ইংরেজি চায়নি বামেরা, চাইছেন না অমিত শাহও! কোথায় মিল, কোথায় ফারাক?

Amit Shah: বামফ্রন্টের প্রাথমিক থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়া এবং আজ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে এক অদ্ভুত সাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে।

দিল্লিতে একটি বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ইংরেজি ভাষা জানা এবং সেই ভাষায় কথা বলাকে নিয়ে কিছুকাল আগেই তাঁর মত ব্যক্ত করেছেন। ইতিমধ্যেই তা বিতর্কও শুরু করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষা সংক্রান্ত উদ্বেগ নতুন নয়। যদিও গুজরাত, যে রাজ্য থেকে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান, সেই রাজ্যের মানুষজন কোনওদিনই কোনও ভাষা নিয়ে আন্দোলন করেছেন বলে জানা নেই, তবে বিভিন্ন সময়ে অমিত শাহের ভাষা সংক্রান্ত বিবিধ মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অনেকে বলে থাকেন, তিনি নিজে গুজরাতি হয়েও যেভাবে অ-হিন্দিভাষীদের উপর হিন্দি ভাষা চাপানোর চেষ্টা করেন তা তাঁর এক রাজনৈতিক কৌশল। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তিনি আসলে ভাষাভিত্তিক বিদ্বেষ তৈরির কাজই সুকৌশলে করে থাকেন। এই বিষয়ে তাঁর সাম্প্রতিকতম বক্তব্য কারও মনে ভারতীয় অস্মিতা জাগ্রত করলেও আসলে এর মধ্যেও ভাষাভিত্তিক বিভাজনের বীজ নিশ্চিতভাবে প্রোথিত, তা একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ভারতীয় ভাষাগুলি অচিরেই এত উন্নতি করবে, যে ইংরেজির মতো একটি বিদেশি ভাষায় যাঁরা স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল, তাঁদের লজ্জিত হতে হবে। শুধু এই কথাটার মধ্যে থেকেই একাধিক প্রশ্ন উঠে আসে। তাহলে কি কেন্দ্রীয় সরকার দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাগুলোর উন্নতির জন্য কোনও প্রক্রিয়া চালু করেছে? হিন্দি ছাড়াও অন্য কোনও ভাষার প্রতি শাসকের আগ্রহ আছে তবে? হিন্দির আগ্রাসন বাড়ানোর কেন্দ্রীয় সরকারের প্রবণতা দক্ষিণ ভারতে, বিশেষ করে তামিলনাডুর মানুষজনকে আতঙ্কিত করেছে বারংবার। কেন্দ্রের ত্রিভাষিক নীতির বিরোধিতায় তাঁরাও সরব হয়েছেন। পাশাপাশি পূর্ব ভারত, বিশেষত উত্তরপূর্ব ভারতের ভাষাগুলোকে যে কেন্দ্রীয় সরকার ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না, তারও প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায়। এমনকী উত্তর ভারতের ভোজপুরী, মৈথিলিসহ আরও বেশ কিছু ভাষাও হিন্দির দাপটে হারিয়ে গেছে। সংবিধানে যতই বলা থাক ইংরেজি সমেত ২২টি স্বীকৃত ভাষা আছে, তা সত্ত্বেও যেভাবে শুধু হিন্দির দাপট বেড়েছে তাতে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই মন্তব্য তাই একাধারে আতঙ্ক ছড়ায় অন্যদিকে আশঙ্কিত করে হিন্দি ছাড়া অন্য ভাষার মানুষকে। মন্ত্রীর প্রকাশ্য ইংরেজি বিরোধিতাকে যদি কেউ সমস্ত ভারতীয় ভাষার প্রতি প্রেম ভাবেন, তাহলে মস্ত ভুল করবেন। আসলে এই বক্তব্যের পিছনে, তাঁর এবং তাঁর দলের ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাই প্রকট হয়।

আরও পড়ুন- নতুনভাবে ইতিহাস লেখার নিদান অমিত শাহের, ‘হিন্দুরাষ্ট্রের’ পথে আরও এক ধাপ?

