সিসিটিভি বসালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অসুবিধাটা কোথায়?

Jadavpur University CCTV: প্রগতিশীলতার বা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার নামে আসলে কী চলে এখানে? নজর রাখা দরকার।

আপনি সিসিটিভি ক্যামেরার নজরে আছেন। আছি, সকলেই আছি! বাজারে, রাস্তায়, শপিং মলে সর্বত্রই তো কেউ না কেউ সবাইকে দেখছে। তাহলে ক্যাম্পাসে যদি আরও কয়েক জোড়া চোখ ছাত্রছাত্রীদের দেখে অসুবিধাটা কী? অন্তত অনৈতিক আচরণ যদি ধরে ফেলা যায়, শনাক্ত করে নেওয়া যায়, আখেরে তো ছাত্রছাত্রীদেরই লাভ! শেষ এই প্রশ্ন উঠেছিল হোক কলরব আন্দোলনের সময়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সারা রাজ্য জুড়ে আন্দোলনের আঁচ ছড়িয়েছিল, তৎকালীন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে সরে যেতে হয়েছিল দায়িত্ব থেকে। সেবারেও সিসিটিভির গুরুত্ব টের পেয়েছিল প্রশাসন। এবার, সিসিটিভি একপ্রকার বসানোই হচ্ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সিসিটিভিকে প্রশাসন এত গুরুত্ব কেন দিচ্ছে আর কেনই বা ছাত্রছাত্রীদের একাংশ চাইছে কোনওমতেই যেন সিসিটিভি না বসে?

সিসিটিভির পক্ষে সওয়াল করা মানুষরা বলছেন, ক্যাম্পাসে, হস্টেলে যদি পর্যাপ্ত সিসিটিভি থাকত তাহলে প্রথমবর্ষের ছাত্রটিকে এভাবে মারা যেতে হতো না র‍্যাগিংয়ের ফলে। বা, একান্তই মারা গেলে কে কে দায়ী, তা ধরে ফেলা যেত সহজেই। অতএব, র‍্যাগিং কাণ্ডে যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে জোরদার আলোচনা চলছে, তার অন্যতম হচ্ছে সিসিটিভি বসাও! যাদবপুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মেনেই সেখানে পড়াশোনা হয়, পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে হয়, পরীক্ষা দিয়েই প্রবেশের অধিকার পেতে হয়। অথচ যাদবপুর প্রতিষ্ঠান বিরোধীও! অন্তত চিন্তায় নিজেদের তেমনই দাবি করেন ছাত্রছাত্রীরা। দেশের যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শাসকের নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়, শাসকের চিন্তাকে সওয়াল করা হয় যাদবপুর তারই মধ্যে অন্যতম। সেই প্রগতিশীল যাদবপুরে ছাত্র মরে গেল র‍্যাগিং হয়ে! তাহলে প্রগতিশীলতার বা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার নামে আসলে কী চলে এখানে? নজর রাখা দরকার।

আরও পড়ুন- রাজন্যাই তবে পারবে যাদবপুরের বাম দুর্গে ফাটল ধরাতে?

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হস্টেল এবং ক্যাম্পাসের প্রবেশ ও প্রস্থানের মূল জায়গাগুলিতে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের একাংশ মনে করছেন, প্রশাসনের প্রথম কাজ অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সমস্যাটা র‌্যাগিং। যে ব্যক্তিরা এই ছাত্রের মৃত্যুর জন্য দায়ী তাদের শাস্তি দরকার। সিসিটিভি বসিয়ে অপরাধ কমে গেছে এমন কি কোথাও ঘটেছে? সব জায়গায় সিসিটিভি বসালেই ছাত্রছাত্রীরা হেনস্থা হবে না? প্রশাসন তাহলে নিয়ম নীতি কড়া না করে পড়ুয়াদের সিসিটিভির নজরে এনে কীসে লাগাম টানতে চাইছে? সিসিটিভি অপরাধীদের শনাক্ত করলেও করতে পারে, তবে অপরাধ বন্ধ করতে তো পারবে না।

২০১০ সালে তৎকালীন উপাচার্য প্রদীপনারায়ণ ঘোষের সময়েই প্রথমবার সিসিটিভি বসে। পড়ুয়ারা ঘেরাও করেন উপাচার্যকে। ছাত্র আন্দোলনের চাপে কর্তৃপক্ষ ক্যামেরা খুলে নিতে বাধ্য হয়। ২০১৩ সালে তৎকালীন উপাচার্য সৌভিক ভট্টাচার্যকেও পদত্যাগ করতে হয় সিসিটিভি সংক্রান্ত একাধিক ইস্যুতে। আর ২০১৪ সালে যখন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী অরবিন্দ ভবনে তাঁর অফিস ও করিডোরে সিসিটিভি ক্যামেরা বসান, আন্দোলন হয় ফের। সেই সময়, এই সমস্ত ঘটনা মাথায় রেখে, কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও হয়। আদালত যাদবপুরের জন্য একগুচ্ছ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়। পুলিশ আউটপোস্ট থেকে শুরু করে পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করা, বিক্ষোভের স্থান নির্দিষ্টও করতে বলা- সবই ছিল আদালতের নির্দেশে। সেগুলি কার্যকর হয়নি বলাই বাহুল্য। ২০১৫ সালে যখন তৎকালীন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে রাজ্য প্রশাসনের নির্দেশে পদত্যাগ করতে হয়, তাঁর জায়গায় উপাচার্য হয়ে সুরঞ্জন দাস সমস্ত সিসিটিভি ক্যামেরা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৮ সালে আবার আদালতের নির্দেশ উল্লেখ করে চার দফা নির্দেশিকা জারি করেন তৎকালীন রেজিস্ট্রার চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য। এবার ফের সেই নির্দেশিকাই জারি হলো। তাহলে এতকাল কেনই বা বসানো হলো না ক্যামেরা, কেনই বা পড়ুয়াদের নজরে রাখার এত দরকার পড়ল এখন?

