সৌরজগতে ঢুকে এসেছে অচেনা ধূমকেতু, 'অ্যাটলাস' সম্পর্কে কী বলছেন বিজ্ঞানীরা?

ATLAS COMET : ৩আই/অ্যাটলাস যখন আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে, তখন তার যাত্রাপথ আমাদের মনে করিয়ে যাবে, আমরা একা নই। আকাশগঙ্গার কোনো এক কোণে এখন হয়তো অন্য তারারা জন্ম নিচ্ছে।

প্রথমে এসেছিল ‘ওউমুয়ামুয়া’, তারপর 'বোরিসভ' এবং এবার 'অ্যাটলাস'। না, আমি কোনও সিনেমার ট্রিলজির কথা বলছি না। বলছি আকাশের এক নতুন অতিথি সম্পর্কে, যার নাম ‘৩ আই' অথবা 'অ্যাটলাস’। কে এই ৩ আই/অ্যাটলাস? এটি একটি ধূমকেতু। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম এই ধূমকেতুটি আবিষ্কৃত হয়। বরফ, ধূলিকণা ও পাথরের সংমিশ্রণে তৈরি হয় ধূমকেতু। কিন্তু অন্য সব ধূমকেতুর থেকে অ্যাটলাস আলাদা, কারণ এই ধূমকেতুটি সৌরজগতের বাইরে থেকে এসেছে। এর গতিপথ (trajectory) বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ধূমকেতুটি হাইপারবোলিক ট্র্যাজেক্টরিতে চলছে। অর্থাৎ, এটি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে সৌরজগৎ থেকে বেরিয়ে যাবে, আর কখনও ফিরে আসবে না। সুতরাং অ্যাটলাস-এর সৌরজগতে সামান্য সময়ের অতিথি।

আরও পড়ুন-

এবার মহাকাশে বিশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন! যে অসাধ্য সাধনের চেষ্টা করছে চিন

এবার আসি ধূমকেতুটির নামকরণ প্রসঙ্গে। কেন এই ধূমকেতুটির নাম ‘৩আই/অ্যাটলাস' দেওয়া হল? '৩ আই' মানে তৃতীয় আন্তঃনাক্ষত্রিক (Interstellar) বস্তু। ১ আই/ ‘ওউমুয়ামুয়া’ ও ২ আই/ বোরিসভের পর এটিই তৃতীয়। আর, 'অ্যাটলাস' নামটি এসেছে যে টেলিস্কোপ এই ধূমকেতু প্রথম আবিষ্কার করেছিল, তার নাম থেকে। সেই টেলিস্কোপের নাম, Asteroid Terrestrial-impact Last Alert System (ATLAS)। হাওয়াই ও চিলির দুটি স্থানে বসানো এই ATLAS টেলিস্কোপ সিস্টেমটি মূলত ধ্বংসাত্মক গ্রহাণু শনাক্ত করার জন্য তৈরি। এটি আমাদের সৌরজগতে অনুপ্রবেশকারী যে-কোনও অজানা বস্তু শনাক্ত করতে সক্ষম। সেই নজরদারি করতে-করতেই ATLAS খুঁজে পেল এক ‘বিদেশি’ অতিথিকে।

৩আই/অ্যাটলাস ছুটে চলেছে প্রতি সেকেন্ডে ২৬ কিমিরও বেশি গতিতে, অর্থাৎ ঘণ্টায় প্রায় ৯৩,০০০ কিমি এর গতিবেগ! এই গতিতেই এটি সূর্যকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে মহাশূন্যে, চিরতরের জন্য। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধূমকেতুটি এমনভাবে ঢুকে পড়েছে সৌরজগতে, যেন কোনও অচনা রাস্তায় হঠাৎ কেউ ভুল করে ঢুকে পড়েছে। এর উত্‍স হয়তো কোনো দূরবর্তী তারা, যেখান থেকে এটি সৃষ্টির সময় ছিটকে বেরিয়ে পড়েছিল। বিজ্ঞানীদের মতে, এটি একটি মহাজাগতিক উদ্বাস্তুর মতো, যার সফর কেবলই চলনশীল, গন্তব্যহীন। চলতে-চলতে কখন সে আমাদের মহাজাগতিক সৌর-গৃহে ঢুকে পড়েছিল। আগেও এরকম অসংখ্য তারা মন্ডল সে অতিক্রম করেছে। আগামীতেও করবে।

