সিপিএমের ছায়াতেই বেড়েছে অর্জুনের শক্তি! কেন হারলেন ব্যারাকপুরের বাহুবলী?
Arjun Singh Lok Sabha Election 2024: ভাটপাড়া নৈহাটি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে অর্জুনের বিরুদ্ধে প্রায় একশো কোটি টাকার বেশি কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে।
সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে ফলাফলের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রটি নিয়ে সকলেরই যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। এই কেন্দ্রে সপ্তদশ লোকসভার বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং, লোকসভার মেয়াদ চলাকালীনই অদ্ভুতভাবে দলবদল করেছিলেন। সংসদে খাতায় কলমে তিনি ছিলেন বিজেপির সাংসদ। অথচ হঠাৎ মাঝপথে তিনি তুলে নিলেন তৃণমূলের পতাকা। বিজেপির টিকিটে জিতে সাংসদ পদে ইস্তফা না দিয়েই হয়ে গেলেন তৃণমূলের নেতা।
মজার কথা হলো, এই অর্জুন সিং ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের ঠিক আগে যখন তৃণমূলে ছিলেন, তখন বুঝতে পারলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে আর টিকিট দেবেন না। ঠিক তখন থেকেই স্পষ্টত দলবদলের জায়গায় চলে গেলেন তিনি। 'স্পষ্টত' কারণ, অর্জুনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড দেখে খুব নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তিনি একটা সময় তৃণমূল কংগ্রেসে থাকলেও মানসিকভাবে ছিলেন একেবারেই বিজেপির লোক। বিজেপি-আরএসএস নেতৃত্বের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর, গোপন সম্পর্ক।
২০১৯-এ দলবদল করে বিজেপিতে গিয়ে সেই দলের টিকিটে জিতে প্রথমেই অর্জুন তাঁর সদ্য ছেড়ে আসা দল, তৃণমূল কংগ্রেসের প্রায় সব স্তরের কর্মীদের উপর ভয়ংকর রকমের অত্যাচার শুরু করেন ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে। যাঁরা ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের অধিবাসী, তারা যে রাজনীতির সমর্থকই হন না কেন, তাঁদের প্রত্যেকের স্মৃতিতে দগদগে ঘায়ের মতো হয়ে রয়েছে ২০১৯-এর নির্বাচনের অব্যবহিত পরে তৃণমূল এবং সিপিআই(এম)-এর লোকজনদের উপর অর্জুন সিংয়ের দলবলের ভয়াবহ অত্যাচার।
ওই পর্যায়ে, খাতায়-কলমে অর্জুন সিং যে ক'টা দিন বিজেপির সাংসদ ছিলেন, নিজের নির্বাচন কেন্দ্র ব্যারাকপুর, সাধারণ জনজীবনের সমস্যা ঘিরে তাঁর এতটুকুও মাথাব্যথা ছিল না। এই সময়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ কিছুজনের নির্মম হত্যা ঘটেছে, যেগুলির পিছনে অর্জুন সিংয়ের ভূমিকা আছে কিনা, তা নিয়ে এলাকাবাসী থেকে শুরু করে অর্জুনের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের মানুষও সন্দেহ করেছেন। এই প্রসঙ্গে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়, এককালে অর্জুনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মণীশ শুক্লার রহস্যজনক হত্যাকাণ্ডটিকে। সেই হত্যাকাণ্ডের পরে অর্জুন সিংয়ের ভীষণ শীতল মানসিকতা ছিল চোখে পড়ার মতোই। অনেকেই বলেছেন, অর্জুনই নিজের পথের কাঁটা সরিয়েছেন।
অর্জুনের আঙ্গিকে রাজনীতি করবার নিরিখে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের হিন্দিভাষী মানুষজনের মধ্যে মণীশ শুক্লা ধীরে ধীরে একটা জায়গা করে নিতে শুরু করেছিলেন। টিটাগড় ,ব্যারাকপুর অঞ্চলে মণীশের রাজনৈতিক প্রভাব এতটাই প্রবল হয়ে উঠতে শুরু করেছিল যে অর্জুনের মনে এমন আশঙ্কা তৈরি হওয়া আশ্চর্যের নয় যে, অচিরেই মণীশ হয়তো তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবেন।
মণীশের রাজনীতির ধারা কিন্তু অর্জুনের নিরিখে আলাদাই ছিল কারণ, মণীশের রাজনৈতিক হাতেখড়ি অর্জুনের হাত ধরে নয়, বিতর্কিত সিপিআই(এম) নেতা তড়িৎ বরণ তোপদারের হাত ধরে। ফলে, অর্জুন যেমন তাঁর একান্ত আত্মীয় পরিজন বা কাছের লোক ছাড়া কারও কোনও সমস্যার ব্যাপারে প্রকৃত আন্তরিক আচরণ করতেন না, তেমনটা কিন্তু মণীশের মধ্যে দেখতে পাওয়া যেত না। বিপক্ষ রাজনৈতিক শিবিরের লোকজনও নানা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে মণীশের কাছে উপকৃত হতেন।
আরও পড়ুন- মোদিই প্রধানমন্ত্রী হবেন? নাকি, শেষ মুহূর্তে মোক্ষম চাল দেবেন নীতীশ-নাইডু?
