জাতীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের 'রাজ্যসঙ্গীত' থাকা কতটা জরুরি?

State Song of West Bengal: তবে কি খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই লিখবেন রাজ্যের সঙ্গীত?

সারা দেশ জাতীয় সঙ্গীতের সুরে নিজেদের এক দেশের এক নাগরিক বলে গর্ব করে। সিনেমা শুরুর আগে দাঁড়াতে হওয়াতে বিরক্তি কিছুকাল থাকলেও, দিন বিশেষে জাতীয় সঙ্গীতই তো দেশের পরিচয়। দেশ তো নানা ভাষা, নানা ধর্ম, নানা বস্ত্রের! অখণ্ড ভারতের মধ্যে খণ্ড খণ্ড বৈচিত্র্য। এই খণ্ড খণ্ড বৈচিত্র্যের স্বতন্ত্র পরিচয় আছে। জাতীয় ফুল যেমন আছে, জাতীয় পশু বা পাখি যেমন আছে, প্রতি রাজ্যের পৃথক ফুল বা পাখিও তো আছেই। তাহলে একখানা রাজ্য সঙ্গীত থাকলে অসুবিধা কী? তাই জাতীয় সঙ্গীতের আদলে এই রাজ্যের নিজস্ব সঙ্গীত তৈরি করার কথা জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। জন গণ মন যদি সারা দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, দেশের মানুষকে এক সুরে বেঁধে রাখার গান হয় তাহলে রাজ্যের মানুষের জন্য পৃথক একটি সঙ্গীত হতেই পারে। বিষয়টি নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বিতর্ক হচ্ছে, কিন্তু এখানে অবশ্যই মনে রাখা দরকার পশ্চিমবঙ্গে প্রথম রাজ্য সঙ্গীত হবে এমন নয়। ভারতের বহু বহু রাজ্যের নিজস্ব রাজ্যসঙ্গীত রয়েছে।

বাংলায় সমস্ত স্কুলে বাংলা পড়াতেই হবে ঘোষণা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলার আবেগকে তিনি মর্যাদা দেন। বাঙালির জাত্যাভিমানকে বাঁচাতে বাংলা বাধ্যতামূলকের মাস্টারস্ট্রোকটিকে রাজনৈতিকভাবেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। সারা দেশে হিন্দিভাষাকে জোর করে চাপানোর বিরুদ্ধে যে ধারাবাহিক আন্দোলন করে চলেছে বিজেপি বিরোধীরা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের রাজ্যে নিজেদের ভাষাকে এই স্থান দিয়ে সেই সব আন্দোলনে নতুন দিশা জুড়েছেন বলেও মনে করছেন অনেকে। সেই পথেই একে একে আসছে রাজ্য সঙ্গীত, আসছে পশ্চিমবঙ্গ দিবস! বাঙালির আবেগকে সব দিক থেকেই ধরতে চাইছেন মমতা। তাই পশ্চিমবঙ্গ দিবস নির্ধারণ কমিটি পয়লা বৈশাখ দিনটিকে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ হিসেবে অনুমোদন করার সুপারিশ করেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি পয়লা বৈশাখ দিনটিকে সারা রাজ্য জুড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশেষ করে তুলতে চান তাহলে, আগামী বছর থেকেই রাজ্যে পালিত হবে 'পশ্চিমবঙ্গ দিবস'।

আরও পড়ুন- উপাচার্য কে হবেন, সেই নিয়েও রাজনীতি! রাজ্যপাল-সরকারের দ্বন্দ্বে গোল্লায় যাচ্ছে উচ্চশিক্ষা

