খাদ্যের অভাবে লুঠ করতে হচ্ছে মানুষকে, কেন এই অবস্থা হল চিনের?
৯ এপ্রিল চিনের সাংহাই শহরে অসংখ্য সাধারণ মানুষ পুলিশি ঘেরাটোপ ভেঙে একটি সুপারমার্কেটে লুঠপাট চালায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও তার সত্যতা যাচাই করা হয়নি এখনও পর্যন্ত। সূত্র মারফৎ জানা যাচ্ছে, ঘটনার দিন একদল মানুষ লকডাউনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, দেশে ঘনিয়ে আসা খাদ্যসংকটের বিরুদ্ধে সাংহাইয়ের রাস্তায় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। উল্টোদিকে চিনের পুলিশ প্রতিবাদীদের দমন করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সাংহাইয়ের প্রতিবাদীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের সমস্ত ব্যারিকেড ভেঙে ফেলতে সক্ষম হন তাঁরা। তারপর সেই অঞ্চলের একটি সুপারমার্কেটে অবাধে ঢুকে পড়ে মানুষ। একদল মানুষ পুলিশের চোখের সামনেই বেশ কিছু খাবারের বাক্স লুঠ করে, এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে অরাজকতা।
একটু দেখে নেওয়া যাক, কী কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হল চিনে।
ঠিক যেন ২০২০-র জানুয়ারির ঘটনাবলির পুনরাবৃত্তি ঘটছে চিনে। মনে করা হয়, সে-বছর চিনের ইউহান শহর থেকেই পৃথিবীর অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছিল করোনার প্রথম ঢেউ। দেশের করোনা-আক্রান্তদের সংখ্যায় ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটার ফলে সেবার কঠোর লকডাউনের পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছিল চিন। তারপর কোভিডের তিনটে ঢেউয়ের ধাক্কা সামলে যখন পৃথিবী সবে স্বাভাবিক ছন্দে ফেরবার চেষ্টা করছে, তখন শি জিনপিংয়ের দেশেই হানা দিল করোনার নতুন প্রজাতি, এক্সই (XE)। দেশে অতিমারী রুখতে এবারও লকডাউনেই ভরসা রেখেছেন জিনপিং।
আরও পড়ুন: বিশ্বজুড়ে খাদ্যসংকট চরমে? ভারতে কতটা ছায়া ফেলবে এই বিপদ?
গত ১২ মার্চ থেকে কঠোর লকডাউনের ফলে গৃহবন্দি হয়েছেন চিনের মানুষজন। দেশের বিভিন্ন শহরের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ, ছাড় কেবলমাত্র জরুরি পরিষেবায়। ইতিমধ্যে চিনের চাংচুনের মতো শহরগুলিতে বাড়ছে করোনার প্রকোপ। গণহারে করোনা পরীক্ষার ওপর বিশেষভাবে জোর দিচ্ছে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রক। চিনের প্রতিটি শহরবাসীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনা পরীক্ষা করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। এছাড়াও কোভিড সেন্টার গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে করোনা-আক্রান্তদের সুস্থ জনসমাজ থেকে আলাদা করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এই অবস্থায় চিনের লকডাউন দ্রুত শিথিল করার কোনওরকম ইঙ্গিত দিচ্ছে না চিনের প্রশাসন। প্রসঙ্গত, ইতিপূর্বে কোভিডের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কঠোর লকডাউনকেই হাতিয়ার করেছেন শি জিনপিং। অতিমারীর গোড়া থেকেই তিনি ‘জিরো কোভিড পলিসি’ বা ‘কোভিডশূন্য নীতি’-তে চলবার পক্ষপাতী।
কী এই জিনপিংয়ের ‘কোভিডশূন্য নীতি’?
চিনা সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, এই নীতির মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল, ‘ফাইন্ড, টেস্ট, ট্রেস, আইসোলেট অ্যান্ড সাপোর্ট।’ অর্থাৎ, কোভিড-আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত খুঁজে বের করে তাঁকে জনসমাজ থেকে আলাদা রেখে সমস্তরকমভাবে সাহায্য করাই সরকারের লক্ষ্য। কিন্তু খাতায়-কলমে যাই-ই থাক, চিনা প্রশাসনের ‘কোভিডশূন্য নীতি’-র প্রায়োগিক চিত্র খানিক আলাদা।
কোভিডের জন্মলগ্ন থেকেই অতিমারীর প্রকোপে রাশ টানতে নিজেদের সীমান্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় চিনের প্রশাসন। এ-ছাড়াও করোনার সংক্রমণ শূন্যে নামিয়ে আনতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লকডাউন ঘোষণা করে গৃহবন্দি করা হয় মানুষকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই হল জিনপিংয়ের ‘কোভিডশূন্য নীতি’র আসল চরিত্র। অতিমারীর ভয়াবহতা খানিক কমার পর পৃথিবীর বেশ কয়কেটি দেশ বাণিজ্যিক স্বার্থে করোনাবিধি খানিক শিথিল করার পথে হাঁটে। তৎসত্ত্বেও চিনে দীর্ঘদিন পর্যন্ত লকডাউন পরিস্থিতি বলবৎ থাকে। দেশের জনগণের ওপর কঠোর নিয়মবিধি চাপিয়ে জিনপিং চিনের করোনার সংক্রমণ তলানিতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি আদৌ সফল কি না- তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
এই নীতির ফলে কী ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে?
