অসুস্থতাকে হাতিয়ার করে আর কতদিন? সুতোয় ঝুলছে মমতার প্রিয় কেষ্টর ভবিষ্যৎ
তাহলে অসুস্থতাকে কি হাতিয়ার করছেন অনুব্রত মন্ডল? শারীরিক সমস্যা যতটা রয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি দেখিয়ে বারবার হাজিরা এড়িয়ে যাচ্ছেন কেষ্ট?
নয় নয় করে দশবারে ন'বার। ফের সিবিআই হাজিরা এড়িয়ে গেলেন বীরভূমের দাপুটে তৃণমূল নেতা অনুব্রত মন্ডল। 'অসুস্থ' অনুব্রতর আইনজীবীরা নিজাম প্যালেসে এলেন তাঁর 'বিতর্কিত' মেডিক্যাল রিপোর্ট নিয়ে। অর্থাৎ, আজও সিবিআইয়ের সঙ্গে 'লুকোচুরি' বজায় রাখলেন তৃণমূলের 'পাঁচন দাওয়াই'-এর স্রষ্টা।
এবার তাহলে কী? দশে দশে বিশ না কি দশে দশে দোষী! গরু পাচার-সহ একাধিক দুর্নীতির অপরাধে অভিযুক্ত অনুব্রত মন্ডল কি নিজেই নিজের জালে জড়িয়ে পড়লেন? হয়ে গেলেন অভিযুক্ত থেকে অপরাধী! আইনি মহলের একাংশ এই বিতর্কে সন্দিহান হলেও একপ্রকার নিশ্চিত, সিবিআই আর অনুব্রত-পর্বে অবশেষে কিছু একটা ঘটতে পারে। ঠিক কী জল্পনা উঠে আসছে? মনে করা হচ্ছে, দশবারের লুকোচুরি পর্বের পরে গারদে ঠাঁই হতে পারে বোলপুরের এই প্রভাবশালীর। আদালতে অনুব্রত মন্ডলকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করতে পারে সিবিআই। মঙ্গলবার কলকাতার নিজাম প্যালেসে আধিকারিকদের বৈঠকেও এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে সূত্রের খবর। তাহলে কি বোলপুরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার হবেন বীরভূমের বেতাজ বাদশা? এই জল্পনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না আইনি মহলের একাংশ। তাঁদের আশঙ্কা, অনুব্রত মন্ডল বারবার সিবিআই হাজিরা এড়িয়ে গিয়ে নিজেই ফাঁদে পা গলিয়ে ফেলেছেন। যে অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত, সেই অভিযোগে যে তিনিই অপরাধী, সেই বিষয়টি সিবিআই প্রমাণ করার আগেই তিনিই প্রায় বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজের অজান্তেই! কারণ, জিজ্ঞাসাবাদ এড়িয়ে যাওয়ার কৌশলের মধ্যে সিবিআইয়ের মুখোমুখি হতে ভয় রয়েছে, এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে বারবার।
এদিকে আগের মতো এসএসকেএম-এর উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তির অনুমতি মেলেনি অনুব্রত মন্ডলের। সোমবার তাঁকে পরীক্ষার পর বাড়ি থেকেই চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছেন রাজ্যের অন্যতম সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা। বোলপুরে ফিরতে হয়েছে উডবার্নের পরিচিত রোগীকে। এখানেও শুরু হয়েছে জল্পনা। তাহলে কি একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রিয় কেষ্টর ওপর থেকে হাত সরাচ্ছে তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো দল থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে অনুব্রতকে? এই প্রশ্নের মধ্যে অনেকেই আবার বলছেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, এসএসকেএম হাসপাতাল এবং আদালতের নির্দেশে ভুবনেশ্বরের এইমস পর্বে খানিকটা মুখ পুড়েছে রাজ্যের। চিকিৎসকদের একাংশর ভূমিকায় প্রশ্ন উঠেছে। এই অস্বস্তি এড়াতে অনুব্রত মন্ডলের অণ্ডকোষ-সহ একাধিক চিকিৎসা উডবার্নে ভর্তি রেখে হলেও তাঁর অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে, পায়ুদ্বারের সমস্যার সমাধান নিজের বাড়িতেই আপাতত সম্ভব বলে মনে করেছেন চিকিৎসকদের একাংশ।
আরও পড়ুন: অণ্ডকোষ থেকে হার্টের সমস্যা, অনুব্রতর অসুখ আর সারে না
এর আগে অনুব্রতর চিকিৎসকদের সূত্রে জানা গিয়েছিল, তিনি সিওপিডি-তে আক্রান্ত। এছাড়াও হৃদযন্ত্রের সমস্যার কথা জানিয়েছিলেন এসএসকেএম-এর চিকিৎসকরা। এর আগে দেহে অক্সিজেনের মাত্রা হঠাৎ পড়ে যাওয়ার ফলে কৃত্রিম পদ্ধতিতে অক্সিজেন দিতে হয়েছিল তাঁকে। অনুব্রতর শরীরে সুগারের মাত্রা বেশ বেশি, প্রতিদিনই তাঁকে ইনসুলিন নিতে হয়। ঘুম থেকে উঠেই হৃদরোগ এবং সুগারের জন্য তাঁকে খেতে হয় চার থেকে পাঁচ রকমের ওষুধ। আবার বোলপুরের রিপোর্টে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে, ফিসচুলা, হাইপারটেনশন, অবসাদের সমস্যার প্রসঙ্গ। এসএসকেএম-এর ডাক্তাররা যখন মনে করছেন, হাঁটাহাটিতে সমস্যা নেই, তখন বোলপুরের চিকিৎসকদের মতে, বিশ্রামের প্রয়োজন কেষ্টর।
