রবীন্দ্রসঙ্গীতের শব্দ বদলাতে চান মমতা! কী যুক্তি তাঁর?

West Bengal Day: ভারতের অধিকাংশ রাজ্যেরই রয়েছে রাজ্যদিবস। অনেকেরই রয়েছে রাজ্যসঙ্গীতও। তবে এতদিন পর্যন্ত তেমন কিছু ছিল না পশ্চিমবঙ্গের।

রবীন্দ্রনাথের গানের উপর বিশ্বভারতীর কপিরাইট উঠেছে বছর কুড়ি হল। তাই বলে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে বাঙালির স্পর্শকাতর মন যে একেবারে বদলে গিয়েছে, তা ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। আজও রবীন্দ্রসঙ্গীতে একটুআধটু কালোয়াতি ঢুকে গেলে রে রে করে ওঠেন বিশুদ্ধবাদীরা। একটা সময় গিটার বাজিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়াকে রীতিমতো 'অপরাধ' হিসেবে দেখতেন কেউ কেউ। সেই গোঁড়ামির লাল চোখ কাটলেও এখনও  যে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে একটা আবেগের জায়গা রয়েই গিয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। সেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপরেই এবার কলম চালাতে চান বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক।

আরও পড়ুন: জাতীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের ‘রাজ্যসঙ্গীত’ থাকা কতটা জরুরি?

তবে এই বিতর্কের গোড়ায় আদতে রয়েছে অন্য একটি বিতর্ক। দেশের প্রায় সব রাজ্যেরই আলাদা আলাদা রাজ্যদিবস রয়েছে। তবে বাংলা এতদিন যাবৎ সে রসে বঞ্চিত! এবার সেই বিষয়টি নিয়েই সরব হয়েছেন রাজ্যের একটি মহল। এরই মধ্যে আবার ২০ জুন রাজভবনের তরফে পালন করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ দিবস। আর সেই ব্যাপারটিকে ভালো চোখে দেখেননি ইতিহাসবিদ, বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশই। তাতে সায় নেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও।

১৯৪৭ সালে ওই দিনটিতে আইনসভায় ভোটাভুটির মাধ্যমে সিলমোহর পড়েছিল বাংলা ভাগের সিদ্ধান্তে। অবিভক্ত বাংলার বুকে গেঁথে দেওয়া হল কাঁটাতার। সম্ভবত কোনও বাঙালির কাছেই এই দিনটি গৌরবের নয়, বরং লজ্জার। বাংলার শাসকদলের অভিযোগ, বিজেপি সরকার ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল মিলে বাংলার সেই কাটা ঘায়েই নুনের ছিটে দেওয়ার চেষ্টা করছে। স্বাভাবিক ভাবেই সে নিয়ে গর্জে উঠেছে তৃণমূল। আর এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীকে সমর্থন করেছেন বুদ্ধিজীবীদের একাংশও।

এ নিয়ে সর্বসম্মত একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে নবান্নে সর্বদল বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। যেখানে উপস্থিত ছিলেন, ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। ডাকা হয় বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিদেরও। যদিও সেখানে গড়হাজির ছিল সিপিএম, কংগ্রেস ও বিজেপি। অবশ্য সভায় যোগ দেন এসইউসি এবং সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-র প্রতিনিধি।

ভারতের অধিকাংশ রাজ্যেরই রয়েছে রাজ্যদিবস। অনেকেরই রয়েছে রাজ্যসঙ্গীতও। তবে এতদিন পর্যন্ত তেমন কিছু ছিল না পশ্চিমবঙ্গের। এদিনের সভায় তার প্রয়োজন নিয়েও সওয়াল করেন ইতিহাসবিদ সুগত বসু। রাজ্যসঙ্গীতের পক্ষে এর আগে সওয়াল করেছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেও। কোন গান হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যসঙ্গীত, তা নিয়ে জল্পনাও কিছু কম হয়নি। রাজ্যের নাম পরিবর্তন নিয়েও দাবি রয়েছে দীর্ঘদিনের। এদিনের সভাতে উঠে আসে সেই প্রসঙ্গও। পশ্চিমবাংলার পরিবর্তে রাজ্যের নাম 'বাংলা' রাখার পক্ষে অনেকেই। ক্ষমতায় আসার পর পরই মুখ্যমন্ত্রী খোদ সওয়াল করেছিলেন তার পক্ষে। এতে বর্ণানুক্রমিক তালিকাতেও উপরের দিকে উঠে আসবে রাজ্য। কারণ ওয়েস্ট বেঙ্গল শব্দটি শুরু ইংরেজি ডব্লিউ বর্ণটি দিয়ে। যা বর্ণক্রমে থাকে বেশ পিছনে। এর ফলে সর্বত্রই বাংলা পিছিয়ে থাকে, যা পরিবর্তনের দাবি দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে একটি পক্ষ। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশ নামে একটি দেশ যেখানে বর্তমান, সেখানে 'বাংলা' নামটি পশ্চিমবঙ্গের জন্য যথাযথ নয়। তবে এমন দাবি অমূলক বলেই মনে করছেন বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ। বাংলাদেশ রয়েছে বলেই পশ্চিমবঙ্গের নাম 'বাংলা' হলে সমস্যা হবে, এমনটা মনে করছেন না তাঁরা।