ধীরে ধীরে টিটাগড়, ব্যারাকপুর, ইছাপুর এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হিন্দিভাষী মানুষজনকে ছাপিয়ে বাংলাভাষীদের মধ্যেও মণীশের জনপ্রিয়তা তৈরি হতে শুরু করেছিল। তড়িৎ তোপদারের রাজনীতির ধারাতেই মণীশের রাজনৈতিক জীবনে শুরু, তাঁর রাজনীতির ভিন্ন একটা রাজনৈতিক মাত্রা ছিল যে ভিন্নতার প্রতি মণীশের একটা মানসিক টানও ছিল। এই মানসিকতা এক সময়ে, এই অঞ্চলের অন্যতম জনপ্রিয় তৃণমূল নেতা বিকাশ বসুর মধ্যেও ছিল। এই বিকাশ বসুকে হত্যা করা ঘিরে অর্জুনের বিরুদ্ধে আদালতের সাফাই যতই থাকুক না কেন, সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে বাংলাভাষী মানুষদের ভেতরে চাপা ক্ষোভ অবশ্যই আছে। বিকাশ বসুর রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থী ঝোঁক থাকলেও, দলমত নির্বিশেষে তাঁর বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা ছিল। বিকাশ বসু যে কেবলমাত্র দক্ষিণপন্থী মানসিকতার নাগরিকদের কাছেই নিজের জনপ্রিয়তা তৈরি করতে পেরেছিলেন, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। বহু বামপন্থীও বিকাশ বসুর প্রতি গুণমুগ্ধ ছিলেন।
এমন একজন ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অর্জুনের নাম জড়ানো, দীর্ঘদিন তাঁর জেলবাস ঘোরতর তৃণমূল সমর্থক বা ঘোরতর বিজেপি সমর্থকদের মধ্যেও দীর্ঘদিন ধরে চাপা ক্ষোভ তৈরি করেছিল, যে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটল ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে অর্জুনের পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে।
যে মণীশ শুক্লা একটা সময় অর্জুন অন্ত প্রাণ ছিলেন, সেই মণীশের হত্যা ঘিরে অর্জুনের হিমশীতল নীরবতা, অথচ আসানসোল শিল্পাঞ্চলে কয়লা মাফিয়ার হত্যাকাণ্ড ঘিরে অর্জুনের নানা আস্ফালন- সমস্ত কিছুই ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের মানুষ খুব নীরবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বাহুবলী অর্জুনের ভয়ে তাঁরা মুখ খুলতে রাজি ছিলেন না কিন্তু সুযোগ পেতেই জবাব দিয়েছেন ইভিএমের মাধ্যমে।
অর্জুনের রাজনৈতিক ক্ষমতা যত বেড়েছে, তাঁর নির্বাচন কেন্দ্রের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাওয়া পাওয়ার ক্ষেত্রগুলি তত বেশি সংকুচিত হয়েছে। অর্জুনের পরিবার এবং একান্ত ব্যক্তিগত হাতেগোনা দু' চারজন লোক ক্রমশ ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। অর্জুন যখন ২০১৯ সালে বিজেপির প্রার্থী হয়ে লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন আইনগত কারণেই তাঁকে ভাটপাড়া বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূলের বিধায়ক পদ ত্যাগ করতে হলো। সেখানে তিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে বিজেপির টিকিটে প্রার্থী করলেন নিজের পুত্র পবনকে। ভাটপাড়া বা নৈহাটির বহু মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বিজেপি করেন। প্রথম দফায় অর্জুন তৃণমূলে থাকার সময় ওইসব বিজেপি কর্মীরা অর্জুনের দ্বারা নানাভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। এই অংশের বিজেপি কর্মীরা পুত্র পবনকে ভাটপাড়া বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী করাকে মেনে নিতে পারেননি। এবারের লোকসভা নির্বাচনে এই মানুষরাই নীরবে হারিয়ে দিলেন দলবদলুক অর্জুনকে।
তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার ফলে অর্জুনকে হারাতে হয়েছিল ভাটপাড়া পৌরসভার চেয়ারম্যানের পদ। কার্যত এই পদটিকে ব্যবহার করেই অর্জুন তাঁর নিজের পরিবার-পরিজনকে 'পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি'-র ক্ষেত্রে অনেকখানি সুবিধা করে উঠতে পেরেছিলেন। বিজেপির সাংসদ হয়েই নিজের হারানো পদে কায়দা করে নিজের ভাইপোকে বসিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের এলাকার যাবতীয় শাসনতান্ত্রিক পদগুলিতে যে ভয়াবহ পরিবারতন্ত্র চালু করেছিলেন অর্জুন তা তাঁর অতি বড় সমর্থকরাও মেনে নিতে পারেননি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অর্জুন নিজের যে ভাইপোকে একটা সময় ভাটপাড়া পৌরসভার চেয়ারম্যান করেছিলেন, সেই সৌরভ সিং হলেন তৃণমূলের পার্থ ভৌমিকের মুখ্য নির্বাচনী এজেন্ট। মজার বিষয় হলো, এই সৌরভের ঘনিষ্ঠ এক তৃণমূল সমর্থককে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত অর্জুন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় পাপ্পু, এই মুহূর্তে শ্রীঘরে। অভিযোগ, অর্জুনের হয়ে টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে পাপ্পুই বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
