১ বৈশাখেই 'বাংলা দিবস' কেন? কোথা থেকেই বা এল রাজ্যসঙ্গীতের ধারণা?
West Bengal Day: কবে পালন করা উচিত পশ্চিমবঙ্গ দিবস, সেই প্রশ্নে সংখ্যগরিষ্ঠের ভোট ছিল ১ বৈশাখের দিকেই। সেই সিদ্ধান্ত মতোই বৃহস্পতিবার বিধানসভায় এই সংক্রান্ত প্রস্তাব পেশ করা হয়।
বাংলা দিবস পালন নিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অনড়ই রইলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আনুষ্ঠানিক ভাবে ১ বৈশাখ দিনটিকেই পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসেবে উদযাপনের ব্যাপারে বিধানসভায় পাশ করা হল প্রস্তাব। যদিও সেই প্রস্তাবে সই করেননি রাজ্যপাল। বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানায় বিরোধী দল বিজেপিও। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ব্যাপারটি নিয়ে কম বিরোধিতা করেননি। তবে মুখ্যমন্ত্রী ও শাসকদলের অন্যান্য বিধায়কদের দাপটের মুখে বিশেষ ধোপে টেকেনি বিরোধীদের আপত্তি। শেষপর্যন্ত ভোটাভুটিতে পাশ হয়েই গেল পশ্চিমবঙ্গ দিবস নিয়ে আনা মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব। অন্য কোনও দিন নয়, ১ বৈশাখেই রাজ্যবাসী পালন করবেন পশ্চিমবঙ্গ দিবস।
আগেই নবান্নে একটি সর্বদল বৈঠক করে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। যেখানে হাজির ছিলেন নানা বিশিষ্টজন, সমাজকর্মী এবং সংবাদমাধ্য়মের প্রতিনিধিরা। ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সদস্যরাও। যদিও সেই বৈঠকে গড়হাজির ছিলেন বিজেপি ও বামেরা। কবে পালন করা উচিত পশ্চিমবঙ্গ দিবস, সেই প্রশ্নে সংখ্যগরিষ্ঠের ভোট ছিল ১ বৈশাখের দিকেই। সেই সিদ্ধান্ত মতোই বৃহস্পতিবার বিধানসভায় এই সংক্রান্ত প্রস্তাব পেশ করা হয়।
আরও পড়ুন: জাতীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের ‘রাজ্যসঙ্গীত’ থাকা কতটা জরুরি?
একই সঙ্গে সেদিনের সর্বদল বৈঠকে রাজ্যসঙ্গীত নির্বাচনের ব্য়াপারটি নিয়েও বেশ কিছুটা আলোচনা হয়। সেই মঞ্চ থেকেই উঠে এসেছিল রবিঠাকুর রচিত 'বাংলার মাটি বাংলার জল' গানটিকে রাজ্যসঙ্গীত হিসেবে তুলে আনার কথা। সে বিষয়টি নিয়েও এদিন বিধানসভায় প্রস্তাব পাশ করা হয়েছিল। তবে সহজ ছিল না সেই প্রস্তাব পাশের প্রক্রিয়া। কারণ রাজ্যের রাজ্যপাল নিজেই বিষয়টির সঙ্গে একমত নন। তার উপর গোড়া থেকেই বিষয়টি নিয়ে প্রবল অসহোযোগিতা দেখিয়ে এসেছে বিরোধী দল বিজেপি। এদিন বিধানসভাতেও প্রথম থেকেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে শুরু করেছিল বিজেপি। আর তাতে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ছিলেন মুখ্য ভূমিকায়। তবে শেষ পর্যন্ত জয় এসেথে মুক্যমন্ত্রীর কোর্টেই। ভোটাভুটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে পাশ হয়ে যায় প্রস্তাবটি। সই করেননি রাজ্যপাল নিজেও। তবে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে টলানো যায়নি মুখ্যমন্ত্রীকে।
পশ্চিমবঙ্গ দিবস বিতর্কের শুরু মাস কয়েক আগেই। দেশের বহু রাজ্যেই রাজ্যদিবস পালনের রীতি রয়েছে। রয়েছে রাজ্যসঙ্গীতের চলও। তবে পশ্চিমবঙ্গ বহুকাল ধরেই এই রসে বঞ্চিত। তবে গত ২০ জুন হঠাৎ করেই রাজভবনের তরফে পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন করা হয়। যে ব্যাপারটিকে মোটেও ভালো ভাবে দেখেননি রাজ্যের বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদ, সাহিত্যিক থেকে শুরু করে নানা মহলের মানুষ। সর্বোপরি বাংলার মানুষই বিষয়টি মন থেকে মানতে পারেননি।
