স্বপ্নে রেওয়াজ করে পাখিরা! জানেন, ঘুমিয়ে কী কী স্বপ্ন দেখে প্রাণীরা?
Dreams of Animals: কীভাবে ঘুমন্ত প্রাণীদের মনের মধ্যে ঢোকা যায় সেই কাজটি ১৯৬০-এর দশকে শুরু হয়।
সব প্রাণীই ঘুমোয়, তা সে জলচর হোক, পাখি হোক, ডাঙায় বাস করা পশু হোক! কিন্তু মানুষ বাদে এই যে বিপুল প্রজাতির ব্যাপক সংখ্যক প্রাণী, তারা কি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে? অ্যারিস্টটল তাঁর 'দ্য হিস্ট্রি অব অ্যানিম্যালস’-এ লিখেছেন, "এটা মনে হতে পারে যে শুধু মানুষই স্বপ্ন দেখে! নাহ, আসলে ঘোড়া, কুকুর, বলদ, ভেড়া, ছাগল এবং সব চতুষ্পদী প্রাণীই স্বপ্ন দেখে এবং কুকুর ঘুমের মধ্যে ঘেউ ঘেউ করে উঠছে মানে সে স্বপ্ন দেখছে।" তাঁর গবেষণা পদ্ধতি হয়তো পরিশীলিত ছিল না ততখানি, কিন্তু অ্যারিস্টটল খুব একটা ভুলও বলেননি। তা, প্রাণীরা কীসের স্বপ্ন দেখে? মানুষ যেমন জটিলতম গভীরতায় ঢুকে পড়ে ঘুমের মধ্যে, প্রাণীরাও কি তাই?
প্রাণীরা কী স্বপ্ন দেখে তা বলা মুশকিল কিন্তু তারা যে স্বপ্ন দেখে তা তো সহজেই বোঝা যায়। আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব এই কাজটি বুঝতে চেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, দু'টি পদ্ধতিতে। এক, ঘুমের চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রাণীদের শারীরিক আচরণের দিকে নজর দেওয়া। দুই, প্রাণীদের ঘুমন্ত মস্তিষ্ক আমাদের ঘুমন্ত মস্তিষ্কের মতো একইভাবে কাজ করে কিনা তা খতিয়ে দেখা।
কীভাবে ঘুমন্ত প্রাণীদের মনের মধ্যে ঢোকা যায় সেই কাজটি ১৯৬০-এর দশকে শুরু হয়। সেই সময়েই বিভিন্ন মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হতে থাকে যে, মানুষজন কীভাবে স্বপ্নে চলাফেরা করে। বিষয়টা খুবই কৌতূহলের কারণ REM-এর (rapid eye movement) সময়, আমাদের পেশি সাধারণত অসাড় থাকে।
আরও পড়ুন- বাঁদরেরই জাত ভাই! তবে কেন মানুষের মতো বুদ্ধি ধরে না অন্য কোনও প্রাণীই?
গবেষকরা বুঝতে পেরেছিলেন, প্রাণীদের মধ্যেও এরকম একটি অবস্থা তৈরি করতে পারলে তারা কীভাবে স্বপ্ন দেখে তা বোঝা গেলেও যেতে পারে। ১৯৬৫ সালে, ফরাসি বিজ্ঞানী মিশেল জুভেট এবং জে এফ ডেলরমে দেখতে পান, বিড়ালের মস্তিষ্ক থেকে ব্রেনস্টেমের একটি অংশ, যাকে পন বলা হয়, সরিয়ে নিলে REM অবস্থায় থাকাকালীনও দেহ অসাড় হচ্ছে না। গবেষকরা এই অবস্থাটিকে REM without atonia বা REM-A বলে অভিহিত করেন। এই অবস্থায় শুয়ে থাকার পরিবর্তে বিড়ালরা চারপাশে হেঁটে বেরিয়েছিল এবং আক্রমণাত্মক আচরণও করেছিল।