ভাটপাড়া নৈহাটি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে অর্জুনের বিরুদ্ধে প্রায় একশো কোটি টাকার বেশি কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে পাপ্পু দীর্ঘদিন হাজতবাস করেছে। সংশ্লিষ্ট মামলায় সে এখন জামিনে মুক্ত। যে ধরনের অর্থনৈতিক অভিযোগে কেন্দ্রীয় এজেন্সি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছে, ঠিক একই ধরনের অভিযোগ ভাটপাড়া নৈহাটি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক ঘিরে অর্জুনের বিরুদ্ধে রয়েছে। অথচ কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি আজ পর্যন্ত অর্জুনের টিকিও ছোঁয়নি।
জাল দলিল দাখিল করে, যে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অর্জুন সেসব সাধারণ আমানতকারীর টাকা। অর্জুনের বিরুদ্ধে ওঠা আর্থিক কেলেঙ্কারির জেরে ভাটপাড়া নৈহাটি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের অবস্থা অনেকটা শ্যামনগরের রাহুতা কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সাধারণ আমানতকারীদের আতঙ্ক ছিল চরমে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভাটপাড়া-নৈহাটি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের যে সমস্ত আধিকারিকদের সাহায্যে অর্জুন আর্থিক দুর্নীতি সংঘটিত করতে পেরেছেন সেইসব কর্মীরা সাময়িক সাসপেন্ড হলেও, ঘরে বসে বেতনের একটা বড় অংশই পেয়ে যাচ্ছেন তারা। এরা কেউ কেউ হয়তো রাজনৈতিকভাবে বিজেপিরই সমর্থক, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্জুনের বিরুদ্ধেই ভোট দিয়েছেন।
অর্জুন নিজে মেঘনা জুট মিলের সামনে যে এলাকায় থাকেন, সেই এলাকার গরিব মুসলমানেরা ভোটের ফল প্রকাশের দিন মেরুকরণে জেরে প্রবল আশঙ্কার মধ্যে ছিলেন। আশঙ্কা ছিল, অর্জুন জিতলেই ফের ভয়াবহ সন্ত্রাস নেমে আসবে। এই অংশের মানুষ সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে নির্ভরযোগ্য অনুমান করেই পার্থ ভৌমিককে ভোট দিয়েছেন। তাঁরা কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলকে ভোট দেননি, দিয়েছেন পার্থ ভৌমিককে, তৃণমূলকে নয়। কারণ পার্থকে ঘিরে গরিব মুসলমানদের মধ্যে ভরসা তৈরি হয়েছিল যে, পার্থ জিতলে মুসলমানেরা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে নিরাপদ থাকবেন। তাঁরা ভোট দিয়েছেন অর্জুন সিংয়ের বিরুদ্ধে, বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন, এটা কিন্তু বলা যায় না। কারণ, বিজেপি যদি ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে দলবদলু অর্জুন সিংয়ের পরিবর্তে অন্য কাউকে প্রার্থী করতে, তাহলে ছবিটা অন্য হতেও পারত।
যখন তড়িৎ তোপদার এই অঞ্চলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, সেই সময়ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তাগিদে বিজেপির ভোটের শতাংশ ব্যারাকপুরে বেড়েছে। ১৯৮৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে তড়িৎ তোপদার সিপিআই(এম) প্রার্থী হিসেবে ব্যারাকপুরে প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি সেবার পেয়েছিলেন ৫০.৫৬ % ভোট। সেই বছর ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপির প্রার্থী ছিলেন তৃপ্তি রতন দত্ত, পেয়েছিলেন ১.৯৩ শতাংশ ভোট। ১৯৮৪-তে ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যুজনিত সহানুভূতির হাওয়ায় ১৯৮৫-র ভোটে দেবী ঘোষাল জিতেছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে ।
