রাতদিন সমানে জিম করেন, হার্ট সুস্থ আছে তো? নিজের অজান্তেই যে বিপদ ডেকে আনছেন
Excessive Workout Heart Affect : দৌড়লে শরীর সুস্থ থাকে, ভালো থাকে। সচল থাকে। কিন্তু সেই জিম আর দৌড়, ম্যারাথন যখন প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়?
কেস ১ : ২০২২ সালের নভেম্বর মাস। অন্যান্য দিনের মতোই জিম করতে গিয়েছিলেন ভারতের টিভি পর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা সিদ্ধান্ত সূর্যবংশী। দিব্যি চলছিল শরীরচর্চা; হঠাৎই বুকে অসম্ভব যন্ত্রণা শুরু হয়। জিমের অন্যান্যরা ছুটে আসেন সিদ্ধান্তের দিকে। তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি তাঁকে। ডাক্তার বলেন, জিম করার সময়ই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান সিদ্ধান্ত।
কেস ২ : ২০২১ সালের শুরুর দিকেই ভারতের খবরের শিরোনামে চলে আসেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly)। ভারতীয় ক্রিকেটের প্রাক্তন অধিনায়ক ও কিংবদন্তি এই ক্রিকেটার প্রতিদিনের মতো জিম করছিলেন। হঠাৎই চোখে অন্ধকার নেমে আসে। জিম করতে করতেই পড়ে যান সৌরভ। তড়িঘড়ি তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তার বলেন, মৃদু হলেও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন মহারাজ। প্রাণে বেঁচে যান সৌরভ।
কেস ৩ : ২০০৮ সালের মে, স্থান ব্যাঙ্গালুরু। ১০ কিমি দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন অনেকেই। তাঁদের মধ্যেই একজন মধ্য তিরিশের যুবকও ছিলেন। স্বাস্থ্যবান নন, বরং ধাঁচটা রোগার দিকেই। দৌড় শুরু হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎই ট্র্যাকের ওপর মুখ থুবড়ে পড়েন ওই যুবক। মাত্র ৪ কিমি দৌড়েছিলেন তিনি। তড়িঘড়ি মেডিক্যাল টিম দৌড়ে আসে। ভাগ্যক্রমে, কাছেই একটি অ্যাম্বুলেন্স রাখা ছিল। চিকিৎসা দ্রুতগতিতে শুরু হয়। মুখ থুবড়ে পড়ার কারণ? আচমকা হার্ট অ্যাটাক…
বিগত কয়েক বছরে কেবল ভারত নয়, গোটা বিশ্বের এমন অজস্র উদাহরণ তুলে ধরা যায়। শরীরচর্চা করা অবশ্যই ভালো। এলাকার প্রতিটি জিমেই এখন ভিড় বাড়ছে। তরুণ তরুণী থেকে মধ্যবয়স্ক – প্রত্যেকেই শরীরচর্চার লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ছেন। সেইসঙ্গে ডাক্তাররাও বলছেন, দৌড় খুব ভালো জিনিস। দৌড়লে শরীর সুস্থ থাকে, ভালো থাকে। সচল থাকে। কিন্তু সেই জিম আর দৌড়, ম্যারাথন এসবই যখন প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়?
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না’। শরীরকে সচল রাখতে গেলে একটু কষ্ট তো করতেই হবে। জিমে গিয়ে কসরতের পাশাপাশি সঠিক খাওয়াদাওয়া, দৌড় সমস্ত দিক থেকেই ভালো। কিন্তু অত্যাধিক কসরত, কিংবা অত্যাধিক দৌড়নো আদতেই ঝুঁকিপূর্ণ। অনেকেই ভাবেন, একটু বেশি পরিশ্রম, একটু বেশি কসরত শরীরকে আরও চাঙ্গা করবে। কিন্তু ডাক্তাররা বলছেন, এটা একেবারে ভুল। বরং অত্যাধিক জিম করা মানুষের হার্টে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। সেই ধকল অনেকেই নিতে পারেন না। তার ফলেই একের পর এক মানুষের জিম করতে গিয়ে মৃত্যু!
