চড়া দামে ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, গ্লাভস, তুলো, প্রস্রাবের ব্যাগ বিক্রি করেছেন সন্দীপ ঘোষ?
Bio medical waste Scam RG Kar: সামান্য পয়সার জন্য ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, সূঁচ, রক্তমাখা তুলো-ব্যান্ডেজ, প্রস্রাবের ব্যাগ ঘাঁটতে হয় শিশু শ্রমিকদের। পারিশ্রমিক কেমন?
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ধর্ষণ ও হত্যার পাশাপাশি আরেকটি বিষয় নিয়ে তদন্ত চলছে। দীর্ঘদিন ধরেই এই হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ উঠেছে। সন্দীপ ঘোষ যে অসীম ক্ষমতার বলে বারেবারে রাজ্যের বদলির নির্দেশিকাকে কলা দেখিয়ে আরজি কর হাসপাতালেই গদি দখল করে বসেছিলেন, তা সকলেরই জানা। কেন আরজি করের প্রতি এত 'টান’? জানা গেছে, হাসপাতালে সামান্য সরঞ্জাম কেনা থেকে শুরু করে অঙ্গপাচার, একাধিক দুর্নীতির আখড়া গড়ে উঠেছিল সন্দীপ ঘোষের আমলেই। হাসপাতালে যৌনচক্র, মাদকচক্রেরও অভিযোগ রয়েছে। আরেকটি বড় দুর্নীতি হলো, বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য বিক্রি! এই বিষয়গুলির তদন্ত শুরু করেছে সিবিআই। কিন্তু বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য আসলে কী? এই নিয়ে ঠিক কী দুর্নীতি হয়?
বায়োমেডিকাল বর্জ্য আসলে কী? প্রতি হাসপাতালেই রোজ প্রচুর পরিমাণে বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য (BMW) উৎপন্ন হয়। কোনও মানুষ বা প্রাণীর রোগ নির্ণয়, চিকিত্সা বা টিকা দেওয়ার সময় প্রচুর এমন উপকরণ থেকে যায় যা আর কাজে আসে না, অথচ তা অন্যদের জন্য বিপজ্জনক। এর মধ্যে রক্ত এবং রক্তের উপাদান রয়েছে, চিকিৎসায় ব্যবহৃত ধারালো জিনিস, যেমন সূঁচ, সিরিঞ্জ, IV টিউবিং, স্ক্যাল্পেল ব্লেড এবং ল্যানসেট, সংক্রামক কিছু উপকরণ, প্যাথলজিক্যাল বর্জ্য, যেমন মানুষের টিস্যু, অঙ্গ, শরীরের অংশ এবং শরীরের তরল বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য। চিকিৎসকরা, নার্সরা যে হ্যান্ড গ্লাভস পরেন তাও দ্বিতীয়বার আর ব্যবহার করা যায় না। মেডিকেটেড মাস্ক, রক্তে ভেজা তুলোর প্যাড, নানা ওষুধ, ড্রেন ব্যাগ এই সবকিছুই বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য।
আরও পড়ুন- মৃতকেই দুষেছিলেন, আরজি করের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ আসলে কে?
এই সমস্ত বর্জ্য পদার্থ সঠিকভাবে পরিচালনা না করলে তা ভয়াবহ সক্রমণ ছড়াতে পারে। মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্যও এই বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। এই বর্জ্য অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ ছড়াতে পারে। বায়ু, জল ও মাটিকে তীব্রভাবে দূষিত করতে পারে। ধরা যাক, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধগুলি নর্দমায় ফেলে দেওয়া হলো। তাহলে পরিশোধনাগারে সেগুলির প্রক্রিয়াকরণ হলো না, ফলে সেগুলি জলে মিশে বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে। তাই এই বায়োমেডিক্যাল বর্জ্যকে যতটা সম্ভব উৎসের কাছাকাছি জীবাণুমুক্ত করতে হয়। যখন এই বর্জ্য তৈরি হচ্ছে তখনই তা নষ্ট করে ফেলতে হবে। সুরক্ষিত, ভালো আলো-বাতাসযুক্ত, শুষ্ক জায়গায় এই বর্জ্য রাখতে হয়, নির্দিষ্ট অনুমোদন ছাড়া অন্য কেউই এর কাছাকাছি যেতে পারে না। পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতিতে এই বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য বিনাশ করতে হয়।