অ্যাটলাস-এর যাত্রাপথ

‘ওউমুয়ামুয়া’ ছিল এক রহস্যময় বস্তু—নিঃসরণহীন, পুরু, লম্বাটে, একে অনেকে ‘এলিয়েন প্রোব’ বলতেও কসুর করেননি। তুলনায় ৩আই/অ্যাটলাস অনেকটাই সাধারণ। তবে ২আই/বোরিসভ যতটা উজ্জ্বল ও দৃশ্যমান ছিল, অ্যাটলাস ততটা নয়। এটি অনেকটাই ম্লান ও দূরবর্তী। অনেক বিজ্ঞানীর অনুমান, দীর্ঘ মহাজাগতিক যাত্রার কারণে এর বরফ ও ধূলিকণার উপাদান অনেকটাই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও, এমন একটি বস্তু, যা এসেছে আরেক সৌরজগৎ থেকে, তা আমাদের কাছে মহাবিশ্বের এক বোতলবন্দি বার্তার মতোই আশ্চর্যময়।

এই ধূমকেতুটিকে নিয়ে সকলের এত উৎসাহের কারণ, এমন আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু আমাদের সৌরজগতের বাইরের সৌরজগৎ সম্পর্কে অনেক তথ্য বহন করে। এরা কীভাবে গঠিত, কোন উপাদান নিয়ে তৈরি—এসব বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় অন্যান্য নক্ষত্রদের চারপাশে কী ধরনের গ্রহ বা পদার্থ থাকতে পারে। যদিও এরকম মহাজাগতিক পর্যটকদের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের কাছে গবেষণার জন্য খুব সময়ই কম থাকে। যদিও ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানীরা অ্যাটলাস-এর আলো বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করছেন ধূমকেতুটির গঠন, ঘূর্ণন এবং নির্গমনের প্রকারগুলি।সএর আগে ‘ওউমুয়ামুয়া’ আর ‘বোরিসভ’ বিজ্ঞানীদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল, তাই স্পেস এজেন্সিগুলি এখন ভাবছে এমন একটি "ইন্টারসেপ্টর মিশন" তৈরি করার কথা, যা ভবিষ্যতে অ্যাটলাস-এর মতো কোনও অতিথিকে অনুসরণ করতে পারবে। NASA-র Comet Interceptor মিশন, এই রকম একটি 'হঠাৎ পাওয়া' ধূমকেতুকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার জন্যই তৈরি হচ্ছে। ২০২৯ সালে তা আকাশে উৎক্ষেপিত হবে। তাই এই মুহূর্তে অ্যাটলাস-কে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। আমরা কেবলই দূর থেকে তার চলে যাওয়াকেই দেখতে পারি।

আরও পড়ুন-

জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্রকে বাঙালির মনে আছে?

৩আই/অ্যাটলাস যখন আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে, তখন তার যাত্রাপথ আমাদের মনে করিয়ে যাবে—আমরা একা নই। আকাশগঙ্গার কোনো এক কোণে এখন হয়তো অন্য তারারা জন্ম নিচ্ছে, অন্য সৌরজগৎ গড়ে উঠছে, হয়তো আমাদের মতোই কেউ তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে— কিছু সময়ের ব্যবধানেই তারাও দেখতে পাবে অ্যাটলাসকে। আর, কোনও দূর মহাশূন্য থেকে তারাদের আরোহী অ্যাটলাস জানবে, সেও আমাদের দেখেছে!

More Articles