অতিরিক্ত জিম করলে বা দৌড়লে কী হয়?
শরীরচর্চা হোক বা দৌড় – দুটো ক্ষেত্রেই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল জল। যত বেশি জিমে কসরত করবেন, তত বেশি জল আপনার শরীর থেকে বেরিয়ে যাবে। দৌড়ের ক্ষেত্রেও তাই। এর ফলে আপনি যদি সেই পরিমিত জল না খান, তবে ডিহাইড্রেশনের সমস্যা ঘিরে ধরবে। তাই জল তো বটেই, ওআরএস বা ইলেক্ট্রোলাইট মেশানো জল খেলে আপনার শরীর ঠিক থাকবে। কিন্তু অতিরিক্ত জিম করলে অনেকটা বেশি জল বেরিয়ে যাবে শরীর থেকে। তখনই বিপদ ধেয়ে আসে। মাথাব্যথা, পেশি সংকোচন, বমি, চোখে অন্ধকার – শরীর ফিট করতে গিয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন।
অতিরিক্ত দৌড় বা শরীরচর্চা আপনার হৃদয়যন্ত্রেরও ক্ষতি করে দেবে। এই ক্ষেত্রে আপনার হার্টকে প্রেসার কুকারের মতো মনে করুন। যত বেশি চাপ পড়বে, প্রেসার কুকারও সেইমতো কাজ করবে। অতিরিক্ত চাপ হলেই সেটি নিজের ভেতরে থাকা বাষ্প বের করে দেয়। কিন্তু যদি সেই ব্যবস্থা না থাকে? তাহলে অতিরিক্ত চাপ হলেই ফেটে যাবে প্রেসার কুকার। প্রাণীর হৃদপিণ্ডও সেরকমই। অতিরিক্ত পরিশ্রম, শরীরচর্চা বা দৌড় হার্টের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। শারীরিক স্ট্রেস বাড়ে। প্রতিদিন পরিমিত শরীরচর্চা হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখে। কিন্তু সেই পরিমিতের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেই ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসে সেটা। স্ট্রেস বাড়লেই দুর্বল হবে হৃদয়। চাপ পড়বে শিরা, ধমনি সহ পুরো সিস্টেমেই। নিট ফল? হার্ট অ্যাটাক!
শুধু হার্ট নয়, আপনার কিডনিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অতিরিক্ত জিম বা দৌড় সরাসরি প্রভাব ফেলে আপনার পেশিতে। পেশির মধ্যে থাকা ফাইবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে বেশকিছু ক্ষতিকারক রাসায়নিক রক্তে প্রবেশ করে। সেটি দেহের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। সেই রাসায়নিক প্রবেশ করে কিডনিতেও। ফলে অতিরিক্ত দুর্বলতা, খিঁচুনির পাশাপাশি কিডনিও ক্ষতির মুখে পড়বে। এই বিশেষ ঘটনাকে বলা হয় র্যাবডোমায়োলিসিস।
এসবের সঙ্গেই রয়েছে ঘুমের সমস্যা। শরীরের বিভিন্ন হরমোনের ‘রুটিন’ও বদলে যায়। ফলে অবসাদ, রাগ, ডিপ্রেশন সহ বিভিন্ন জিনিস ভিড় করবে মনে। তাহলে উপায়? ডাক্তারদের একটাই কথা, নিজের শরীর বুঝে, পরিমিত শরীরচর্চা করুন ও দৌড়ন। শরীরের জন্য সেটাই ভালো। জিম ট্রেনারদের আরও সতর্ক হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। শরীরে কোনও গোলযোগ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে জিম করুন। সুস্থ থাকতে শরীরচর্চা করুন, অসুস্থ হতে নয়।