এত দিন থাকতে কেন হঠাৎ করে ২০ জুনকেই পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসেবে তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর হয়ে পড়লেন রাজ্যপাল, কারই বা মদতে? সে প্রশ্নের উত্তর আলাদা করে খুঁজতে হয় না। তবে পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে ২০ জুন দিনটি ভারতবাসীর জন্য মোটেও তেমন সুখকর বা গর্বের নয়। ১৯৪৭ সালের এই দিনে আইনসভায় ভোটাভুটির মাধ্যমে বাংলা ভাগের সিদ্ধান্তে সিলমোহর পড়ে। ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া হল অবিভক্ত বাংলার মর্যাদা। কাঁটাতার গেঁথে আলাদা হয়ে গেল দুই প্রদেশ। আর উদ্বাস্তু হয়ে গেলেন দুই বাংলার অজস্র মানুষ। ফলে এই দিনটায় রাজ্য দিবস পালন করা মানে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানো ছাড়া আর কী! বাংলার শাসকদলের দাবি, বিজেপি সরকার ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল মিলে বাংলার সেই কাঁটা ঘায়েই নুনের ছিটে দেওয়ার চেষ্টা করছে। যার প্রতিবাদে গোড়া থেকেই আওয়াজ চড়িয়েছে শাসকদল তৃণমূল। এ ব্যাপারে রাজ্যের বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদদের সমর্থন গিয়েছে মুখ্য়মন্ত্রীর দিকেই। এ নিয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছতেই ডাকা হয়েছিল সর্বদল বৈঠক। যেখানে মোটামুটি ১ বৈশাখ দিনটিকেই পছন্দ করেছিলেন বিশিষ্ট মানুষেরা।
বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবের পক্ষে গিয়েছে মোট ১৬৭টি ভোট। বিপক্ষে পড়েছে মোট ৬২টি ভোট। ফলে কার্যত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এদিন বিধানসভায় পাশ হয়ে গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর আনা প্রস্তাব। এদিন বিধানসভায় গোড়া থেকেই বিরোধিতার মেজাজে ছিলেন বিরোধিরা। শুভেন্দু অধিকারী-সহ বেশ কয়েকজন বিধায়ক আজ পিঠে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি আঁকা টি-শার্ট পরে বিধানসভায় আসেন। যার সামনে লেখা ছিল, ২০ জুন,বিধানসভা দিবস। অধিবেশনের শুরু থেকেই আরম্ভ হয় তরজা।
এদিকে, এদিনের পাশ হওয়া প্রস্তাবে সই করতে রাজি হননি রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। আর সে বিষয়টি নিয়েই ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বহুদিন ধরেই রাজ্য-রাজ্যপাল তরজা দেখে আসছে বঙ্গবাসী। এদিনও বিধানসভায় রাজ্য়পালকে বিঁধতে ছাড়লেন না মুখ্যমন্ত্রী। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, রাজ্যপাল সই না করলে কিছু এসে যায় না। কারণ সব কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায় না। বরং মানুষ মন থেকে যা চায়, তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এদিন মমতার সাফ হুঁশিয়ারি, "দেখব জনগণ না মনোনীত ব্যক্তি, কার শক্তি বেশি।" পাশাপাশি ২০ জুন দিনটির কথা তুলে মুখ্যমন্ত্রী জানান, ১৯৪৭ সালের ২০ জুন আদতেই পশ্চিমবঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কারণ সে সময় বাংলা ছিল অবিভিক্ত। ১ বৈশাখ দিনটিকে পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিলেবে বেছে নেওয়ার স্বপক্ষেও একগুচ্ছ যুক্তি দিয়েছেন তিনি।
বাংলা বছরের শুরু হয় ওই তারিখটি থেকেই। বাংলা নববর্ষের সূচনা। বাঙালিদের কাছে ওই দিনটির আবেগ, তাৎপর্য তাই একেবারেই অন্যরকম। অনেকেই ওই দিনটিতে শুভ কাজে হাত দিতে পছন্দ করেন। ফলে সেই দিনটির চেয়ে ভালো দিন আর কী-ই বা হতে পারত পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসেবে। সেইসব অঙ্ক কষেই বুদ্ধিজীবীরা এই দিনটিতেই রাজ্যদিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রসঙ্গীতের শব্দ বদলাতে চান মমতা! কী যুক্তি তাঁর?
