Climate Change: বিকল স্বাস্থ্য, ভয়ঙ্কর রোগের মুখে দেশ! যে আশঙ্কার কথা শোনাল ল্যান্সেটের রিপোর্ট

Lancet Report on Climate Change: ল্যান্সেটের ২০২৪ সালের রিপোর্ট জানিয়েছে আরও ঝুঁকির কথা। অধিকাংশ দেশেই নাকি মানুষের স্বাস্থ্যের উপর বড়সড় প্রভাব ফেলেছে এই জলবায়ু পরিবর্তন। তার মধ্যে তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ভারত।

গত কয়েক দশক ধরেই পরিবেশবিদদের অন্যতম মাথাব্যথার বিষয় জলবায়ু পরিবর্তন। যত দিন যাচ্ছে, পৃথিবীর বুকে বাড়ছে দূষণ। ভয়াবহ বিশ্ব উষ্ণায়ণের প্রভাব পড়ছে গোটা দুনিয়া জুড়ে। গত কয়েক দশকের সব চেয়ে উষ্ণতম বছর ছিল ২০২৩ সাল। যে সব দেশে কস্মিনকালেও তেমন গরম পড়ত না, সেখানেও হানা দিচ্ছে তাপপ্রবাহ। গলে যাচ্ছে হিমবাহ, বাড়ছে সমুদ্রের জলস্তর। সব মিলিয়ে প্রলয়ের খুব সামনে দাঁড়িয়ে আমরা। আর এ সমস্ত কিছুর প্রভাবই পড়ছে আমাদের উপর। খরা থেকে বন্যা, অতিরিক্ত ঘূর্ণিঝড় সব অঘটনের নেপথ্যেই কিন্তু রয়েছে এই জলবায়ু-দুর্বিপাক। শুধু কি তাই, ল্যান্সেটের ২০২৪ সালের রিপোর্ট জানিয়েছে আরও ঝুঁকির কথা। অধিকাংশ দেশেই নাকি মানুষের স্বাস্থ্যের উপর বড়সড় প্রভাব ফেলেছে এই জলবায়ু পরিবর্তন। তার মধ্যে তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ভারত।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর 'কাউন্টডাউন অন হেলথ অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ' শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় 'দ্য ল্যান্সেট'-এ। সেখানে জানানো হয়েছে, পনোরোটির মধ্যে অন্তত দশটি সূচকই স্বাস্থ্যের হুমকির দিকে দিকনির্দেশ করছে। যা কার্যত এতদিনে রেকর্ড। সেই প্রতিবেদনে এ-ও সতর্ক করা হয়েছে, ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি সত্ত্বেও তাপমাত্রা কিন্তু নিয়ন্ত্রিত সীমার মধ্যে রাখা যায়নি। যার ফলে ক্রমশ ঝুঁকি বাড়ছে স্বাস্থ্যের। আজারবাইজানের বাকুতে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের ২৯তম কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস বা COP29 সম্মেলনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর ডিরেক্টর জেনারেল টেড্রোস আধানম ঘেব্রেইসাস জানান, ক্রমশ স্বাস্থ্যসঙ্কটকেই জটিল করে তুলছে এই জলবায়ু সঙ্কট। নীলগ্রহ ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে চলেছে। যার ফলে জলবায়ু সংক্রান্ত বিপর্যয়ের তীব্রতা দিনে দিতে বাড়ছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াচ্ছে, পৃথিবীর কোনও অংশই এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা পাবে না। কার্যত মানুষের পালিয়ে বাঁচার কোনও জায়গা থাকবে না গোটা দুনিয়ায়।

আরও পড়ুন: Climate Change: আগামী দিনে খেয়ে-পরে বাঁচবে তো মানুষ? যে আশঙ্কার কথা জানালেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা

রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব অ্যান্টেনিও গুতারেস জানান, রেকর্ড পরিমাণ উচ্চ-নির্গমন ক্রমশ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। আর তা ইতিমধ্যেই রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছে। দিনে দিনে পৃথিবী যেভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে সেই প্রবণতা না কমাতে পারলে, বিপদ থেকে বাঁচার কোনও রাস্তা নেই। জলবায়ু পরিবর্তনকে রুখে দিতে না পারলে ক্রমশ অসুস্থ থেকে অসুস্থতর হয়ে পড়বে মানুষ। আর এই চরম পরিস্থিতি থেকে বাঁচার কোনও দ্বিতীয় উপায় নেই।

ল্যান্সেটের ওই প্রতিবেদনে এ-ও জানানো হয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ভয়ঙ্কর তাপজনীত স্বাস্থ্যসঙ্কটের মুখে পড়েছে মানুষ। ২০২৩ সালে তা রেকর্ড ছুঁয়েছে। ২০২৩ সালে অন্তত ৩১টি দেশ প্রত্যাশার তুলনায় অন্তত একশো দিন এমন তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হয়েছে, যা স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যান্ত দুশ্চিন্তার। রিপোর্ট বলছে, ১৯৮৬ সাল থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে ভয়ঙ্কর গরমের কারণে অন্তত ৬ শতাংশ বেশি অনিদ্রায় ভুগেছেন মানুষ। যার প্রভাব পড়েছে তাঁর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপরে।