রাজ্যের একটি নিজস্ব সঙ্গীতের ভাবনাটিও এই আবেগের ফসলই। কিন্তু সারা রাজ্যের প্রাণ হয়ে উঠবে এমন গান লিখবেন কে? 'রাজ্য সঙ্গীত' বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কমিটি গঠন করা হবে একথা সত্য। তবে কি খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই লিখবেন রাজ্যের সঙ্গীত? দেশের বহুরাজ্যেরই নিজস্ব সঙ্গীত আছে। অন্ধ্রপ্রদেশ, অসম, বিহার, ছত্তিশগড়, গুজরাত, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মণিপুর, ওড়িশা, পুদুচেরি, তামিলনাড়ু ও উত্তরাখণ্ডের মতো রাজ্যগুলিতে নিজস্ব রাজ্য সঙ্গীত রয়েছে।

২০২০ সালে ওড়িশার রাজ্য সঙ্গীত হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে ‘বন্দে উৎকল জননী’ গানটি। ২০১২ সালে বিহারের রাজ্য সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয় ‘মেরে ভারত কে কণ্ঠহার’। বিশ্ববিখ্যাত বাঁশিবাদক হরি প্রসাদ চৌরাসিয়া এবং সন্তুর বাদক শিবকুমার শর্মা এই গানটির সুর বাঁধেন। ‘ও মুর আপুনার দেশ’ অসমের রাজ্য সঙ্গীত। অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্য সঙ্গীত 'মা তেলুগু থাল্লিকি'। ছত্তিশগড়ের রাজ্যসঙ্গীত 'অর্পা পাইরি কে ধর’। গুজরাতের মানুষ রাজ্য সঙ্গীত হিসেবে গান 'জয় জয় গারভি গুজরাত’। কর্ণাটকে 'জয় ভারত জননীয়া তনুজাতে, জয় হে কর্ণাটক মাতে', মধ্যপ্রদেশে 'মেরা মধ্যপ্রদেশ’, মহারাষ্ট্রে 'জয় জয় মহারাষ্ট্র মাজা’ গাওয়া হয় রাজ্য সঙ্গীত হিসেবে। উল্লেখ্য, মহারাষ্ট্রে সাম্প্রতিক উদ্ধব ঠাকরে ও শিন্ডে শিবিরের বিভাজনের পরেই রাজ্যসঙ্গীতের বিষয়টি ঘোষণা হয়। একনাথ শিন্ডের নেতৃত্বাধীন মহারাষ্ট্র মন্ত্রিসভা জয় জয় মহারাষ্ট্র মাজাকে রাজ্যসঙ্গীত হিসাবে মনোনীত করে। চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি, ছত্রপতি শিবাজির জন্মবার্ষিকী থেকে সমস্ত সরকারি অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে এই গানটিও বাজানো হতে থাকে। ১৯৬০ সালে রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এই প্রথম রাজ্যসঙ্গীত পেয়েছে মহারাষ্ট্র। শুধু সরকারি অনুষ্ঠানে নয়, প্রতিদিনের প্রার্থনায় জাতীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি সমস্ত স্কুলে রাজ্যসঙ্গীত গাওয়া হয় সেখানে।

আরও পড়ুন- ‘জয় বাংলা’-ই অস্ত্র! স্কুলে বাংলা বাধ্যতামূলক করে কতটা এগিয়ে রইলেন মমতা?

পুদুচেরিতে আর তামিলনাড়ুতে 'তামিল থাই ভালথু', উত্তরাখণ্ডে 'উত্তরাখণ্ড দেবভূমি মাতৃভূমি’ রাজ্যসঙ্গীত রয়েছে। জাতি হিংসায় জর্জরিত মণিপুরেরও রয়েছে নিজস্ব সঙ্গীত, 'সানা লেইবাক মণিপুর' অর্থাৎ সোনার ভূমি মণিপুর। পশ্চিমবঙ্গের এই রাজ্যসঙ্গীতও কি স্কুলে প্রার্থনা সঙ্গীতে বাধ্যতামূলক হবে? প্রচলিত কোনও গানই কি রাজ্যের গান হয়ে উঠবে, নাকি বাঙালির অস্তিত্ব ও ঐতিহ্যকে নিয়ে পৃথক গান রচিত হবে, সুরই বা দেবেন কে? এক বছরের মধ্যে এটুকু রাজ্য জেনেই যাবে নিশ্চিত।

More Articles