চারদশক আগে বামফ্রন্ট সরকার যখন প্রাথমিক থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল তখন সেই সিদ্ধান্তের পিছনে তাদের যুক্তি ছিল— ইংরেজি একটি বিদেশি ভাষা এবং সেই ভাষা কোনও পড়ুয়া  ছাত্রজীবনের পরের দিকেও শিখতে পারে। এই ধারণার মূল প্রবক্তা ছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। পাশাপাশি তাঁর মত ছিল, যেহেতু ইংরেজি ধনীদের ভাষা এবং সেই ভাষা যদি প্রাথমিক থেকে শেখানো হয়, তাহলে বিদ্যালয়গুলোতে ড্রপ আউটের সংখ্যা বাড়বে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, ইংরেজি ভাষা অভিজাতদের এবং সমাজে শিক্ষিত শ্রেণির আধিপত্যের একটি হাতিয়ার। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে সেদিন কোনও সন্দেহের অবকাশ তিনি রাখেননি যে, অভিজাত শিক্ষা এবং ইংরেজির ভূমিকার প্রতি তাঁর ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই নেই। তাঁর কাছে ইংরেজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছিল শ্রেণি সংগ্রামের অংশ। যে সময়ে প্রাথমিক থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত বামফ্রন্ট সরকার গ্রহণ করছে, সেই সময় থেকেই দেখা যাচ্ছিল বিভিন্ন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল গড়ে উঠছে। শুধু স্কুল শিক্ষাতেই নয়, পরবর্তীতে কলেজ শিক্ষাতেও দেখা গিয়েছিল বিভিন্ন বেসরকারি পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটছে। তারপর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যখন আবারও প্রাথমিকে ইংরেজি ফেরানোর জন্য সওয়াল করেন, ততদিনে সিপিআইএম মেনে নিয়েছে যে তাদের আগের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। সেই সময়ে দেখা গিয়েছিল, পাঠ্যক্রমে ইংরেজির অনুপস্থিতি শিক্ষার্থীদের কেবল সরকারি স্কুল থেকে দূরে সরিয়ে দেয়নি বরং পরবর্তী পর্যায়ে ইংরেজি শেখার সময় ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজির মানও হ্রাস পেয়েছে।

বামফ্রন্টের প্রাথমিক থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়া এবং আজ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে এক অদ্ভুত সাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে। দুটো রাজনৈতিক দলই বলতে চেয়েছে যে, ইংরেজি একটি বিদেশি ভাষা এবং অবশ্যই অভিজাতদের ভাষা। তবে সেইসময়ের প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার বিতর্কের সঙ্গে এখন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ইংরেজি বলাকে লজ্জিত হওয়ার সঙ্গে তুলনা করাটা জরুরি। বর্তমান বিতর্কের পিছনে হিন্দিভাষা চাপিয়ে দেওয়ার কৌশলের সঙ্গে সেদিনের বিতর্কের মূলগত তফাৎ আছে এবং সেইজন্যেই অমিত শাহের বক্তব্যের চূড়ান্ত বিরোধিতা হওয়া জরুরি।

বিরোধীরা সঠিকভাবেই বিষয়টি চিহ্নিত করেছেন এবং প্রতিবাদ করেছেন। এই সময়ে বাইরের জগতের সঙ্গে যুঝতে, নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি শেখা জরুরি। গান্ধি থেকে আবুল কালাম আজাদ কিংবা দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু অবধি বিদেশি শাসকের অধীনে থাকাকালীন শুধু ইংরেজি ভাষা আয়ত্তই করেননি, নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে সেই ভাষাকে বিদেশিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন এবং শাসকের ভাষাতেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। লোকসভার বিরোধী দলনেতা প্রশ্ন তুলেছেন, আজকের শাসক বিজেপিও কি চায় না, ভারতের দরিদ্র মানুষজন ইংরেজি শিখে জীবনে এগোক এবং ক্ষমতাকে প্রশ্ন করুক? ডিএমকে নেতা প্রশ্ন করেছেন, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সন্তান সন্ততিরাই শুধু বিদেশের নানা নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবেন আর গরিব মানুষ তিমিরেই পড়ে থাকবে?

ইংরেজি ভাষাকে কি আদৌ আর বিদেশি ভাষা বলা যায়? কেন্দ্রীয় সরকার যখন বাজেট পেশ করে, তখন তা ইংরেজিতেই করা হয়, এমনকী সরকারি কোনও বিজ্ঞপ্তিও ইংরেজিতেই দেওয়া হয়। বিচারব্যবস্থাতেও ইংরেজি ব্যবহার করাটাই দস্তুর। আগামীতে এই প্রচলিত রীতিগুলোর বদল হবে কি? যদি তাই হয়, তাহলে তার পরিবর্তে হিন্দি ভাষাকেই যে আরও একটু এগিয়ে দেওয়া হবে, তা বলাই বাহুল্য। সেক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারত কিংবা পূর্ব ভারতের মানুষদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ভাষা হিন্দিই হবে, আর আশঙ্কা সেখানেই।

আরও পড়ুন- কাশ্মীরের দুর্দশার জন্য দায়ী নেহরু, বলছেন অমিত শাহ! কী বলছেন কাশ্মীরে মানুষ?

