হুড়মুড়িয়ে বাড়ছে 'গ্রে ডিভোর্স'! কেন এত বছরের দাম্পত্যের পথে হঠাৎ কাঁটা?
Gray Divorce: শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, গ্রে ডিভোর্সের ফলে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনেও যথেষ্ট প্রভাব পড়তে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
পঞ্চাশ বছরের দাম্পত্যজীবন কাটানোর পর হঠাৎ একদিন স্বামী ঘোষণা করলেন, তিনি স্ত্রীকে ডিভোর্স দেবেন। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। এমনই এক চিত্রনাট্য দেখেছিল বাংলা ছবি। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা দাস পরিচালিত 'বেলাশেষে' ছবি তুলে এনেছিল এমনই এক সমস্যার কথা। ইদানীং যার গালভরা নাম 'গ্রে ডিভোর্স'। সমীক্ষা বলছে, সাম্প্রতিক কালে এক নতুন প্রবণতার বাড়বাড়ন্ত হয়েছে গোটা বিশ্ব জুড়েই। পঞ্চাশোর্ধ্ব দম্পতিরা যখন বিচ্ছেদের পথে হাঁটেন, তখন তাকে ধূসর বিবাহবিচ্ছেদ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু কেন বাড়ছে এই গ্রে ডিভোর্সের হার?
কান পাতলেই আজকাল বিবাহবিচ্ছেদের কথা শোনা যায়। তারকা থেকে শুরু করে আম আদমি, বিবাহবিচ্ছেদ এখন ঘরে ঘরে খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার। কিন্তু যখন চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ঘর করার পরে কোনও এক দম্পতি বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে চান, তখন অবাক লাগে বৈকি। সম্প্রতি মিডিয়া তোলপাড় অভিষেক বচ্চন-ঐশ্বর্য্য রাইয়ের বিবাহবিচ্ছেদের গুঞ্জনে। কিছুদিন আগেই বিবাহবিচ্ছেদের পথে হেঁটেছেন আমির খান ও কিরণ রাও। এই সমস্ত বিবাহবিচ্ছেদকেই আমরা গ্রে ডিভোর্সের আওতায় ফেলতে পারি। হলিউডে এমন উদাহরণ ঝুড়ি ঝুড়ি। কী এমন বিষয়, যা তাঁদের এতদিনের একসঙ্গে থাকার অভ্যাসের পথে কাঁটা হয়ে উঠল? বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এর নেপথ্যে নানাবিধ কারণের কথাই তুলে ধরেন।
সন্তান বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বহু দম্পতিই নিজেদের সম্পর্ক খতিয়ে দেখতে শুরু করেন, এবং ক্রমশ বুঝতে পারেন যে কোথাও সম্পর্কের জোরের জায়গাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। একসঙ্গে থাকলেও কোথাও যেন আলাদা হয়ে গিয়েছেন তাঁরা। সেখান থেকেই বিচ্ছেদের ভাবনার সূচনা। বহু ক্ষেত্রে আর্থিক বিষয়-আশয়ও বিবাহবিচ্ছেদের পথে এগিয়ে দিচ্ছে দম্পতিদের। অবসর পরিকল্পনা, নিজেদের সম্পত্তি-বিষয়আশয়ের বিষয়গুলি বা পরবর্তী কালে আর্থিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রশ্নগুলিই ঠেলে দিচ্ছে দম্পতিদের বিবাহবিচ্ছেদের দিকে। পাশাপাশি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনের প্রতি দাবি, অগ্রাধিকারগুলি পাল্টাতে থাকে। সেই সব ক্ষেত্রগুলি সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে শুরু করে। যা বিবাহবিচ্ছেদের দিকে ঠেলে দেয় বয়স্ক দম্পতিদেরও।
আরও পড়ুন: তালাকের পরেও ভরণপোষণ পাবেন মুসলিম মহিলারা, ঐতিহাসিক রায়ে যা জানাল সুপ্রিম কোর্ট
হঠাৎ এই গ্রে ডিভোর্সের বাড়বাড়ন্তের পিছনে সামাজিক কিছু বেশ কিছু পরিবর্তনও দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। আগের তুলনায় এই সময়কার মানুষের আয়ু অনেকটাই বেড়েছে। তার সঙ্গে এখন সামাজিক ভাবে এবং আর্থিক ভাবে অনেক বেশি স্বচ্ছল হয়েছেন মেয়েরা। এবং সেই সমস্ত স্বচ্ছলতা মানুষকে নিজের শর্তে বাঁচতে শিখিয়েছে। একটা সময় বিবাহবিচ্ছেদকে তেমন ভালো চোখে দেখত না সমাজ। বহু ক্ষেত্রেই বিবাহবিচ্ছিন্নাদের কলঙ্কের চোখে দেখা হত। সেই সময় বদলেছে। এখন ডিভোর্স নিয়ে সেই ট্যাবু কেটেছে। ফলে মতের অমিল হলে এখন অনেকেই বিচ্ছেদের পথে এগিয়ে যান স্বচ্ছন্দে। তবে কম বয়সে হোক বা বেশি বয়সে, বিবাহবিচ্ছেদ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দম্পতিদের জন্য মানসিক ভাবে চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেরই ডিপ্রেশন, একাকিত্বের মতো সমস্যা দেখা যায়। বিশেষত তাঁদের ক্ষেত্রে, যাঁদের কাছে তেমন কোনও সোশ্যাল সাপোর্ট নেই। সেসব এ সমস্যাগুলো আরও বেশি বড় হয়ে ওঠে।
