ভারতীয় ক্রিকেটের ড্রেসিংরুমে, অজিঙ্ক রাহানে কেন হঠাৎ মুখ খুলতে গেলেন?
অজিঙ্ক রাহানের বলা দুটি লাইন নিয়ে তোড়পাড় দেশের ক্রিকেট চৌহদ্দি । কী বলেছেন রাহানে? একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে রাহানে বলেছেন, অস্ট্রেলিয়া সফরে তার ড্রেসিংরুম এবং মাঠে নেওয়া কিছু সিদ্ধান্তকে কেউ নিজের বলে কৃতিত্ব নিয়ে চলেছেন। কোন সময়ের কথা বলছেন রাহানে? সেই সময়টা লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে রাহানের কথাগুলো কার উদ্দেশ্যে বলা। ২০২০-২১ সালে ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরের টেস্ট সিরিজের সাফল্যের কথা বলেছেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন কোহলির সহ-অধিনায়ক। ওই সিরিজের প্রথম টেস্ট ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় লজ্জার পরাজয় হিসেবে মনে করা হয়। অ্যাডিলেডে পিঙ্ক বল টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৩৬ রানে অল আউট হয়ে যায় কোহলির ভারত। ম্যাচে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় ভারত।
এরপর পিতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে কোহলি দেশে ফিরে আসেন। নেতৃত্বে ভার পান অজিঙ্কার রাহানে। ক্রিকেট পণ্ডিতরা ভেবেছিল ওই টেস্টের পর ভারতের আর ঘুরে দাঁড়ানোর কোনও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ৩৬ রানে দুরমুশ হয়ে যাওয়া একটা দলকে নতুন দিশা দেখান অধিনায়ক রাহানে। টেস্ট দলের একাধিক নিয়মিত সদস্য চোটের জন্য একে একে চলে যান দলের বাইরে। কার্যত একটি নতুন দল নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে রাহানের লড়াই নজির সৃষ্টি করে। মেলবোর্নে দ্বিতীয় টেস্টে রাহানে নিজে সেঞ্চুরি করে সেই লড়াই সূচনা করেন। শুভমান গিল, ঋষভ পান্থ, ওয়াশিংটন সুন্দর, শার্দুল ঠাকুর, মহম্মদ সিরাজ নিজেদের পারফরম্যান্সের জোরে কঠিনতম প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়াকে দেশের মাটি টেস্ট সিরিজে হারিয়ে ইতিহাসের পাতায় পাকাপাকি জায়গা করে নেন।
একটি ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায় সিরিজ শেষে ড্রেসিংরুমে তৎকালীন কোচ রবি শাস্ত্রী লম্বা-চওড়া ভাষণ দিচ্ছেন খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে। আর পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ইতিহাস তৈরি করা ক্যাপ্টেন অজিঙ্ক রাহানে। ওই সিরিজে ভারতীয় দলের সাফল্যকে সব সময় কোহলির ক্যাপ্টেন হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। আর ক্যাপ্টেন হিসেবে রাহানে যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা চাপা পড়ে যায় ভারতীয় ক্রিকেট মহলে কোহলির পিআর এজেন্ট হিসেবে কাজ করা কিছু মানুষের জন্য। এক কথায় বলতে গেলে অস্ট্রেলিয়াকে তাদের দেশে বধ করে আসার কোনও কৃতিত্ব দেওয়া হয়নি অধিনায়ক রাহানেকে। একই সঙ্গে এই সিরিজে সাফল্যের কারিগর বলে কোচ হিসাবে যতদিন ভারতীয় দলের সঙ্গে ছিলেন তখনও এবং দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নেওয়ার পরও বুক বাজিয়ে বিশ্বের কাছে নিজের কৃতিত্ব নিয়ে চলেছেন রবি শাস্ত্রী।
