ডাইনোসরের মুখে সরলতার হাসি, বাংলার কোথায় তৈরি হয় ঝুলন যাত্রার পুতুল?

Swinging Dolls in Palpara : কোনও পুতুলই খুব পরিপাটি করে তৈরি করা হয় না এখানে। শিল্পী তাঁর নিজস্ব লোকজ-ভঙ্গিতে পুতুল নির্মাণ করে থাকেন।

এখানে কোনও বহুতল নেই। পাতাল রেল, ভিড় বাসের তীব্র বেগে ছুটে চলা নাগরিক জীবনের দেখা এখানে মেলে না। এখানে সময়ের লয় অতি ধীর। আর, সেই কারণে হয়তো এখানকার পুতুলশৈলীতে শান্তভাব লক্ষ্য করা যায়। নদিয়া জেলার বৈষ্ণবতীর্থ শান্তিপুরের বাগআঁচড়া পালপাড়ার এই পরিবেশের মেঠোভাবনা মনকে মোহিত করে দিয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের ঝুলন যাত্রা উপলক্ষ্যে যে ক’টি অঞ্চলে মাটির পুতুল তৈরি হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শান্তিপুরের বাগআঁচড়া পালপাড়া। ঝুলন যাত্রা শুরু হওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকে নির্মীয়মান কাঠামোর প্রতিমার সামনে চাদর বা বেঞ্চ পেতে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য সাজিয়ে রাখা হয় মাটির পুতুল।

আর্থিক ও সামাজিকভাবে প্রান্তিক শ্রেণিতে থাকা শিশুরাই এই ঝুলনযাত্রাকে বাংলার বুকে সার্বজনীনভাবে বাঁচিয়ে রেখেছে।তাদের জন্যই অঞ্জলি পাল, নমিতা পালেরা মাটির পুতুল তৈরি করে চলেন। ঘুগনি বিক্রেতা, সাপুড়ে, বর-বউ, বউ, কলসি কাঁখে রমণী পুতুলের মধ্যে নিজেদের শিল্পচেতনাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। পুতুলগুলির গঠনশৈলীতে বাঙালিয়ানা রয়েছে। স্থির অথচ স্নিগ্ধ। এই ভাবনা তাদের পুতুল নির্মাণের মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে। পুতুলের মুখমণ্ডল গোলাকার। পুতুলের শারীরিক গঠন সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ বহন করে চলেছে। প্রতিটা পুতুলের মুখমণ্ডলে রয়েছে অনাবিল সারল্য-মাখা হাসি।

আরও পড়ুন-

ইন্দোনেশিয়ার পুতুলনাচ ‘ওয়ায়াং’-এর উৎস লুকিয়ে আছে ভারতেই?

শিল্পীদের কথায় প্রতিটা পুতুলই কাঁচা মাটির তৈরি। মূলত, ঝুলন উপলক্ষে এই পুতুলগুলো তৈরি করা হয়ে থাকে। ঝুলন শুরু হওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকে নির্মীয়মান কাঠামোর প্রতিমার সামনে পুতুলগুলিকে রাখা হয়। গরিব শিশুদের ঝুলন সাজানোর আনন্দ এই পুতুলগুলোর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। দুই খোল ছাঁচের তৈরি মিলিটারি ও সাপুড়ে পুতুলের মধ্যে জীবন সংগ্রামের তীব্র বাস্তবতা নেই। তার বদলে রয়েছে জীবনকে উদযাপন করার শান্ত মনোভাব। শ্রাবণ মাস এলেই বাঙালি বাঁকে করে জল নিয়ে তারকেশ্বরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

ঝুলনের পুতুল

বাঙালি জীবনের এই পরিচিত দৃশ্যও শিল্পীরা তাদের নিজস্ব মুন্সিয়ানায় প্রস্ফুটিত করেছে। গ্রামীণমেলা, বেলুনওয়ালা ছাড়া অসম্পূর্ণ। শিশুরা ঝুলন সাজানোর সময় গ্রামীণ মেলার দৃশ্যচিত্রও গড়ে তোলে। সেই কথা মাথায় রেখে শিল্পীরা বেলুনওয়ালার পুতুল নির্মাণ করে থাকেন। তাঁঁদের তৈরি মাটির কুঁড়েঘর, কঙ্কাল, চৈতন্য মহাপ্রভু, কুমির, ডাইনোসর, শকুন্তলা পুতুল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

কোনও পুতুলই খুব পরিপাটি করে তৈরি করা হয় না এখানে। শিল্পী তাঁর নিজস্ব লোকজ-ভঙ্গিতে পুতুল নির্মাণ করে থাকেন। আর সেই নির্মাণের মধ্যে রয়ে যায় বাংলার আদি ও অকৃত্রিম লোকজ শিল্পধারা। আর সেই কারণে এখানকার আইসক্রিম বিক্রেতা পুতুল মাটিতে বসে রয়েছে। ডাইনোসর পুতুলে হিংস্রতার বদলে মুখের অভিব্যক্তিতে সরল হাসি খেলা করে যায়। কিন্তু নিছক পুতুল বিক্রি করে এই সকল শিল্পীদের সংসার চলে না। প্রতিমা নির্মাণ এবং মাটির বাসনও বিক্রি করে তাঁদের সংসার চলে।

শিল্পীর হাতে ঝুলনের পুতুল

এতকিছুর পরেও ঝুলন এলে তাঁদের মাটির দাওয়া ভরে ওঠে রঙিন পুতুলে। তার মধ্যে কিছুটা মাটির ধুলো মিশে গেলেও অদ্ভুত এক ভালো লাগা ও ভালোবাসা খেলে বেড়ায় গোটা পালপাড়া জুড়ে। কিন্তু আর কতদিন? পরবর্তী প্রজন্ম এই কাজ শিখতে চাইছে না। তাই হয়তো আজ থেকে কুড়ি বা পঁচিশ বছর পর এখান থেকে নির্মূল হয়ে যেতে পারে মাটির পুতুল নির্মাণের ঐতিহ্য। 

আরও পড়ুন-

শক্তিমান থেকে আলিফ লায়লা, আরতি পালের মাটির পুতুল কেন এত জনপ্রিয়?

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, শান্তিপুরের চৌগাছা পালপাড়া, মহাপ্রভু পাড়া, ঢাকা পাড়াতেও মাটির পুতুল তৈরি হয়।  এখানকার পুতুলের মধ্যে পরিপাটি ভাব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বাগআঁচড়া পুতুলের মধ্যে সেই ভাব নেই। বদলে এখানকার পুতুলে রয়েছে অনাবিল এক সারল্য। প্রচারের আলো না-পাওয়ায় এখানকার শিল্পীরা অবজ্ঞার অন্ধকারে রয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তাতে ওঁদের কোনও দুঃখ নেই। জীবনের প্রতি মুহূর্তের যাপন ও পল্লী জীবনের সারল্যের মধ্যেই তাঁরা নিজেদের প্রকৃত মূল্যবোধকে খুঁজে পেয়েছেন। আর তারই প্রভাব গিয়ে পড়েছে তাঁদের পুতুল নির্মাণের মধ্যে।

More Articles