যদিও মঙ্গলবারই বোলপুর হাসপাতালের চিকিৎসক চন্দ্রনাথ অধিকারী পৌঁছন অনুব্রত মন্ডলের বাড়িতে। তাঁর বিশ্রাম প্রয়োজন এমনও বলেন ওই চিকিৎসক। সরকারি হাসপাতাল থেকে কোনও ব্যক্তির বাড়িতে কেন চিকিৎসক পাঠানো হলো, এই নিয়ে বিরোধীরা সরব হওয়ার আগেই বিস্ফোরক অভিযোগ সামনে আসে। অনুব্রতর বাড়ি যাওয়া ওই চিকিৎসক অভিযোগ করেন হাসপাতালের সুপার বুদ্ধদেব মুর্মুর বিরুদ্ধে। একটি কল রেকর্ড প্রকাশ্যে এনে ওই চিকিৎসকের দাবি, সুপারের চাপেই তিনি অনুব্রত মন্ডলের বাড়িতে যান। দাবি, সাদা কাগজে নিদান লিখে দেওয়ার কথা বলেন হাসপাতাল সুপার। যদিও 'বেড রেস্ট' লিখে দেওয়ার জন্য বলেন অনুব্রত মন্ডল নিজেই, এমনই দাবি করেন ওই চিকিৎসক। এরপরেই বোলপুরের বাদশার শারীরিক অসুখ নিয়ে ফের ওঠে প্রশ্ন। সরকারি আধিকারিকদের শাসক দল তৃণমূলের প্রতি আনুগত্য নিয়ে সরব হন বিরোধীরা। যদিও সূত্রের খবর, এই শোরগোল এবং মেডিক্যাল-পরামর্শ দেওয়া ওই চিকিৎসকের রিপোর্টই সিবিআইয়ের কাছে আজ জমা দিয়েছেন অনুব্রতর আইনজীবীরা। সূত্র মারফৎ জানা গিয়েছে, এখানেই আরও কঠিন আইনি অস্ত্র হাতে পেয়েছে সিবিআই। যে রিপোর্ট নিয়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকই সন্দিহান, সেই রিপোর্ট জমা করার প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না সিবিআই আধিকারিকদের একাংশ।
প্রশ্ন উঠেছে এখানেই। তাহলে অসুস্থতাকে কি হাতিয়ার করছেন অনুব্রত মন্ডল? শারীরিক সমস্যা যতটা রয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি দেখিয়ে বারবার হাজিরা এড়িয়ে যাচ্ছেন কেষ্ট? মঙ্গলবারের ঘটনাক্রম এই বিতর্কেই ঘৃতাহুতি করেছে। আর এখানেই হয়তো কোমর বেঁধে নামতে চলেছে সিবিআই। সূত্রের খবর, অনুব্রতকে আর সময় দিতে চাইছেন না তদন্তকারী আধিকারিকরা। এই কারণেই বীরভূমের নকুলদানা বিলির নেতার সিবিআই হেফাজতে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। অনুব্রতর নিরাপত্তারক্ষী সায়গল হোসেনের ১০০ কোটির সম্পত্তি, গ্রেফতারির পর যে সম্ভাবনা আরও জোরালো হচ্ছিল। অনুব্রত কি গ্রেফতার হবেন, এই প্রশ্নই বারবার উঠে আসছিল তখন থেকেই।
প্রসঙ্গত, বগটুই কাণ্ড, ভাদু শেখের মৃত্যু, একের পর এক বাড়িতে আগুন, বহু মানুষের মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত করছে সিবিআই। ওই ঘটনার পর থেকেই আরও চাপে অনুব্রত। বারবার বিতর্কিত কথা, মাথায় অক্সিজেন কম পৌঁছনোর তত্ত্ব শোনা যায়নি আর। শুধুই চলেছে নিজাম প্যালেস, চিনার পার্ক, উডবার্ন ওয়ার্ডের মধ্যে আনাগোনা। যদিও সম্প্রতি তৃণমূলের সাংগঠনিক রদবদলেও অনুব্রতর পদ যায়নি। জেলা সভাপতি হিসেবেই রয়ে গিয়েছেন তিনি। তবে অনুব্রত মন্ডলের ওপর গরু পাচার, সিবিআই-এর চাপ যে আসবে তা একপ্রকার আঁচ করছিলেন তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। সূত্রের দাবি, পার্থ-কাণ্ডের আবহে এই অস্বস্তি কম করতে পদ দিলেও আপাতত কম সক্রিয় হিসেবেই দেখা যাচ্ছিল অনুব্রত মন্ডলকে। এদিকে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী-সহ একাধিক বিজেপি নেতার প্রকাশ্যে সিবিআই মন্তব্য, অনুব্রতর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থার দাবি, রাজ্যের সিপিএম, কংগ্রেসের দেওয়া সেটিং তত্ত্বের চাপের প্রভাবও তদন্তে পড়তে পারে বলে দাবি রাজনৈতিক মহলের একাংশের। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, বারবার সিবিআই হাজিরা এড়িয়ে অভিযুক্তের বহাল তবিয়তে থাকা, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকায় বড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিচ্ছে। সেখানে দাঁড়িয়ে তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা খানিকটা ধাক্কা খাচ্ছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। এই পরিস্থিতিতে অনুব্রত মন্ডলের বিরুদ্ধে যদি কার্যকর ভূমিকা পালন না করা হয়, তাহলে সেই জল্পনা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মত ওই অংশের।