১৯৮৯-এর নির্বাচনে দেবী ঘোষাল হেরে যান, তবে তাঁর সঙ্গে সিপিআই(এম প্রার্থীর ফারাক ছিল মাত্র ৫% এর সামান্য বেশি। দেবী পেয়েছিলেন ৪৫.৪১ % ভোট। ভিপি সিং-চন্দ্রশেখরদের সরকার ভেঙে যাওয়ার পর ১৯৯১ সালে মধ্যবর্তী লোকসভা নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে তড়িৎ তোপদার ফের বিজয়ী হন। তিনি পেয়েছিলেন ৪৭.৫৬ % ভোট। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দেবী ঘোষাল সেবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, ৩৮.৭৮% ভোট পান। আর সুশীল কুমার সান্যাল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন বিজেপি প্রার্থী হিসেবে। তিনি পেয়েছিলেন ১০.৭০%। ভোটের নিরিখে তিনি পেয়েছিলেন ৭২ হাজারেরও বেশি ভোট।
মনে রাখা দরকার, এই সময়কালেই বিজেপি আদবানির রথযাত্রা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির হাওয়া বইয়েছিল দেশে। সেই সময় এই অঞ্চলে বামপন্থীরা সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে খুব বেশি সক্রিয় ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে তখন ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকার। তড়িৎ তোপদার তাঁদের দলের রাজনৈতিক বিন্যাস অনুযায়ী অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। তা সত্ত্বেও হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি যে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে ধীরে ধীরে শক্তি বৃদ্ধি করছে তাকে স্থানীয় সিপিআই(এম) বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। ১৯৯১-এর নির্বাচনে তাই বিজেপির ভোটের হার বৃদ্ধি পায়।
অর্জুন সিং তখন রাজনীতির আঙিনায় খুবই নবীন। তার বাবা সত্যনারায়ণ সিং ১৯৮৭ সালে জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে ভাটপাড়া বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন। পুত্রকে রাজনীতির আঙিনায় প্রবেশ করানোর ব্যাপারে অত্যন্ত সক্রিয় তিনি। অর্জুন সিংয়ের সেই সময় বিজেপি করার কোনও প্রশ্নই উঠছে না। কংগ্রেস দলও তখন ভাগ হয়নি। অর্জুন জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে থেকেই রাজনীতি করছেন। তা সত্ত্বেও হিন্দু সাম্প্রতিক রাজনীতির প্রতি তাঁর ঝোঁক তখন থেকেই বেশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছিল।
ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের কাঁকিনাড়া, জগদ্দল অঞ্চলগুলিতে পারিবারিক ব্যবসার দৌলতে অর্জুনের পরিবারের একটা বড় রকমের প্রভাব চিরদিনই আছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী সময়ে সেই অঞ্চল গুলিতে নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা তৈরি হয়েছিল যার পেছনে অর্জুনের ভূমিকা ছিল। মানসিকতায় তখন থেকেই অর্জুন সাম্প্রদায়িক, চরম মুসলমান বিদ্বেষী। কীভাবে ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট তথা এলাকায় শক্তিশালী সিপিআই(এম)-কে পর্যুদস্ত করতে পারা যায় তাই ছিল অর্জুনের লক্ষ্য। ভাটপাড়া ,কাঁকিনাড়া,জগদ্দলে সেই সময় অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন সিপিআই(এম)-র প্রয়াত নেতা গোপালদেব ভট্টাচার্য।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অব্যবাহিত পরে, ভাটপাড়া সংলগ্ন শিল্পাঞ্চলের মিশ্র জনজাতির মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিজেপি খুব সামান্য শক্তি নিয়েও দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। নিজের রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতে অর্জুন তাতে মদত দেন। এই জায়গাতে মুসলমান সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সিপিআই(এম) নেতা গোপালদেব ভট্টাচার্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন বলেই অর্জুন সিং বিশেষ কোনও রকমের রাজনৈতিক ফায়দা লুঠতে পারেনি।
১৯৯৬-এর লোকসভা নির্বাচনে, ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন আশীষ রঞ্জন দাস, প্রায় পঞ্চাশ হাজারের মতো ভোট তিনি পেয়েছিলেন। গোটা ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে কিন্তু বিজেপির প্রাপ্ত ভোট এবং শতাংশের হার ১৯৯১ সালের নির্বাচনের তুলনায় অনেকটাই কমে এসেছিল। বিজেপির ভোট তখন নেমে এসেছিল ৫.৯৪ শতাংশে।
আরও পড়ুন- মোদি ম্যাজিক শেষ! বারাণসীতে কেন এত কম ভোট পেলেন মোদি?
