ঠান এড়িয়ে যেত চিরটাকালই। হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব বাদ দিলে কাজের পর পরিবারের সঙ্গে থাকতেই বেশি আরাম পেত ও। তবে ওই যে কাজের ব্যাপারে ভীষণ রকম সিরিয়াসনেস, সেই জায়গাটা নড়বড়ে হতে দেখিনি কখনও। একটা স্ক্রিপ্ট বারবার পড়ত ইরফান। বারবার, পড়েই যেত। ও-ই একমাত্র পরিচালক, যে আমাকে দিয়ে একটা চিত্রনাট্য বারবার লিখিয়েছে। খালি বলত- "ভালো হচ্ছে না। আরও ভাবো।" সেই নিরপেক্ষ সমালোচনা করার মতো কেউ নেই আর। যে মুখের উপর বলে দিতে পারে, হয়নি। আর একটা মজার ব্যাপার ছিল ইরফানের। প্রতিটা আলাদা ছবি, আলাদা চরিত্রের জন্য় তৈরি হয়ে ওঠার সময়ক গান শুনত ও। আলাদা আলাদা ধরনের মিউজিক। কীভাবে সেটা ওকে চরিত্র হয়ে উঠতে সাহায্য় করত জানি না। তাছাড়া চরিত্রের পোশাকআশাক, সাজগোজ নিয়েও ভীষণ খুঁতখুঁতে ছিল ও।
সত্যি বলতে ইরফানের সঙ্গে জীবনের লড়াইগুলোকে লড়াই মনে হয়নি কোনওদিন। তার অন্যতম কারণ বোধহয় ছিল আমাদের বন্ধুত্ব। কোনও অভাব অভিযোগ ছাড়াই সেই দিনগুলোয় মুম্বইশাসন করে বেরিয়েছি আমরা। বম্বের আর পাঁচটা হিরো-অভিনেতা হওয়ার চাপ ছিল না ইরফানের উপর। আমার দিক থেকেও সেই চাহিদাগুলো ছিল না কখনওই। ফলে ও নিজের ইচ্ছামতো স্ক্রিপ্ট বাছতে পেরেছে। মনের মতো অভিনয় করতে পেরেছে। আর সেটাই আমার কাছে বড় পাওয়া। আমরা ভীষণ আলাদা দু'জন মানুষ। দু'জনের স্বতন্ত্রতাকে সঙ্গে নিয়েই একসঙ্গে বেঁচেছি। একে অপরের প্রয়োজনে সবসময় পাশে থেকেছি, পাশে পেয়েছি। না, আমি ওর জন্য কোনও আলাদা করে আত্মত্যাগ করেছি, এ কথা ভুল। আমি নিজের ইচ্ছায় বেছে নিয়েছি এই পাশে থাকা, নিঃশর্ত পার্টনারশিপ। কোনওদিনও ইরফানকে বলা হয়নি, আমি ওর বন্ধু হতে পেরে, সঙ্গী হতে পেরে ঠিক কতটা ভাগ্যবান। বাবিল দেখতে অনেকটাই ওর বাবার মতো। কিন্তু ও অনেক বেশি বহির্মুখী। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসে। একই সঙ্গে ভীষণ পরিশ্রমীও। আর সেটা ও একেবারেই বাবার থেকে পেয়েছে। আয়ান পেয়েছে অনেকটাই ইরফানের স্বভাব। ও এতটাই অন্তর্মুখী যে ছবির প্রিমিয়ারে পর্যন্ত যেতে চাইত না। বাবিলের সঙ্গে ইরফানের সম্পর্কটাও ঠিক যতটা না পিতাপুত্রের ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল বন্ধুত্বের। ওদের সেই বন্ধুত্বে কোনও অর্গল ছিল না। আজ যখন ইরফানের মেকআপ আর্টিস্টরাই বাবিলকে শুটের জন্য তৈরি করে দেয়, নস্টালজিক তো লাগেই। তবে আমি দুই ছেলের মধ্যে আমি কখনও ইরফানকে খুঁজি না। কারণ ইরফান আমার সঙ্গেই আছে। ভীষণ রকম আছে। হঠাৎ মাঝরাত্তিরে যখন বৃষ্টি আসে, কিংবা ওর বইয়ের তাক থেকে পছন্দের বইটা হাওয়ায় পড়ে যায়, আমি অনুভব করতে পারি ওর উষ্ণতা, ওর সেই ভীষণ চেনা বন্ধুত্বের স্পর্শ।