২০২২ সাল পর্যন্ত হিসেব অনুযায়ী, ১২৪টি দেশের অন্তত ১৫১ মিলিয়ব মানুষ তাপপ্রবাহ, খরার মতো চরম আবহাওয়া পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। যার ফলে শুকিয়ে গিয়েছে শস্যখেত। ঠিক মতো ফসল ফলানো সম্ভব হয়নি। অনাবৃষ্টিতে সময়ের আগেই নষ্ট হয়েছে ফসল, উজার হয়েছে খেত কে খেত। যার প্রভাব পড়েছে মানুষের খাদ্যপ্রবাহে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। গুরুতর খাদ্যঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে গোটা মানবজাতি।

তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়ার মতো একাধিক ভাইরাসজনীত ব্যধি। যা যেমন সংক্রমক তেমনই প্রাণঘাতীও। এই ব্যাপক রোগের সঞ্চারের কারণ হিসেবে অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও শুষ্ক গরম আবহাওয়াকেই দুষছেন আবহবিদেরা। এই আবহাওয়ার কারণে বেড়েছে ধুলিঝড়ের পরিমাণ। ২০০৩-২০০৭ সালের তুলনায় ২০১৮-২০২২ সালের মধ্যে ৪৮ শতাংশ দেশে বিপজ্জনক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে এই ঝুলিঝড়। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সরকার ও সংস্থাগুলির দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বালানি গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনকে ভয়াবহ পরিমাণে বাড়িয়ে দিয়েছে। কার্যত যা মানুষকে ক্রমশ বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে, পাল্লা দিয়ে কমছে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।

সম্প্রতি আমেরিকায় ভোটে জিতেছেন ট্রাম্প। কয়েকদিনের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট পদে শপথও নিতে চলেছেন। প্রচারপর্ব থেকে নির্বাচনী ইস্তেহারে যে একাধিক সংস্কারের কথা বলেছেন ট্রাম্প, তার মধ্যে রয়েছে প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার কথা। পাশাপাশি জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে আগের সরকারের বিধিনিষেধ থেকে বেরিয়ে আসতে চান ট্রাম্পের আমেরিকা। একের পর এক দেশের জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে এই অবহেলার মেজাজই কি ক্রমশ পৃথিবীকে ঠেলে দিচ্ছে না প্রলয়ের দিকে? রিপোর্ট বলছে, জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি ও বিনিয়োগের পিছনে কোটি কোটি অর্থ খরচ করছে বিভিন্ন দেশ যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলছে। সকলে সব জানা সত্ত্বেও পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি বাড়ানো বা জনগণের স্বাস্থ্য বা জীবিকাকে উপকৃত করে এমন কোনও পদক্ষেপের দিকে এগোচ্ছে না শক্তিশালী দেশগুলি। যা সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের।

আরও পড়ুন: Climate Change: বদলাচ্ছে পৃথিবীর আকৃতি, যে ভয়াবহ বিপদের মুখে আমরা

একই সঙ্গে ল্যান্সেটের রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়েছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির মতো ভারতেও রেকর্ড ব্রেকিং তাপপ্রবাহ ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলেছে দেশবাসীর স্বাস্থ্যে। ২০২৩ সালে দেশের প্রায় প্রতিটি ব্যক্তি প্রতি বছর প্রায় ২৪০০ ঘণ্টা বেশি তাপের সামনে উন্মোচিত থেকেছে। এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে উপকূলীয় এলাকা ও সমুদ্রপৃষ্ঠেও। যার জন্য আগামী দিনে বিপদ বাড়তে চলেছে সুন্দরব, মুম্বই, তামিলনাড়ু, পুদুচেরি,কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, ওড়িশা ও গুজরাটের মতো উপকূলীয় রাজ্যের বিস্তৃত অংশ। ভয়ঙ্কর উষ্ণায়নের কারণে ক্রমশ বাড়ছে জলস্তর। তার সঙ্গে সমুদ্রের জল উত্তপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণে বিপদে পড়ছে বহু সামুদ্রিক প্রাণী।

রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে শিশু ও বয়স্করা। শুধু স্বাস্থ্য বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতিরও সম্মুখীন হচ্ছে ভারত। জানা গিয়েছে, ২০২৩ সালে অতিরিক্ত গরমের কারণে অন্তত ১৮১ বিলিয়ন সম্ভাব্য শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। মানুষের শ্রমের শক্তিও কমেছে পাল্লা দিয়ে। যার ফলে আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১৪২ ডলারের কাছে। এখনও সাবধান না হতে পারলে যে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভয়াবহ প্রলয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে গোটা পৃথিবী, সে কথাই ফের একবার মনে করিয়ে দিয়েছে ল্যান্সেটের এই সাম্প্রতিক রিপোর্ট।

More Articles