এতে স্পষ্ট হয়, জেগে থাকার সময় তারা যা যা করে, সেসবেরই স্বপ্ন দেখছে বিড়ালরা। কিছু বিড়াল ঘুমের মধ্যে শিকার ধরার সময়ের আক্রমণের মতো আচরণ করে, যেন তারা স্বপ্নে ইঁদুর তাড়া করছে। কুকুরের ক্ষেত্রেও একই রকম স্বপ্ন দেখা গেছে। কিছু কিছু মানুষকেও স্বপ্নের মধ্যে কাজ করার ভঙ্গি করতে দেখা গেছে। তারা সাধারণত REM স্লিপ বিহেভিয়ার ডিসঅর্ডার নামক একটি রোগে ভোগেন। ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব স্লিপ ডিসঅর্ডারস (ICSD) অনুযায়ী, "ঘুষি মারা, লাথি মারা, লাফানো এবং বিছানা থেকে দৌড়ানোর মতো আচরণ করে থাকেন এই ব্যক্তিরা। এই মানুষদের সঙ্গে যারা ঘুমোয় তারা হামেশাই আহতও হন।
যদিও শারীরিক কার্যকলাপই স্বপ্ন বোঝার চেষ্টার একমাত্র উপায় নয়। গবেষকরা এখন ঘুমনোর সময় প্রাণীদের মস্তিষ্কের কোষগুলির বৈদ্যুতিক এবং রাসায়নিক কার্যকলাপও দেখতে পারেন। ২০০৭ সালে, এমআইটি বিজ্ঞানী কেনওয়ে লুইস এবং ম্যাথিউ উইলসন হিপ্পোক্যাম্পাস নামে ইঁদুরের মস্তিষ্কের একটি অংশে নিউরনের কার্যকলাপ রেকর্ড করেন, যা স্মৃতির গঠন এবং এনকোডিংয়ের সঙ্গে জড়িত। যখন ইঁদুরগুলি দৌড়চ্ছিল তখন প্রথম তাদের মস্তিষ্কের কোশগুলির কার্যকলাপ রেকর্ড করেন বিজ্ঞানীরা। তারপরে ঘুমনোর সময়ও একই নিউরনের কার্যকলাপ লক্ষ্য করা হয়। দৌড়ানোর সময় এবং REM চলাকালীন তাঁরা আবিষ্কার করেন, ইঁদুররা জেগে থাকা অবস্থায় যা করছিল, ঘুমের মধ্যেও একই।
আরও পড়ুন- মানুষ এক ছোবলেই ছবি! তবে কোন রহস্যে সাপের তীব্র বিষেও বেঁচে যায় বন্য প্রাণীরা?
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানীরা এক ধরনের পাখিদের মস্তিষ্কেও একই বিষয় আবিষ্কার করেন। এই পাখিরা গানের সুর মস্তিষ্কে নিয়ে জন্মায় না; তাদের গান গাইতে শিখতে হয়। যখন এই পাখিরা জেগে থাকে, তখন জেব্রা ফিঞ্চ নামক পাখিদের মস্তিষ্কের সামনের কিছু অংশের নিউরোন, যাকে বলা হয় রোবুটাস আর্কিস্ট্রিয়াটালিস, তা বিশেষ সুর গাওয়ার পরে কাজ করতে শুরু করে। গবেষকরা সেই নিউরোনের প্যাটার্নের উপর ভিত্তি করে কোন সুরটি গাওয়া হয়েছিল তা নির্ধারণ করতে পারেন। পরে, যখন পাখিরা ঘুমিয়ে পড়ে, তাদের মস্তিষ্কের সেই অংশের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ ফের লক্ষ্য করেন বিজ্ঞানীরা। নিউরোনগুলি এমনভাবেই কাজ করছিল যেন পাখিটি মিষ্টি গান গাইছে, যেন ঘুমের মধ্যে গানের রেওয়াজ করছে!
বিড়ালদের আচরণ কি সত্যিই স্বপ্ন বিশ্লেষণ করতে পারে! ইঁদুররা কি জানে তারা ঘুমের মধ্যে এসব করে? পাখিরাও কি বুঝতে পারে যে তারা স্বপ্নে রেওয়াজ করছে? ঘুম ভেঙে স্বপ্ন কি মনে থাকে তাদের? কঠিন সেই উত্তর খোঁজা! মানুষও অনেক সময় ঘুমের মধ্যে বুঝতে পারে না এটা স্বপ্ন কী না। তবে জেগে উঠলেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রাণীরা কি স্বপ্নের পৃথিবীকে বাস্তব থেকে আলাদা করতে পারে? স্বপ্নের এই বিচিত্র জগত এখনও রহস্যই, মানুষের ক্ষেত্রেও চলছে গবেষণা, প্রাণীদের তো বটেই!