একই সঙ্গে বিধানসভায় রাজ্য সঙ্গীতের ব্যাপারটি নিয়েও প্রস্তাব পেশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সর্বমত অনুসারে রবিঠাকুর রচিত 'বাংলার মাটি বাংলার জল' গানটিকেই রাজ্য সঙ্গীতের মর্যাদা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেখানে। দেশের বহু রাজ্যেই রাজ্যসঙ্গীত রয়েছে। গুজরাট, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র থেকে শুরু করে অসম, বিহার, ওড়িশা, তামিলনাড়ুর মতো বহু রাজ্যেরই রয়েছে নিজস্ব সঙ্গীত। যা রাজ্যের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ম করে গাওয়া হয়। সব মিলিয়ে মোট ১২টি রাজ্যের নিজস্ব রাজ্যসঙ্গীত রয়েছে। গোয়া, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানার মতো বহু রাজ্য ইতিমধ্যেই আবেদন করে রেখেছে নিজস্ব সঙ্গীতের জন্য। তবে এতদিন তার বালাই ছিল না এ বাংলায়। অবশেষে নিজস্ব রাজ্যসঙ্গীত পেল পশ্চিমবঙ্গ। যদিও সর্বদল বৈঠকে এই গানটির মধ্যে থেকে কয়েকটি শব্দ পরিবর্তনের প্রস্তাব এনেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে অনেকেই সেই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। আজ রাজ্যসঙ্গীত চূড়ান্ত হলেও গানের শব্দ পরিবর্তন হচ্ছে কিনা সে বিষয়টি স্পষ্ট হয়নি।
রাজ্যপালের সই ছাড়াই ভোটাভুটির জোরে প্রস্তাব তো গৃহীত হল বিধানসভায়। কিন্তু রাজ্য়পালের সম্মতি ছাড়া আদৌ কার্যকর করা যাবে তো এই সিদ্ধান্ত। এমন বহু প্রশ্নই ঘুরছে হাওয়ায়। সে প্রসঙ্গে মুখ্য়মন্ত্রী এদিন জানান, এই প্রস্তাব আদৌ রাজ্যপাল পর্যন্ত পৌঁছবেই না। কারণ এই প্রস্তাব রেজোলিউশন মাত্র। কোনও বিল নয় যে রাজ্যপালের সম্মতি দিয়ে পাশ করাতে হবে।
এতদিন ১ বৈশাখ মানে বাঙালির কাছে ছিল নববর্ষ, হালখাতা, নতুন জামাকাপড়, খাওয়াদাওয়া। তবে এবার তার সঙ্গেই দিনটির সঙ্গে যোগ হয়ে গেল আরও একটি বিশেষ তাৎপর্য। আগামী বছর থেকেই ওই দিনটিকে গোটা রাজ্য পালন করবে একেবারে নিজস্ব দিন হিসেবে। গলা মেলাবে রাজ্যসঙ্গীত 'বাংলার মাটি বাংলার জল'-এর সুরে।