বিভাজনের রাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁরা নিত্যনতুন উপায় খোঁজেন বিভাজনের। কখনও ধর্ম, কখনও জাতি, কখনও ভাষা, কখনও লিঙ্গ, কখনও খেলা— কোনও বিভাজনের কারণকেই এঁরা ফেলে দিতে চান না। তাই ইংরেজি বলার সঙ্গে লজ্জিত হওয়ার বিষয়টিকে জুড়ে দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসলে নতুন করে আবার ভাষিক বিভাজনকেই উস্কে দিলেন। একজন ইংরেজিতে কথা বলা নাগরিককে যদি ‘ভিনদেশি’ বলা হয় তাহলে আখেরে বহুত্ববাদেরই ক্ষতি হয়। কিছুদিন আগেই পহেলগাঁওয়ের ঘটনার প্ররিপেক্ষিতে বিরোধী সাংসদদের যে প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়েছিল বিদেশে, তার নেতৃত্বে ছিলেন ইংরেজিতে সাবলীল দক্ষতা সম্পন্ন বেশ কিছু সাংসদই। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিশ্বের নানা দেশে কর্মরত ভারতীয়দের সংযোগ স্থাপনের ভাষাও ইংরেজিই। নানা রাজ্যের মানুষদের যোগাযোগের মাধ্যম কখনই শুধু হিন্দি হতে পারে না, ইংরেজিই কাজের ও সকলের বোধগম্য এক ভাষা।

সংবিধান প্রণেতা ডাঃ আম্বেদকর ইংরেজি ভাষাকে জ্ঞান ও অগ্রগতির প্রবেশদ্বার হিসেবে দেখেছিলেন, বিশেষ করে আইন, বিজ্ঞান এবং প্রশাসনের মতো ক্ষেত্রগুলিতে, যেখানে ঐতিহ্যগতভাবে উচ্চবর্ণের আধিপত্য ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইংরেজি শেখা দলিতদের বর্ণপ্রথার দ্বারা আরোপিত সীমাবদ্ধতাগুলি কাটিয়ে উঠতে এবং পূর্বে তাঁদের বঞ্চিত সুযোগগুলিকে পেতে সাহায্য করতে পারে। সেইজন্যেই এখন বিভিন্ন রাজ্যের দলিত মানুষজন দাবি তুলছেন তাঁদের ক্ষমতায়নের জন্য, সামাজিক মর্যাদার সমানুপাতিক অধিকারের জন্যে আরও বেশি করে ইংরেজি শেখার প্রয়োজনীয়তা আছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে পড়াশোনা সহ ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জনে আম্বেদকরের নিজস্ব সাফল্য, ইংরেজি ভাষার সাবলীলতার ব্যবহারিক সুবিধাগুলোরই প্রদর্শন করে। সেই ইংরেজি ভাষায় কথা বলাকে যদি রাজনৈতিকভাবে কটাক্ষ করা হয় তাহলে বিশ্বের কাছে এই বিষয়ে নেতিবাচক বার্তাই যাবে।  উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরিতে ‘ইংরেজি দেবী’-র একটি মূর্তি স্থাপিত হয়েছে ২০১০ সালে, যার একহাতে রয়েছে পেন এবং অন্যহাতে ভারতের সংবিধান। সেই দেবী অধিষ্ঠান করছেন একটি ল্যাপটপের উপর। সেই দলিতদের যদি ইংরেজি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাহলে ভারতের অসংখ্য দলিতেরা কি তাঁকে মনে করিয়ে দেবেন না যে, তাঁরা আসলে বাবাসাহেব আম্বেদকরের শিক্ষায় শিক্ষিত, তাঁদের জন্য ইংরেজি একটি অতি প্রয়োজনীয় অস্ত্র, যার মধ্যমে তাঁরা শাসককে তাঁর নিজের ভাষায় প্রশ্ন করতে পারে!

More Articles