তৃণমূল ‘দল’ নিয়ে কি মমতা-অভিষেকের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিল আরজি কর কাণ্ড?
RG Kar Case: আরজি কর কাণ্ডের পরেই একদম প্রথম দিকে দলের লোকজনকে নিয়ে দোষীদের 'ফাঁসির দাবি'তে রাস্তায় নেমেছিলেন মমতা। ভেবেছিলেন যে তিনি যে কাজে দক্ষ, সেই রাস্তায় নেমে আন্দোলন করলেই হাওয়া ঘুরিয়ে দিতে পারবেন।
দলটি কি নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেল নাকি ইচ্ছে করে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হল? আরজি কর কাণ্ড নিয়ে যখন সারা রাজ্য উত্তাল, সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামলেন। এক মাসের উপর হয়ে গেল আন্দোলন থিতিয়ে আসছে বলে মনে হলেও, গত প্রায় দেড় মাস ধরে তৃণমূল দল হিসেবে 'নিরুদ্দেশ' হয়ে গেল। একা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমলাদের নিয়ে বিপত্তি সামলাতে হল। যদিও যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন কুণাল ঘোষ। কিন্তু কুণাল ঘোষ মানেই তো পুরো তৃণমূল দল নয়। আর তাঁর কথা শুনতে ভাল লাগলেও, সেই কথার প্রতিধ্বনি করতে গিয়ে বা 'চাপে' পড়ে নেত্রীর কাছে পয়েন্ট বাড়াবার চেষ্টা করলেন, তাঁরা দলকেই বরং আরও চাপে ফেললেন।
সাম্প্রতিক একটি ঘটনার উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে দলটি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরজি কর কাণ্ড নিয়ে নাজেহাল এবং বেহাল অবস্থা সামাল দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, তখন বারাসাতের এক কাউন্সিলর নাকি ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছেন! এমনটাই অন্তত দাবি রাজ্য পুলিশেরই গোয়েন্দা বিভাগের।
দলের এই বিপর্যয়ে দলেরই একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কোন কাজে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন দেখুন!
আরজি কর কাণ্ডের পরেই একদম প্রথম দিকে দলের লোকজনকে নিয়ে দোষীদের 'ফাঁসির দাবি'তে রাস্তায় নেমেছিলেন মমতা। ভেবেছিলেন যে তিনি যে কাজে দক্ষ, সেই রাস্তায় নেমে আন্দোলন করলেই হাওয়া ঘুরিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু তা হয়নি। কারণ না তো মমতা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, না তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা। বরং দলের মুখপাত্র ডাক্তার শান্তনু সেন যখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, তিনি আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে সেই কবে অভিযোগ করেছিলেন, কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি, তখন শান্তনুকে মুখপাত্রের পদ থেকে সরিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে ভুল বার্তাই পৌঁছেছেন মমতা। এর পর সুখেন্দু শেখর রায় হোক বা জহর সরকার — রাজ্যসভার সাংসদেরা তাঁদের বিবেকের কথা বলা শুরু করতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল দলের মধ্যে আরজি কর কাণ্ড নিয়ে কতটা অস্বস্তি রয়েছে।
আরও পড়ুন: বিনীত গোয়েল, স্বাস্থ্য অধিকর্তা অপসারিত! জুনিয়র ডাক্তারদের জয় না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের?
ব্যাস। সেই মিছিলের পরই সবাই গুটিয়ে গিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের ক্ষোভের সামনে। দলের মুখপাত্রের ভূমিকায় সামনে এসে কড়া কড়া কথা বলে ব্যাটিং করছিলেন বটে কুণাল কিন্তু সঙ্গে আর্ত চিৎকারও করছিলেন যে দলের মুখ যাঁরা তাঁরা কেন কেউ কিছু বলছেন না। সেই চাপে যখন কাঞ্চন মল্লিকের মতো অভিনেতা-বিধায়ক যখন মুখ খুললেন তখন এমনই কিছু কথা বলে বসলেন প্রতিবাদী সহ-শিল্পীদের সম্বন্ধে যে তাঁকে পরে ক্ষমাও চাইতে হল।
সেই লাইনেই উদয়ন গুহ থেকে শুরু করে হালের স্বপন দেবনাথের মতো দলের নেতারা নিজেদের মতো করে 'কু-কথা' বলতে গিয়ে জন আন্দোলনের যে প্রতি-আলেখ্য তৈরি করলেন, তা আদতে দলের পুরুষতান্ত্রিক স্বৈরাচারী রূপই চিনিয়ে দিল।
এর পরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় ২৮ অগাস্ট দলের ছাত্রদের সভা থেকে কর্মীদের ফোঁস করার আহ্বান জানিয়ে একে তো কোনও কাজ হল না, সঙ্গে নেত্রী খোদই বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন।
