কেন স্বাধীনতা দিবসের মঞ্চ আরএসএস প্রশস্তির জন্য বেছে নিলেন মোদি?

Modi's Independence Day Speech: বিজেপি তাদের নিজস্ব বিধিনিষেধ পালন করা একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ দল হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে, সঙ্ঘকেও হাতে রাখা জরুরি কারণ সঙ্ঘের সিদ্ধান্ত বিজেপিতে অনেকটাই গুরুত্ব পায়।

লালকেল্লায় ৭৯তম স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে ১০৩ মিনিটের ভাষণ দিয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতের ইতিহাসে স্বাধীনতা দিবসে কোনো প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘতম ভাষণ এটি। শুধু তাই নয়, ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রী সরকারি মঞ্চ থেকে সরাসরি আরএসএস-এর প্রশংসা করলেন। এই দিন আরএসএস ও স্বাধীনতা দিবসকে এক সমীকরণে টেনে আনেন তিনি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে “বিশ্বের বৃহত্তম স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা” হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “১০০ বছর ধরে সঙ্ঘ দেশসেবায় নিবেদিত। বিপদে-আপদে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ইতিহাস সঙ্ঘের গর্ব।” সত্যি কি তাই? কেন হঠাৎ আরএসএস-এর প্রসঙ্গ টানলেন নরেন্দ্র মোদি?

মোদি আরএসএস-এর প্রশংসা করে বলেন, “সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা ‘সেবা ও সংগঠন’-এর আদর্শ বুকে নিয়ে নিরলস কাজ করে চলেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষা– সবক্ষেত্রেই তাঁদের ভূমিকা অনন্য।” মোদির এই বক্তব্যকে স্বাভাবিকভাবেই সমর্থন জানিয়েছেন স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সদস্যরা। তবে বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, সরকারি মঞ্চে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের প্রশংসা রীতিবিরুদ্ধ। এই নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে।

গত ১১ বছর মোদি সরকারি স্তরে সঙ্ঘের সঙ্গে দূরত্বই রেখেছিলেন। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে সেই দূরত্ব আরও বেড়েছিল। ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ বলছেন, স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে সেই নীতি ভাঙলেন মোদি। অনেকেই আবার মনে করছেন, ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের (Lok Sabha Election) পর মোদি আরএসএস-এর সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চান। বিজেপি তাদের নিজস্ব বিধিনিষেধ পালন করা একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ দল হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে, সঙ্ঘকেও হাতে রাখা জরুরি কারণ সঙ্ঘের সিদ্ধান্ত বিজেপিতে অনেকটাই গুরুত্ব পায়।

আরও পড়ুন- একশো বছরের বিতর্কিত অতীত! শতবর্ষ পেরিয়েও কেন উদযাপনে নেই আরএসএস?

আসলে আগে থেকেই মোদির অবসর নেওয়া নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছিল। কারণ, লালকৃষ্ণ আডবাণী ৭৫ বছর বয়সে অবসর নিয়েছিলেন। আর গত ১৭ সেপ্টেম্বর মোদির ৭৫-র বছর পূর্ণ হয়েছে। গত বছর লোকসভা নির্বাচনের আবহে দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়াল মোদির অবসরের বিতর্ককে আরও উস্কে দিয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে সফলতাও পেয়েছিলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী, তা বোঝা গিয়েছিল যখন অমিত শাহ এবং রাজনাথ সিং-এর মতো বিজেপির প্রধান নেতৃত্বরা এর উত্তর দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁদের জবাব ছিল, মোদি নিশ্চয়ই তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ পূরণ করবেন, তার আগে অবসরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। শীর্ষস্থানীয় নেতারা যতই এই বিষয় ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করুক, বিজেপির ভেতরে এবং বাইরে এই নিয়ে চর্চা ছিলই।

