ডায়রিয়া থেকে সোজা পক্ষাঘাত! কতটা ভয়াবহ এই রহস্যময় রোগ জিবিএস?
GBS Pune: Guillain-Barre Syndrome বা জিবিএস একজন ব্যক্তির ইমিউন সিস্টেম তার নিজেরই স্নায়ুকোষকে আক্রমণ করে। ভাবে এটি বোধহয় প্যাথোজেন।
জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে পুনের কিরকাটওয়াড়ি এলাকার বছর পঞ্চাশের এক মহিলাকে পুনা হাসপাতাল এবং মেডিকেল রিসার্চে ভর্তি করা হয়। অদ্ভুত কিছু উপসর্গ ধরা পড়েছিল তাঁর। নীচের অঙ্গগুলি অসাড় হয়ে যায়, শুরু হয় খিঁচুনি। পরবর্তীকালে তা প্যারালাইসিস হয়ে যায়। মহিলার স্বামী জানিয়েছিলেন, পুনের সিংহগড় রোডের কাছে তাদের এলাকায় বেশ কয়েকজন বাসিন্দা এক সপ্তাহ আগে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই ওই এলাকা থেকে আরও তিনজন বাসিন্দার দেহেও এই একই লক্ষণ দেখা যাওয়াতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই রোগীদেরও দেহ অসাড় হয়ে যাচ্ছিল এবং শেষ পর্যন্ত পক্ষাঘাত হয়ে যায় সকলের। এই চারজন রোগীরই গুইলেন-বারে সিন্ড্রোম বা জিবিএস ধরা পড়ে। এটি একটি বিরল অটো-ইমিউন রোগ যা সাধারণত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে দেখা দেয়। প্রথম রোগীর মল পরীক্ষা করে দেখা যায় ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর জেজুনি নামে একটি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটেছে দেহে।
এই ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর জেজুনি এমন একটি ব্যাকটেরিয়া যা দূষিত জল, কাঁচা দুধ বা নষ্ট হয়ে যাওয়া মাংস, রান্না না করে খাওয়া হলে তার মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়। এর পরের দুই সপ্তাহজুড়ে পুনেতে জিবিএস রোগীদের সংখ্যা বেড়েছে। জানুয়ারির শুরু থেকে প্রায় ১১০টি সংক্রমণ দেখা গেছে এখানে। রবিবার চিকিত্সাধীন এক রোগী শ্বাসকষ্টজনিত জটিলতার কারণে রোগী মারাও যান। আরও ১৩ জন রোগী পুনেতে ভেন্টিলেটর সাপোর্টে রয়েছেন। মোট রোগীর মধ্যে ২০জনই নয় বছরের কম বয়সি শিশু।
আরও পড়ুন- গোদি মিডিয়ার জুজু! HMPV সংক্রমণ নিয়ে কেন চিন্তিতই নন চিকিৎসকরা?
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি ৪৪ জন রোগীর মলের নমুনা পরীক্ষা করেছিল। পাঁচজনের দেহে ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর জেজুনি সংক্রমণ দেখা যায় এবং ১৪ জনের দেহে নোরোভাইরাস পাওয়া গেছে। নোরোভাইরাস একজন সংক্রামিত ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির শারীরিক যোগাযোগ হলে বা বাতাসের মাধ্যমে বা দূষিত কোনও জায়গা ছুঁলে ছড়িয়ে পড়ে। এই ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসে আক্রান্ত হলে জ্বর, পেটে ব্যথা এবং ডায়রিয়া দেখা যায়। চিকিৎসকরা বলছেন, দুই থেকে তিনদিন পরে এই লক্ষণগুলি কমে যায়। তিনদিনের মাথায় রোগীরা উপসর্গবিহীন হয়ে যান। তার কয়েকদিন পর কিছু কিছু রোগীর নিম্নাঙ্গে দুর্বলতা এবং অসাড় ভাব দেখা যেতে পারে। এটিই জিবিএস-এ রূপান্তরিত হয়।
Guillain-Barre Syndrome বা জিবিএস একজন ব্যক্তির ইমিউন সিস্টেম তার নিজেরই স্নায়ুকোষকে আক্রমণ করে। ভাবে এটি বোধহয় প্যাথোজেন। যার ফলে পক্ষাঘাত, অসাড়তা বা দুর্বলতা দেখা দেয় যা কয়েক দিন, এমনকী বছর ধরে চলতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এটি মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই জিবিএস নিয়ে মূলত দু'টি কারণে উদ্বিগ্ন। প্রথমত, গুইলেন-বারে সিনড্রোম অত্যন্ত বিরল এবং বহু সংক্রামিতের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যকেরই উপসর্গ দেখা দেয়। ফলে পুনেতে ক্যাম্পিলোব্যাক্টর এবং নোরোভাইরাস সংক্রমণের ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন স্টেটস অনুযায়ী, ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর সংক্রামিত প্রতি ১,০০০ জন রোগীর মধ্যে একজনের দেহে এই উপসর্গ দেখা দেয়। নোরোভাইরাসের ক্ষেত্রে জিবিএস সংক্রমণ আরও বিরল।