একই সঙ্গে গ্রে ডিভোর্সের ফলে অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখেও পড়েন অনেকে। যদি তাঁদের ক্ষেত্রে সম্পত্তির হিসেব ঠিকঠাক করা না থাকে, সে ক্ষেত্রে তো আরও বেশি সমস্যা হয়। বিশেষত মহিলাদের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি আরও বেশি লক্ষ্য করা যায়। বহু ক্ষেত্রের তাঁদের জীবনযাপনের ধরন বদলে যায় আর্থিক সমস্যার জেরে। এমনও দেখা যায়, সন্তানকে বড় করার পিছনে নিজেদের কেরিয়ারকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছেন যাঁরা, যাঁরা আর্থিক ভাবে স্বামীর উপরেই নির্ভরশীল, তাঁদের ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ পরবর্তী জীবনে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাব বড় আকার নেয়। ন্যাশনাল সেন্টার ফর ফ্যামিলি অ্যান্ড ম্যারেজ রিসার্চের সমীক্ষা বলছে, মহিলারাই এই ধরনের সমস্যার বেশি সম্মুখীন হন গ্রে ডিভোর্স পরবর্তী জীবনে। বহু ক্ষেত্রেই বয়সকালে বিবাহবিচ্ছেদ স্বাস্থ্যের দিক থেকেও ক্ষতিকর হতে পারে। বিবাহবিচ্ছেদের যে ভয়ঙ্কর স্ট্রেস, চাপ তা নিতে পারেন না অনেকেই।
তবে শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, গ্রে ডিভোর্সের ফলে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনেও যথেষ্ট প্রভাব পড়তে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। গ্রে ডিভোর্সের বাড়বাড়ন্তের ফলে বয়স্কদের সহায়তাকারী সংস্থাগুলোর প্রয়োজন ক্রমশ বাড়ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। বিদেশের মতো না হলেও ভারতের মতো দেশেও ইদানীং প্রবণতা হিসেবে উঠে আসছে গ্রে ডিভোর্স। যৌথ পরিবারের কাঠামো ভেঙে যে নিউক্লিয়াস থেকে নিউক্লিয়াসতর পরিবারের দিকে এগোচ্ছি আমরা, তার প্রভাবও আসলে পড়ছে যৌথজীবনের ক্ষেত্রে।
কীভাবে রোখা যেতে পারে এই গ্রে ডিভোর্সের প্রবণতা? বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এসব ক্ষেত্রে খুবই কাজের হতে পারে কাউন্সিলিংয়ের মতো বিষয়। একই সঙ্গে সম্পর্কের গোড়া থেকেই আর্থিক পরিকল্পনা দরকার। বিবাহবিচ্ছেদ পরবর্তী আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্যও প্রয়োজন আর্থিক পরিকল্পনা। গ্রে ডিভোর্সের মানসিক ও স্বাস্থ্যগত প্রভাবগুলি সম্পর্কে সচেতনতা প্রচারেরও প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
আরও পড়ুন: এবার লিভ-ইন রেজিস্ট্রি না করলেই শাস্তি! কী বলা আছে বিজেপি সরকারের প্রস্তাবিত আইনে?
রুশো বলেছিলেন, বিয়ে আসলে সামাজিক চুক্তি। কিন্তু সেই চুক্তির পথ ধরে চলতে চলতে সম্পর্কের মধ্যে আরও অনেক কিছু গড়ে ওঠে। সার্বিক ভাবে গড়ে ওঠে একে-অপরের প্রতি এক আশ্চর্য অভ্য়াস, যে অভ্য়াস হয়ে ওঠে পরম নির্ভরতার জায়গাও। ফলে সেই পথ ধরে এত বছর একসঙ্গে হাঁটার পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কখনও সোজা নয়। বরং বিষয়টি বেশ কঠিন। আসলে কোনও রকম বিচ্ছেদই তো কাঙ্ক্ষিত নয়। সেখান থেকে দাঁড়িয়ে এই গ্রে ডিভোর্সের বাড়বাড়ন্ত বেশ দুশ্চিন্তার বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।