নানা রাজনৈতিক সমীকরণের ফলে তড়িৎ তোপদার আর প্রয়াত বিদ্যুৎ গাঙ্গুলির সঙ্গে ধীরে ধীরে অর্জুনের সমীকরণের অঙ্ক অন্যদিকে এগোতে শুরু করে বলে শোনা যায়। অর্জুনকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার জায়গাও আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলতে শুরু করেন গোপালদেব। ভাটপাড়ার বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রথাগত শিক্ষার মধ্যে না আসা নতুন প্রজন্মের হিন্দিভাষী ছাত্র-যুবরা যাতে অর্জুনের পাল্লায় না পড়ে, তার জন্য একটা সামাজিক প্রক্রিয়া নিজের মতো করে গোপালদেব চালাতেন। তাতে যে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথাগত পদ্ধতির প্রয়োগ থাকত এমনটা নয়। অনেকক্ষেত্রেই বুর্জোয়া রাজনীতি যেভাবে সামাজিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে সেই আদলেই গোপালদেব কাজ করতেন। তিনি হিন্দিভাষী অঞ্চলে অর্জুন সিংয়ের প্রভাব বৃদ্ধিকে প্রতিহত করতে পেরেছিলেন। আবার গোপালদেদের বিরুদ্ধে হিন্দিভাষীদের অতিরিক্ত প্রশয় দেওয়ার অভিযোগও ওঠে। তবে এই পর্যায়েও তড়িৎ, বিদ্যুতের আশীর্বাদ যেভাবে আড়ালে আবডালে ঝরে পড়ছিল অর্জুনের প্রতি, সেটাকে কাজে লাগাতে অর্জুন কখনও কার্পণ্য করেননি।
তড়িৎ-অর্জুন জুটিকে গোটা ব্যারাকপুর জুড়ে 'মামা ভাগ্নে' বলে সম্বোধন করা হয়। তড়িৎ তোপদারের বদান্যতা ছাড়া সিপিআই(এম) জমানায় অর্জুন সিংয়ের পক্ষে বাহুবলী হয়ে ওঠাই সম্ভবপর ছিল না। শারাফাত হোসেনের (বিতর্কিত ভাগাড় কাণ্ডের অভিযোগও যাকে ঘিরে আছে) মতো শ্রমিক নেতার সঙ্গে অর্জুনের সম্পর্ক ঘিরে বহু রকমের সংশয় আছে। এই শারাফাত হোসেনকে যখন সিপিআই(এম)-এর স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি অংশ, তাঁদের দলের আরও উঁচু উঁচু কমিটিগুলোতে জায়গা করে দেন, তখন গোটা ব্যাপারটা ঘিরে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়। বাম নেতৃত্বকে শারাফাত হোসেনের মতো লোকদের নিয়র বহু অভিযোগ জানিয়েও কখনও তেমন ফল পাওয়া যায়নি। উল্টে অভিযোগ জানানোর পর, সিপিআই(এম) দলের আঞ্চলিক স্তরে এই শারাফাতের সঙ্গীদের পদোন্নতি ঘটেছে।
তবে ভোট রাজনীতির নিরিখে তড়িৎ আর অর্জুনের মধ্যে সম্পর্ক ঘিরে যে রটনা, তা ঘটনা হোক বা না হোক, সাধারণ বামপন্থী ভোটারদের মধ্যে বামপন্থীদের ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। তা না হলে তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপির এই দ্বৈরথের মধ্যেও ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে স্থানীয় স্তরে প্রায় অচেনা সিপিআই(এম) প্রার্থী দেবদূত ঘোষ, যিনি এলাকায় নিজের প্রচারেই পার্ট টাইমার ছিলেন বলে সিপিআই(এম) কর্মী সমর্থকদের বক্তব্য, তিনি এক লাখের উপরে ভোট পেতেন না।