দ্বিতীয়ত, গুইলেন-বারে সিন্ড্রোম আক্রান্ত হওয়ার যে যে ঘটনা এখনও অবধি জানা গেছে, এই সংক্রমণ তার চেয়েও বেশি সাধারণ হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া মানুষকে নতুন উপায়েও সংক্রমিত করতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের মিউটেশনও ঘটে থাকতে পারে। যদিও পুনেতে এখনও তার প্রমাণ মেলেনি। তবে ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর এবং নোরোভাইরাস সংক্রমণের উত্সও এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পুনেতে প্রথম সংক্রমণ হয় ৯ জানুয়ারি। সে রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য বলছে, গত রবিবার পর্যন্ত সংক্রমিত ৮৮ জন রোগী ছিলেন পুনে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের অন্তর্গত, ১৫ জন পিম্পরি চিঞ্চওয়াড়ের এবং ৭ জন কাছাকাছি গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দা। এখনও অবধি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংক্রমণ ছড়িয়েছে সিংহগড় রোড এলাকায়। এখানে মূলত শহুরে বসতি যেমন আছে তেমনই আছে গ্রাম, কৃষি জমি এবং হাঁস-মুরগির খামার রয়েছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, সিংহগড় রোডের জিবিএস রোগীদের ৬০ শতাংশই ডায়রিয়ায় ভুগছিলেন। স্বাস্থ্য আধিকারিকরা বলছেন, দূষিত জল, আর সম্ভবত হাঁস-মুরগির খামার মানুষের বসতির কাছাকাছি হওয়াতে সংক্রমণ বাড়ছে। তবে ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর অন্যান্য উপায়েও ছড়িয়ে পড়ে। রান্না না করা বা কাঁচা মাংসের মাধ্যমেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
আরও পড়ুন- নেই নির্দিষ্ট চিকিৎসা, অধিকাংশ মহিলাকেই পোহাতে হচ্ছে এই নরক যন্ত্রণা! উপসর্গ কী?
গবেষণা বলছে যে ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর জেজুনি সংক্রামিত প্রতি এক লাখ রোগীর মধ্যে ০.৩ জনের মধ্যে জিবিএস দেখে দিতে পারে। পুনেতে জিবিএসের বর্তমান হার বলছে, শহরে ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর বা নোরোভাইরাসের এক লাখেরও বেশি সংক্রমণ হয়ে থাকতে পারে। তবে, আক্রান্ত এলাকার ৬৪,২৩৮ জন বাসিন্দার ঘরে ঘরে গিয়ে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ডায়রিয়ার মাত্র ১২৩৪ টি কেস পাওয়া গেছে। তাহলে প্রশ্ন উঠছে, জিবিএস সংক্রমণ এত বেশি হওয়ার নেপথ্যে অন্য কোনও কারণ নেই তো?
চিকিৎসকদের আশঙ্কা ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর সংক্রমণ দূষিত পানীয় জলের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে। প্রথম রোগী উল্লেখ করেছিলেন যে তাদের এলাকাটি পানীয় জলের জন্য ট্যাঙ্কারের উপর নির্ভরশীল। রাজ্যের স্বাস্থ্য আধিকারিকরা বলেছেন, পৌর কর্পোরেশন জীবাণুমুক্ত করার জন্য পানীয় জলের উত্সগুলিকে ক্লোরিন দিয়ে শোধন করে। তবে সেখানেই কি গাফিলতি থেকে যাচ্ছে? ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ইতিমধ্যেই জলের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে ৩৪টি জলের নমুনার মধ্যে ৭টিতেই দূষণ রয়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষকদের মধ্যে অনেকেই দাবি করেছেন, ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর জেজুনি ক্লোরিন প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে।
২০২৪ সালের অগাস্টে শ্রীলঙ্কার ভেটেরিনারি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক গয়ানি ওয়েরসুরিয়া দেখেন, মুরগির মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় ক্যাম্পাইলোব্যাক্টরের আইসোলেটগুলি ক্লোরিন প্রতিরোধী হয়ে গেছে। মাংস সাধারণত প্যাকেজ করার আগে ক্লোরিন দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা হয়। হায়দরাবাদ এবং বেঙ্গালুরুতে টাটা ইনস্টিটিউট অফ জেনেটিক্স অ্যান্ড সোসাইটি নিয়মিত বর্জ্য জলে নোরোভাইরাস এবং ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর খুঁজে পেয়েছে। পুনেতেও বর্জ্য জলের নমুনা বিশ্লেষণের কথা ভাবা হচ্ছে।