দেড় লক্ষ মানুষের মৃত্যু পথ দুর্ঘটনায়, ট্রাফিক আইন মানছে না দেশ?
পথ দুর্ঘটনা রুখতে বারে বারে নানা কড়া পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে সরকারকে। কিন্তু ফলাফল বলছে, তাতেও রাশ টানা যায়নি মৃত্যুতে।
বেপরোয়া গতির শিকার বহু তরতাজা প্রাণ। গতির লড়াইয়ে জিততে জীবনের কাছে হেরে গেলেও থামানো যায়নি প্রতিযোগিতা। পরিসংখ্যানও বলছে, গোটা দেশে গত বছরে পথ দুর্ঘটনায় দু'চাকাই কেড়ে নিয়েছে সর্বাধিক প্রাণ। সংখ্যার হিসেবে যা মোট পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি। কেন্দ্র হোক বা রাজ্য, পথ দুর্ঘটনা রুখতে বারে বারে নানা কড়া পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে সরকারকে। কিন্তু ফলাফল বলছে, তাতেও রাশ টানা যায়নি মৃত্যুতে।
পথ দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র দেওয়া রিপোর্ট বলছে, গত বছর গোটা দেশে প্রায় ১.৫৬ লক্ষর বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন পথ দুর্ঘটনায়, যা সাত বছরে সর্বাধিক। এর মধ্যে ৬৯,২৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে দু'চাকার গাড়িতে। অর্থাৎ, দু'চাকার গাড়িতে মৃত্যুর হার প্রায় ৪৪.৫%। বাকি ২৩,৫৩১ জন (১৫.১%) মারা গেছেন চারচাকা গাড়ির দুর্ঘটনায় এবং ১৪,৬২২ জনের মৃত্যু হয়েছে লরি বা ট্রাক দুর্ঘটনায়। দু'চাকার গাড়ির দুর্ঘটনায় সর্বাধিক মানুষের প্রাণ গেছে তামিলনাড়ু রাজ্যে (৮,২৫৯ জন), যা মৃত্যুর হারের বিচারে প্রায় ১১.৯ শতাংশ। পরিসংখ্যানের নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ। সে-রাজ্যে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৭,৪২৯ এবং মৃত্যুর হার ১০.৩ শতাংশ। এসইউভি বা জিপ গাড়ির দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে। সেখানে মোট ৪,০৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে লরি বা ট্রাকের মতো বড় গাড়ির দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণনাশ হয়েছে মধ্যপ্রদেশে। রিপোর্ট বলছে, সে-রাজ্যে মৃত্যুর হার প্রায় ২৩.৪%। এছাড়াও বাস দুর্ঘটনায় উত্তরপ্রদেশের ২৮.৯% এবং তামিলনাড়ুর ১১.৯% মানুষ মারা গেছে। উত্তরপ্রদেশেই সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন।
আরও পড়ুন: পরিচিত বৃত্তেও সুরক্ষিত নন এদেশের নারীরা, বলছে সরকারি তথ্যই
পাশাপাশি রিপোর্টে দেখা গেছে যে, ২০২১ সালে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মোট ১৮,৯৩৬ জন পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। পরিসংখ্যানের নিরিখে পথচারীর মৃত্যুর ঘটনা সর্বাধিক বিহারে (১৪.৮% )। তবে মাসের ভিত্তিতে বিচার করে দেখা গেছে, মোট পথ দুর্ঘটনার অধিকাংশই ঘটেছে গত বছরের জানুয়ারি মাসে। প্রায় ৪০,২৩৫টি পথ দুর্ঘটনা ঘটে ওই মাসে, যা মোটের ১০%। অন্যদিকে তথ্য বলছে, মোট পথ দুর্ঘটনার অধিকাংশই ঘটেছে সন্ধে ৬টা থেকে রাত ন'টার মধ্যে। অর্থাৎ যে-সময় বেশিরভাগ রাস্তাতেই গাড়ি ভর্তি থাকে। উল্লিখিত সময়ে মোট ৮১,৪১০টি দুর্ঘটনা হয়েছে আর এর বেশিরভাগই তামিলনাড়ুতে। তামিলনাড়ুর পরেই এই তালিকায় রয়েছে মধ্যপ্রদেশ এবং কেরল। দুপুর তিনটে থেকে সন্ধে ছ'টা পর্যন্ত সময়ে ১৭.৮ শতাংশ দুর্ঘটনা (৭১,৭১১ টি) ঘটেছে।আবার রাত ১২ টা থেকে দুপুর তিনটের মধ্যে দুর্ঘটনার হার ১৫.৫ শতাংশ।
রাস্তার নিরিখে বিচার করলে, পথ দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন হাইওয়েতে। পরিসংখ্যানের নিরিখে যা প্রায় ৩০.৩%। রাজ্যের হাইওয়েগুলির অবস্থাও প্রায় একই। তবে মোট দুর্ঘটনার অধিকাংশই হয়েছে হাইওয়ে ব্যতীত অন্যান্য রাস্তাঘাটে। এই ধরনের রাস্তায় দুর্ঘটনার পরিমাণ প্রায় ৪৫.৮%। ১,৮৯৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে এক্সপ্রেসওয়েতে এবং প্রায় ১,৩৫৬ জন মারাও গেছেন । পথ দুর্ঘটনায় সবথেকে বেশি মারা গেছেন ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সিরা (৬৩%)। আবার লিঙ্গের বিচারে মৃতদের ৮৪ শতাংশই পুরুষ এবং ১৬ শতাংশ মহিলা। দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে রিপোর্টে উল্লেখ করা অতিরিক্ত গতি এবং মদ্যপান। মাত্র ২ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ খারাপ আবহাওয়া।
নিরাপদ কলকাতা
২০২১ সালে কলকাতায় মোট ২১১টি পথ দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা অন্যান্য মেট্রোপলিটন শহরগুলির মধ্যে সর্বনিম্ন। দিল্লিতে গত বছর মোট ১,১৭২টি, চেন্নাইয়ে ৯৯৮টি, বেঙ্গালুরুতে ৬৫৪টি দুর্ঘটনা ঘটে। দেশের ৫৩টি মেগা সিটির তুলনায় মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম কলকাতায় (০.৬%)। তবে ২১১ জনের মধ্যে ৯২ জন সাধারণ পথচারী, ৬৯ জন মোটরবাইক আরোহী এবং ২৩ জন সাইকেল আরোহী। পরিসংখ্যানের নিরিখে, ২০২০ সালে কলকাতায় মোট ১৬৮৩টি পথ দুর্ঘটনার মধ্যে ২০১ জন প্রাণ হারান। তবে শেষ তিন বছরে পথ দুর্ঘটনায় সবথেকে বেশি মানুষ মারা যান ২০১৯ সালে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে চালু হওয়া 'সেফ ড্রাইভ, সেফ লাইফ’ ক্যাম্পেনের জন্য দায়ী বলে মনে পুলিশ কর্তারা। ক্যাম্পেন ছাড়াও কঠোরভাবে ট্রাফিক আইন মেনে চলার কারণেই এই সাফল্য এসেছে বলে তাঁদের মত।