ইরফান বিশ্বাস করত, প্রায়শই বলতও যে "আমায় দেখা যাচ্ছে না মানেই যে আমি নেই, এমনটা তো নয়"। প্রায় চার বছর হয়ে গেল ইরফান নেই। ওর শরীরে বাসা বাঁধা সেই অচেনা অতিথির সঙ্গে শেষপর্যন্ত সমঝোতায় আসতে পারেনি ইরফান। ওর অসুখটার বিষয়ে যখন জানতে পারি, ওর তখন অ্যাডভান্স স্টেজ। আমি একটা মুহূর্তও সময় নষ্ট করতে চাইনি। যেখানে যা যোগাযোগ করা সম্ভব, যেখানে যাওয়ার প্রয়োজন গিয়েছি। ছবির দক্ষ প্রযোজকের মতোই সব কিছু একা হাতে সামলেছি, যা দরকার ছিল হাতের কাছে নিয়ে এসেছি। আমি মনে মনে দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করতাম, আমি ইরফানকে বের করে আনব এই অসুখের ফাঁদ থেকে। ইরফানকেও সেটা বিশ্বাস করিয়েছি। ওর অসুখের খবরে শোক করার মতো সময় আমার হাতে ছিল না। কোনওদিনও ইরফানের জন্য নার্স রাখা হয়নি বাড়িতে। ওই সময়টা ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা আমি ওর সঙ্গে থেকেছি, সেবা করেছি। ৬ মাসের মধ্যেই চিকিৎসায় সাড়া দেয় ইরফান। কাজেও ফেরে। তার পর ফের ফিরে আসে শরীরে বাসা বাঁধা সেই ভয়াল অতিথি। ইরফান চলে যাওয়ার পরেও আমি রাতের পর রাত ওর সমস্ত প্রেসক্রিপশন পড়েছি, পড়েই গিয়েছি স্ক্রিপ্টের মতো। কোথাও কি ভুল হয়ে গেল আমারই! সেই প্রথমবার আমাকে ছাড়া হাসপাতালে গেল ইরফান। আর ফিরল না। অথচ হাসপাতালে যাওয়ার আগের দিনও বাগানের কোন খানে কোন গাছটা বসবে, সেই নিয়ে আলোচনা করেছি আমরা।
আরও পড়ুন: বলিউডের নতুনরা খারাপ ছাত্র, সকলে শুধু বিখ্যাত হতে চায়: তিগমাংশু ধুলিয়া
তবে আমি বিশ্বাস করি, আমাদের রাস্তাটা এখনও শেষ হয়নি। আমাদের আবার দেখা হবে। এই জন্মে না হলে পরের জন্মে। এই বিশ্বে না হলে অন্য় কোনও বিশ্বে। আমাদের পথচলা এইটুকুতেই শেষ হতে পারে না কিছুতেই। আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি। এতদিনে হয়তো ইরফান অন্য কোথাও জন্মগ্রহণ করেছে ফের। আমি বিশ্বাস করি, সেই সদ্যজাত শিশুটির সঙ্গেও আমার দেখা হবে কোনও না কোনও ভাবে। আমার আর ইরফানের দেখা হওয়াটাই ভবিতব্য। বারবার দেখা হবে আমাদের, হবেই।
(কথোপকথনভিত্তিক অনুলিখন। সৌজন্যে:সিরাজ মুখোপাধ্যায়)