অভিযোগ, এই বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে আরজি কর হাসপাতালে। সরকারি নথি বলছে, পশ্চিমবঙ্গে দৈনিক যত বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য উৎপন্ন হয় তার পুরোটাই প্রক্রিয়াকরণ হয়। ২০২২ সালের কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গে দৈনিক বায়োমেডিক্যাল বর্জ্যের পরিমাণ ৩৮৮৮৬.১৪ কিলোগ্রাম। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কাছে পাঠিয়েছিল রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। ওই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের বিভিন্ন শয্যাযুক্ত ও শয্যাবিহীন হাসপাতালের বায়োমেডিক্যাল বর্জ্যের দৈনিক পরিমাণ যথাক্রমে ৩২৭৯৯.৫২ কিলোগ্রাম এবং ৬০৮৬.৬২ কিলোগ্রাম। মোট ৩৮৮৮৬.১৪ কিলোগ্রাম। এর পুরোটাই প্রক্রিয়াকরণ হয়। ফলে উদ্বৃত্ত কিছুই থাকার কথা নয়। তাহলে কী দুর্নীতি ঘটল আরজি করে? অভিযোগ, এই রিপোর্টে যা লেখা আর বাস্তবে যা ঘটে তা আলাদা। সন্দীপ ঘোষ নাকি এই বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য বাইরে বিক্রি করেছেন। অথচ হিসেবে অন্য দেখানো হয়েছে। যদি হাসপাতালে দৈনিক ১০০ কিলোগ্রাম বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য উৎপন্ন হয়, তাহলে তার মধ্যে থেকে ৩০ কিলোগ্রাম সরিয়ে দিল মাত্র ৭০ কিলোগ্রামের হিসাব দেখানো হচ্ছে। অর্থাৎ রিপোর্ট মানতে গেলে পুরো বর্জ্যটাই প্রক্রিয়াকরণ হল। বাস্তবে হলো ৭০ কেজির! ৩০ কেজি কোথায়? তা পাচার হচ্ছে চড়া দামে।
কিন্তু বর্জ্য কেনে কারা? কেন দূষিত বস্তুর এত চড়া দাম দেয় চোরাবাজার? বর্জ্য পাচার কি? বর্জ্য পাচার বা বর্জ্যের অবৈধ বাণিজ্যে ব্যাপক টাকার খেলা চলে। প্রতি বছর বিশ্বের বিলিয়ন ডলার মূল্যের বাণিজ্য হয় এই বর্জ্যের। এই বর্জ্য পাচারের সাথে জড়িত অপরাধীরা প্রায়ই বৈধ রপ্তানির মধ্যে তাদের অবৈধ রপ্তানি করে থাকে। অনেকেই এই বর্জ্যকে 'সেকেন্ড-হ্যান্ড পণ্য' হিসেবে দেখায়। ঘুষের খেলা তো খুব সাধারণই। অবৈধ বর্জ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকার মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলি সবচেয়ে বেশি হয়।
আরও পড়ুন- আরজি করে মাদক, যৌনচক্র, মানব অঙ্গ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ! কেন চুপ মুখ্যমন্ত্রী?
প্রতিদিন সারা দেশে যে কয়েক হাজার টন বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য উৎপাদিত হয় সেখান থেকে যা পাচার হয়ে বাজারে আসে, তা থেকে শিশু এবং মহিলা শ্রমিকরা মূলত পুনর্ব্যবহারযোগ্য বিপজ্জনক উপকরণগুলি বাছাই করে। এই ধরনের বাছাই করার জায়গাগুলি কিন্তু কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত নয়। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানেই বিভিন্ন প্লাস্টিক কারখানা, লোহা লক্কড়ের কারখানার আড়ালেই এই কাজ চলে।
এই ভয়ঙ্কর ব্যবসা দুর্বল আইন, ব্যাপক দুর্নীতি এবং দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্যের কারণেই এত ব্যাপক হারে বেড়েছে। দরিদ্র পরিবারের মা এবং তাদের সন্তানদের গুরুতর সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়তে দেখা গেছে কারণ সামান্য পয়সার জন্য ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, সূঁচ, রক্তমাখা তুলো-ব্যান্ডেজ, প্রস্রাবের ব্যাগ ঘাঁটতে হয় তাদের। পারিশ্রমিক কেমন? মোটামুটি তিন টাকা প্রতি কিলো হিসেবে পারিশ্রমিক মেলে। পুলিশকে সামান্য ৫০০-১০০০ টাকা ঘুষ দিয়েই ব্যবসায়ীরা শহরের মূল কেন্দ্রে থেকেই এই ব্যবসা চালিয়ে যান। অভিযোগ, সন্দীপ ঘোষ এভাবেই অবৈধ বাণিজ্য করেছেন বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট নিয়ে। সেই 'গোপন' ঘটনা জেনে ফেলাতেই কি সরে যেতে হলো তরুণী চিকিৎসককে? তদন্ত চলছে।