এদিনের বৈঠকে রাজ্য দিবস হিসেবে বেশ কয়েকটি দিনের কথা প্রস্তাব করা হয়। তবে সর্বমত গিয়েছে পয়লা বৈশাখের পক্ষেই। তবে এই দিনটিই পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসেবে গৃহীত হবে কিনা তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে বিধানসভায়। তবে রাজ্যসঙ্গীত নিয়ে দ্বিধা কাটল না এক বৈঠকে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যসঙ্গীত হিসেবে সভা থেকে উঠে এসেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'বাংলার মাটি বাংলার জল' গানটির প্রস্তাব। এ ব্যাপারে মোটামুটি সকলে একমতও হয়েছিলেন। সেই মতো সভায় গাওয়াও হল সেই গান। কিন্তু এর মধ্যেই এমন একটি প্রস্তাব তুললেন মুখ্যমন্ত্রী, তা নিয়ে বেঁধে গেল দ্বন্দ্ব।

'বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন-- এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান'- রবিঠাকুরের লেখা এই পঙক্তির যে নির্যাস, তা এই মুহূর্তে পশ্চিমবাংলার প্রতিটি কোণায় কোণায় পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন বলেই মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে তাকে শুধু বাঙালির মধ্যে বেঁধে ফেলতে নারাজ তিনি। তাই তিনি প্রস্তাব তোলেন, রবীন্দ্রনাথ লিখিত গানটির 'বাঙালি' শব্দটি সামান্য বদলে 'বাংলা' করে দেওয়া হোক রাজ্যসঙ্গীতের ক্ষেত্রে। তাতে রাজ্যের অখণ্ডতা বজায় রাখতে সুবিধা হবে বলেই মনে করেন তিনি। তাতে সব ধরনের, সব ভাষার, সব মতাদর্শের মানুষকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা যাবে বলেই জানান তিনি। আর তাতেই আপত্তি জানায় সভায় উপস্থিত একটি পক্ষ। যদিও অপর পক্ষ সমর্থন করেছেন দিদিকেই। তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ এই প্রেক্ষিতে তুলে ধরেন অতীতের একটি ঘটনা। তিনি জানান, কে এল সায়গলের গাওয়া একটি ছবিতে সামান্য বদল করা হয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের শব্দে। যা জানতে পেরে রবীন্দ্রনাথ নাকি তাঁকে সমর্থনই করেছিলেন।"

তবে এত যুক্তিতর্কের পরেও সভায় উপস্থিত অনেকেই রবীন্দ্রগানের শব্দ পরিবর্তনকে মুক্তমনে গ্রহণ করতে পারেননি। বিতর্ক হতে পারে এমন যুক্তি দিয়ে নিজেদেক মতানৈক্য জানিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত 'ধনধান্যে পুষ্পে ভরা' গানটির কথা প্রস্তাব করেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে এ গানের মূল বক্তব্য দেশকে আশ্রয় করে, এমন যুক্তি দিয়েই গোড়াতেই বাতিল হয়ে যায় সেই প্রস্তাব। আপাতত রবীন্দ্রনাথের গানে শব্দ পরিবর্তন উচিত কি নয়, বিতর্ক এসে ঠেকেছে সেই প্রশ্নের গোড়াতেই। এ নিয়ে আরও একটি সর্বদলের দাবি জানিয়েছেন সভার কেউ কেউ।

আরও পড়ুন: ‘জয় বাংলা’-ই অস্ত্র! স্কুলে বাংলা বাধ্যতামূলক করে কতটা এগিয়ে রইলেন মমতা?

২০০১ সালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপর থেকে উঠে গিয়েছে বিশ্বভারতীর কপিরাইট। সেই বাঁধা কাটিয়ে জনগণের হয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। আজকের দিনে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে নানা পরীক্ষানিরিক্ষা চলছে। বদলাচ্ছে লয়, বদলাচ্ছে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারও। সিনেমা. চলচ্চিত্র থেকে রাস্তার সিগন্যালে যথেচ্ছচার ব্যবহার হচ্ছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের। বিকৃত না করে সব ধরনের পরীক্ষানিরিক্ষাতেই একপ্রকার সায় দিয়েছে বিশেষজ্ঞমহল। তাই বলে রবীন্দ্রনাথের কলমের উপর খোদগিরি, কতটা যথাযথ! উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, আদৌ তাঁর লেখা গানে নিজের শব্দ বসিয়ে দেওয়া যায় কি, এই বিতর্কেই আপাতত দ্বিধাবিভক্ত বাংলা। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক মঞ্চে মমতার লেখা তাঁর সুরারোপ করা অনেক গানই বাজতে শুনেছে বঙ্গবাসী। তবে কি এবার মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রনাথের গানও কিঞ্চিৎ অদলবদল-সহ শুনতে হবে রাজ্যবাসীকে?

More Articles