চিনের অর্থনীতিবিদ রেমন্ড ইয়েয়ুং মনে করেন, দেশে যদি লাগাতার এমন লকডাউন চলতে থাকে, তাহলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাঁর মতে, এই বছর চিনা সরকারের লক্ষ্য ছিল, দেশকে ৫.৫ % বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার, কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দা-র ফলে তা ৫%-এ এসে থেমেছে। এমতাবস্থায় অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশে লকডাউন জারি রাখা অযৌক্তিক। একইরকম সুর শোনা গেছে চিনের ব্যবসায়ীদের একাংশের গলায়। শিনপিংয়ের নীতির বিরোধিতা করে তাঁরা বলছেন, ‘এই পরিস্থিতি যদি মাসখানেকের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়, তাহলে অসুবিধে নেই, কিন্তু লকডাউন যদি বছরখানেকের কাছাকাছি জারি রাখা হয়, তাহলে একের পর এক সংস্থা বন্ধ হবে, মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে।’ শিনপিংয়ের ‘কোভিডশূন্য নীতি’কে সাধারণ মানুষের একাংশ ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে অক্ষম। এমন নীতির ফলে অদূর ভবিষ্যতে চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে পারে দেশ, এমনটাই মনে করছেন তাঁরা।
লকডাউনের ফলে চিনের অর্থনীতি খানিক মন্থর গতিতে চলছিলই। ইতিপূর্বে নানা সময় অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কায় চিনের মানুষজন প্রকাশ্যে লকডাউনের বিরোধিতা করেছেন। এবার প্রশাসনিক ত্রুটির ফলে তার সঙ্গে এসে যুক্ত হল নতুন সমস্যা। জিনপিং সরকারের সাম্প্রতিক নির্দেশ অনুযায়ী, লকডাউন পরিস্থিতিতে সরকারি সাইট থেকেই মানুষজনকে প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য অর্ডার করতে হবে। বাজারহাট করতেও তাঁরা বাড়ির বাইরে পা রাখতে পারবেন না। সরকারের তরফ থেকেই তাঁদের বাড়িতে খাবার-দাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। চিনা প্রশাসন হয়তো দেশবাসীর কথা মাথায় রেখে সু-উদ্যোগই নিয়েছিল, কিন্তু বিপত্তি বাধল অন্য জায়গায়। সাংহাই শহরে সরকারি সাইটে এত বেশি সংখ্যক মানুষ খাবারের অর্ডার দিতে আরম্ভ করলেন যে, সকলকে সময়মতো তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হল না। দোকান-বাজারে যাওয়াতেও নিষেধাজ্ঞা, অতএব বহু মানুষই প্রশাসনিক গলদের ফলে না খেয়ে দিন কাটাতে বাধ্য হলেন। একে লকডাউন, তার ওপর ঘরে খাদ্য নেই। সাংহাইয়ের ঘটনায় এর ফলও পাওয়া গেল অল্প সময়ের মধ্যেই। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের তরফে এখনও পর্যন্ত স্পষ্টভাবে কোনও বক্তব্য দেওয়া হয়নি, তবে লকডাউনের ফলে চিনের সাধারণ মানুষকে কীভাবে দিন কাটাতে হচ্ছে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ যেন এর মধ্য দিয়ে পাওয়া যায়।
অনেকেই মনে করছেন প্রতিটি ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে ভাইরাসের শক্তি ক্ষয় হচ্ছে। এর বিরুদ্ধ মতও অবশ্য রয়েছে। অতিমারীর অবসান এখনই নয়, একথা প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন ‘হু’ এর মুখ্যসচিব টেথরস অ্যাডানম। করোনার সঙ্গেই হয়তো অনির্দিষ্টকালের জন্যে বাঁচতে হবে সাধারণ মানুষকে, এমন সম্ভবনার কথাও উঠে আসছে। এমতাবস্থায় লকডাউনের আদৌ কোনও যৌক্তিকতা রয়েছে কি না তা পুনর্বিবেচনা করে দেখছে বিভিন্ন দেশের প্রশাসন। ইতিপূর্বে জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং আয়ারল্যান্ডের মতো দেশগুলিতে মানুষ লকডাউনের বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমেছেন। সরকার স্বাভাবিক জীবনযাপনে নিষেধাজ্ঞা নামিয়ে না এনে বিকল্প পথ বাতলে দিক, এমন দাবিই তুলেছেন তাঁরা। লকডাউনের ফলে ক্ষুদ্র পুঁজি বিপন্ন। এই অবস্থায় সত্যিই হয়তো সময় এসেছে লকডাউনের বিকল্প হিসেবে কোনও সুদূরপ্রসারী নীতিকে বেছে নেওয়ার।