আরও পড়ুন- র‍্যাগিং চলছে, চলবে…

যাদবপুরে বরাবরই বিভিন্ন বাম সংগঠন, স্বাধীন সংগঠনের দাপট বেশি। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার নামে এখানে চিরকালই মদ-গাঁজার অবাধ চর্চাকে প্রশ্ন করে আসা হয়েছে, ছাত্রমৃত্যুতে সেই ইস্যু আবার সামনে এসেছে। সিসিটিভি বসানো হলে ক্যাম্পসের মধ্যে মদ খাওয়া, গাঁজা খাওয়ার ব্যাপারটি কমে যাবে, কারা খাচ্ছে ধরা যাবে তাই এই সব ‘গাঁজাখোর’দের সমস্যা হবে সিসিটিভিতে, বলছেন দক্ষিণপন্থীরা। আর স্বাধীন দল বা বামদলগুলি বলছে, মদ গাঁজা কোনও সমস্যা না। মূল সমস্যা থেকে নজর ঘোরাতেই এই সিসিটিভির আমদানি হবে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ্যের শাসক তৃণমূল বা কেন্দ্রের শাসক বিজেপি, কারওই কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই তেমন তাই সিসিটিভি বসিয়ে মুক্তচিন্তাকে দমানো হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক জায়গায় এমন এমন সভা হয় ছাত্রছাত্রীদের যা শাসকের বিড়ম্বনা। এই ধরনের স্বাধীন সংগঠনগুলির গলা বন্ধ করতে, আর বামদলগুলির সদস্যদের চিহ্নিত করে তাঁদের উপর আক্রমণ করা অনেক সহজ হয়ে যাবে শাসকের পক্ষে। তাই ক্যাম্পাসে সিসিটিভি শাসক অপরাধ ঠেকাতে নয়, বরং নিজেদের কাঁটা উপড়াতেই ব্যবহার করবে।

আরও পড়ুন- কে তুমি?

তৃণমূল এই র‍্যাগিং কাণ্ডের পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের জোর বাড়াতে রাজন্যা হালদারকে নেতৃত্বের মুখ করে তুলেছে। রাজন্যারা বলছেন, বিশ্বাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি ক্যাম্পাসে সিসিটিভি না বসায় তাহলে তাঁরাই বসিয়ে নেবেন কারণ যারা বিরোধিতা করতে চাইছেন তারা সবাই অবৈধ কার্যকলাপে যুক্ত। ড্রাগস নেওয়া এবং মদ খাওয়াতে হস্তক্ষেপ হবে বলেই এমন গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের বিরোধিতা হচ্ছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ও সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের জন্য আর্থিক সাহায্য চেয়ে রাজ্যের শিক্ষা বিভাগকে চিঠি দিচ্ছে। রাজন্যার মতোই, বিশ্ববিদ্যালয়ও মনে করছে 'অবৈধ কাজ' রোধে বিশাল ক্যাম্পাসে নজরদারি বজায় রাখতেই হবে। আসলে কি তাই? ছাত্রের মৃত্যুকে ঘিরে মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক আচরণ নিয়ে সওয়াল উঠছে। হস্টেলের অন্দরে কী হয়, প্রশাসন কিছুই কি জানত না এতদিন? কোনও উপাচার্য চেয়েছেন ছাত্রদরদি হতে, কেউ আবার প্রশাসনকে না চটিয়ে দায়িত্ব সামলে সরে যেতে চেয়েছেন। এই প্রথমবর্ষের ছাত্রের মৃত্যু হস্টেলে দীর্ঘদিন চলা অসুখের চরম উপসর্গ, তাই প্রকাশ্যে এসেছে। বিজেপি আর তৃণমূল সমস্বরে বলছে গাঁজা বন্ধ হলেই সব বাগে চলে আসবে। মদের বোতলমুক্ত ক্যাম্পাস হওয়াই কাম্য। ঠিকই, কাম্য তো বটে! তবে এতে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনা কমে যাবে? বা র‍্যাগিং করার নেপথ্যে থাকা জঘন্য অসুস্থতাও কি সিসিটিভির সামনে আসবে? নাকি শাসকের বিরুদ্ধে কোথাও কী আলোচনা চলছে, জমায়েত চলছে তা বেশি দখলে রাখা সম্ভব হবে? সমস্ত প্রশ্নের ভিড়ে হারাচ্ছে মৃত ছাত্রটির যন্ত্রণা, হারাচ্ছে মফসসল থেকে পড়তে আসা এমন অনেক ছাত্রদের নিজেকে ক্রমাগত গুটিয়ে নেওয়ার গল্প, হারাচ্ছে র‍্যাগিং হয়ে আজীবনের মতো ট্রমা নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষদের কথা। যাদবপুর ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলছে, মৃত্যুর না সত্যর, এ উত্তর প্রশাসনই জানে।

 

More Articles