উত্তরপ্রদেশের প্রবীণ বিশ্লেষক ও নিউজট্র্যাকে-র মুখ্য সম্পাদক যোগেশ মিশ্র (বিজেপি দলটাকে ৪০ বছর পর্যবেক্ষণ করেছেন) বিবিসি-কে বলেছিলেন, ৭৫ বছর বয়সে অবসরের বিষয়টি এনেছিলেন, আরএসএস নেতা রামলাল। মোদি যখন ক্ষমতায় আসেন আরএসএস-এর এই নেতা তখন বিজেপির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিজেপির দুই প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী এবং মুরলী মনোহর জোশীকে সম্মানের সঙ্গে সরাতে তিনি এই পথ বেছে নেওয়ার বুদ্ধি দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, 'ক্যাবিনেটে যদি আডবাণী বা জোশীর মতো ব্যক্তিরা থাকেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীকে ছাঁড়াও ক্ষমতার ছোট বৃত্ত বা পাওয়ার সেন্টার তৈরি হওয়ার ঝুঁকি থাকবে, যা নরেন্দ্র মোদির শিবির মোটেই চায়নি'।

বিজেপির তথাগত রায় একবার বিবিসি-কে বলেছিলেন, বিজেপিতে ঐক্যমতের ভিত্তিতে নেতা নির্বাচন করা হয় ঠিকই, তবে বিজেপির অভিভাবক (সঙ্ঘ)-এর মতামত অনেকটাই গুরুত্ব পায়। তাঁর বক্তব্য, দলের সভাপতি বা প্রেসিডেন্টকেই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা হয় না। যেমন, বিজেপির নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তার প্রায় এক যুগ আগেই তিনি দলের সভাপতির পদ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। আবার ২০১৩ সালে, দলের তৎকালীন সভাপতি রাজনাথ সিং মোদির নাম প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থীর জন্য প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি আরও বলেন, "আমাদের দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড হল সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী সংস্থা। তারাই কোনো নামে প্রথমে সম্মতি দেয়, এবং সঙ্ঘের নেতৃত্ব প্রকাশ্যে না-এলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় খুব ঘনিষ্ঠভাবেই যুক্ত থাকেন।" তাঁর কথায়, এরপর পার্লামেন্টারি বোর্ড সবুজ সংকেত দিলে, ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ বা জাতীয় কর্মসমিতি সিদ্ধান্ত নেয়।

আরও পড়ুন- ভারতের সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ কায়েমে আরএসএস-এর ভূমিকা

প্রসঙ্গত, স্বাধীনতা আন্দোলনে আরএসএস-এর ভূমিকা নিয়ে আজও প্রশ্ন চিহ্ন রয়েছে, বরং বিনায়ক দামোদর সাভারকারের মতো নেতাদের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ ওঠে তাঁরা সেদিন ইংরেজদের সামনে মুচলেকা দিয়েছিলেন। অথচ স্বাধীনতা দিবসের পবিত্র মঞ্চকে সেই সংগঠনেরই বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করলেনা মোদি। ১৯৩০-এর সত্যাগ্রহ, ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন কোনোটাতেই অংশ নেয়নি আরএসএস। স্বাধীনতার পরে জাতীয় পতাকা ও সংবিধানেও আপত্তি জানায় ওই সংগঠন।

অতীতে একাধিকবার কংগ্রেস সরকার আরএসএসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ১৯৪৭-এর ২৪ জানুয়ারি পঞ্জাব প্রদেশে প্রথম নিষিদ্ধ হয়েছিল। এরপর ১৯৪৮ সালে ঘোষিত সঙ্ঘী নাথুরাম গডসে মহাত্মা গান্ধী-কে হত্যা করে। যদিও সঙ্ঘ দাবি করে, ১৯৩০ সাল থেকে নাকি গডসে আর সঙ্ঘের সদস্য ছিল না। তবে গান্ধী হত্যার পর থেকেই আরএসএসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর আবার জরুরি অবস্থার সময় এবং বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনায় আরএসএসকে নিষিদ্ধ করা হয়।

মোদি এই সংগঠনকেই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ এনজিওর তকমা দিয়ে বসলেন। নিজেকে আরএসএস-এর একজন একনিষ্ঠ স্বয়ংসেবক প্রমাণ করতে গিয়ে, স্বাধীনতা দিবসের দিনও ইতিহাসের তোয়াক্কা করলেন না। যা দেখে স্তম্ভিত ইতিহাসের মনোযোগী ছাত্ররা।

More Articles