না তো মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়, না দল হিসেবে তৃণমূল — কেউই সাধারণ জনগণকে দলীয় পতাকা ছাড়া কখনও বিপক্ষ হিসেবে পায়নি। সুতরাং জন আন্দোলনের মুখে কঠিন অবস্থার মুখে পড়েছিল তৃণমূল। তার থেকে বেরিয়ে আসার পথ না তো নেত্রীর, না দলের কর্মীদের জানা ছিল।
আর তাই কুথার বন্যা, আর নয়তো গায়ের জোরে আরজি কর আন্দোলনের মোকাবিলা করতে পথে নেমেছিল দলের নেতা-কর্মীরা। যে পথ তাঁদের জানা, সেই হুমকি, মারধর, জোর করে রাস্তায় লেখা স্লোগান মুছে দেওয়া, পুলিশের সাহায্য়ে খানিকটা দমন করা আন্দোলনকারীদের — সেই পথে কেউ কেউ এগিয়েছিলেন। কিন্তু জনগণের আন্দোলনের প্রতি-আলেখ্য তৈরি করতে তৃণমূল নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছে।
বিশ্বাস হয় না, যে তৃণমূল এত বিপুল ভোটে জিতে আসে, রাজ্যের প্রতিটি কোণে যাঁদের সংগঠন, যাঁদের দাপটে বিরোধীরা টুঁ শব্দটি করতে পারে না, সেই দলের কেউ জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের সময় আন্দোলন ভাঙা তো দুরের কথা, সামান্য ট্র্যাক টু আলোচনাটুকুও করতে পারল না। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমলা ও পুলিশের সাহায্যে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন ভাঙাতে হল। কিন্তু সঙ্গে নিজেকেও নমনীয় হতে হল পুলিশ কমিশনারকে ও স্বাস্থ্য দফতরের দুই কর্তাকে সরিয়ে।
ভোটে জিতলেও, এই আন্দোলন খানিকটা স্তিমিত হলেও মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়কে ভাবতে হবে যে দলের নেতা কর্মীদের বিশ্বাসযোগ্যতা কোথায় এসে পৌঁছেছে। ডাক্তারদের প্রতিনিধিত্ব করা তৃণমূলের নেতা ও ছাত্র নেতাদের যা নাম ও কীর্তি শোনা যাচ্ছে, তাতে বোঝাই যায় যে এই দলের ছাত্রদের কাছে কেমন বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে। শুধুই ধমকে চমকে আর পুলিশের সাহায্য নিয়ে দল চালালে যা হওয়ার তাই হয়েছে। মমতা দলের একমাত্র মুখ — এই টোটকায় ততক্ষণ সব ঠিক থাকবে, যতক্ষণ মমতার গায়ে কোনও দাগ না লাগছে। কিন্তু আরজি কর কাণ্ডে তো সন্দীপ ঘোষকে আড়াল করার অভিযোগ খোদ মমতার গায়েই লাগল। তিনিই 'উৎসবে ফেরার' আহ্বান জানালেন। তিনিই প্রথমে পুলিশ কমিশনারকে সরিয়ে দিতে গররাজি ছিলেন।
আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও দলের নেতাদের আমলাদের পায়ের তলায় রাখলে, যা ফল হওয়ার তাই হয়েছে। পুলিশ-আমলাদের দিয়েই এই আন্দোলন সামলাতে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী হওয়ার সুবাদে শুধু চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যই একমাত্র জনপ্রতিনিধি হিসেবে মমতার সঙ্গে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। যেদিন মমতা জুনিয়র ডাক্তারদের ধরনা মঞ্চে উপস্থিত হলেন, কোনও দলের নেতাকে পাশে নিয়ে যেতে ভরসা পেলেন না! মায় বিধাননগরের নেতারাও ধরনা মঞ্চে উঠতে পারলেন না।
আরও পড়ুন: ‘বদন বিগড়ে গেছে’! আন্দোলনকারীকে নিয়ে যেভাবে শ্লীলতার মাত্রা ছাড়াচ্ছেন কুণাল-দেবাংশু
আর এই জ্বলন্ত সময়ে তৃণমূলের যুবরাজ নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলেন এই ঝামেলা থেকে। প্রশাসন ও পুলিশ নিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেকদিন ধরেই অনেক অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল ও সরকার চালানোর ধরন নিয়ে। এই জঞ্জালে তিনি শুদ্ধ থাকতে চাইলেন এবং দলের নেতা হিসেবে সরকারের পাশে দাঁড়াতে চাইলেন না। তিনি চাইলে দলকে পথে নামাতে পারতেন ঠিকই। কিন্তু দলের অনেক নেতা-কর্মীদের মতো তাঁরও যে এই ঘটনায় সরকারি সিদ্ধান্তে সমর্থন নেই তা স্পষ্ট। সঙ্গে নিজেকে দূরে রেখে ভবিষ্যতে পালাবদলের পথ খোলা রাখলেন তিনি।
গোটা পর্বে দলকে নিষ্ক্রিয় রাখলেও, এর পরে কিন্তু দল তাঁকে চালাতে হবে এই নেতা-কর্মীদের নিয়েই। যে নেতা-কর্মীরা গত দেড় দশক ধরে কাটমানি, হুমকি, চমকানো, গায়ের জোরে ও বৈভবে বেড়ে উঠেছেন। যাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা কেমন তা আরজি কর নিয়ে গণ আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে।
শুধুই বিজেপির জুজুতে এবং বামেদের ব্যর্থতার উপর ভর করে দল চালানো তৃণমূল নেতাদের সময় এসেছে ভবিষ্যতের কথা ভাবার। জনগণকে নিজেদের 'সম্পত্তি' হিসেবে ধরে নিলে এই রকম বিপদই যে আবার সামনে আসবে, তা একপ্রকার নিশ্চিত।