কিন্তু যারা ক্রিকেট সম্পর্কে খুব সামান্য জ্ঞান রাখেন তারা সকলেই জানেন, ক্রিকেট মূলত অধিনায়ক নির্ভর একটি খেলা। সেখানে কোচের ভূমিকা তেমন নেই বললেই চলে। বিশেষ করে প্রথম এগার নির্বাচন থেকে শুরু করে দল মাঠে নেমে গেলে কোচের আর তেমন কোনও ভূমিকা থাকে না। সেখানে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে ক্যাপ্টেন নিজের। ঠিক এই জায়গাতেই রাহানে বলেছিল, ড্রেসিংরুমে এবং মাঠে যে সিদ্ধান্তগুলো তিনি নিয়েছিলেন তার কৃতিত্ব অন্য কেউ নিয়েছি।
কিন্তু রাহানে নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে এই কথাগুলো বলতে গেলেন কেন? যখন তাঁর নিজের ব্যাটে দীর্ঘদিন তেমন রান নেই। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মেলবোর্নে ঘুরে দাঁড়ানো দ্বিতীয় টেস্টে ১১২ রান তাঁর শেষ বলার মত ইনিংস। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে আসন্ন টেস্ট সিরিজে দলে তার জায়গা হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলী তাঁকে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার পরামর্শ দিয়েছেন। একমাত্র সেখানে রান করতে পারলে তবেই হয়তো আবার টেস্ট দলে তাঁকে দেখা যেতে পারে। এরকম পরিস্থিতিতে রাহানের স্বভাব বিরুদ্ধ এ রকমের কথা বলায় স্তম্ভিত ক্রিকেট ভক্তরা। অনেকেই মনে করছেন পুরো বিষয়টি পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থার দিকে একটু নজর ঘোরালে সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রাহানের যাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সেই সাংবাদিকের সঙ্গে বর্তমানে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ কর্তাদের সম্পর্ক যারা জানেন তাদের কাছে গোটা বিষয়টা কার্যত স্পষ্ট। রাহানে বিসিসিআইয়ের চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার। তিনি চাইলেও হঠাৎ করে কাউকে সাক্ষাৎকার দিতে পারেন না। তার জন্য বোর্ডের অনুমতির প্রয়োজন হয়। অনুমতি পাওয়া গেলে সেখানে কি ধরনের কথা বলতে হবে তা রাহানের মত সিনিয়ার ক্রিকেটার খুব ভালোমতোই জানেন।
চিরকাল বিতর্ক থেকে বহু দূরে থাকা রাহানে হঠাৎ করে এইভাবে কথা বলাই অনেকেই মনে করছেন একদা কোহলির ডেপুটি কথাগুলো বলেছেন বোর্ডের সর্বময় কর্তাদের নির্দেশেই। কিন্তু বোর্ড কর্তাদের হঠাৎ করে এই পরিকল্পনা করতে যাওয়ার দরকারই বা কী পড়েছিল? রবি শাস্ত্রী ভারতীয় দলের কোচের পথ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর থেকেই লাগাতার আক্রমণ করে আসছেন বর্তমান বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলীকে। বিশেষ করে বিরাট কোহলিকে অধিনায়ক পদ থেকে সরানোর পর আক্রমণ মাত্রাছাড়া হয়ে গিয়েছে। শাস্ত্রী আর গাঙ্গুলীর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে কিছু বলার দরকার পড়েনা।
তাই বোর্ড কর্তারা এমন একটি বন্দুক থেকে গুলি করলেন যার সামনে দাঁড়িয়ে মোকাবিলা করতে হলে রবি শাস্ত্রীকে একটু সময় নিতে হবে। একই সঙ্গে বিরাট কোহলির পি আর এজেন্ট হিসেবে কাজ করা ভারতীয় ক্রিকেটের কিছু মুখ কেউ একসঙ্গে বন্ধ করার একটি অসাধারণ পরিকল্পনা ছিল রাহানের এই ইন্টারভিউ।